করোনাকালে জীবন ও জীবিকা: কাকে রেখে কাকে ছাড়বেন?
মাসুদা ভাট্টি- নাম তার লায়লা। দুই সন্তানের জননী, স্বামী কী করে? এই প্রশ্নের উত্তরে সে বলে, ‘কী আর করে, ভাদাইম্যাগিরি করে।’ তাহলে চলে কী করে? লায়লা বাংলাদেশের হাজার হাজার নারীর মতোই তৈরি পোশাক শিল্প-কারখানায় কাজ করে। সন্তান দুটিকে গ্রামে বয়স্ক ননদের কাছে রেখে ঢাকায় লায়লা ওদেরই গ্রামের আরও কয়েকজনের সঙ্গে একত্রে পাশাপাশি থাকে, কাজ করে, বাড়িতে টাকা পাঠায়, নিজে বাঁচে, স্বপ্ন দেখে ছেলেদের মানুষ করার। লায়লার সঙ্গে জানাশোনা আছে কিংবা করোনা সংক্রমণের পর থেকে বারবার কথা হয়েছে বলে তার কথা লিখছি, নিশ্চিতভাবেই ধরে নিচ্ছি যে লায়লার মতো বাকি নারী শ্রমিকদেরও অবস্থা খুব বেশি এদিক-ওদিক হওয়ার কথা নয়।
হঠাৎ মরণঘাতী করোনাভাইরাস বাংলাদেশের মতো দেশে এসে হানা দিলো। সরকার প্রথমে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগলো, কী করবে? কীভাবে এত মানুষকে খাওয়াবে? বাঁচিয়ে রাখবে? এসব হিসাব-নিকাশের একটা সুরাহা করে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করলো। ওদিকে তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকরা তাল তুলে দিলো যে তারা মারা যাচ্ছে, কারণ বিদেশি গ্রাহকরা তাদের দেওয়া ‘অর্ডার’ বাতিল করে দিয়েছে, সুতরাং তারা শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দিতে অপারগ। সরকার তো আর এই বিপুল সংখ্যক শ্রমিককে বঞ্চিত করতে পারে না, বাধ্য হয়েই প্রণোদনা ঘোষণা করতে হলো সবার আগে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের জন্য। বলা হলো, কেবল শ্রমিকদের বেতন পরিশোধের জন্য এই প্রণোদনা নেওয়া যাবে, হুড়োহুড়ি পড়ে গেলো এই প্রণোদনা গ্রহণের জন্য। এখন পর্যন্ত পর্যাপ্ত কোনও প্রকাশিত তথ্য নেই যার ভিত্তিতে বলা যেতে পারে মোট কী পরিমাণ অর্থ তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকরা গ্রহণ করেছেন প্রণোদনার জন্য নির্দিষ্ট করা তহবিল থেকে। তবে প্রকাশিত বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে একথা বলাই যায় যে ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের ভালোই সদ্ব্যবহার হয়েছে। যাহোক, সরকারকে চাপ দিয়ে অর্থ আদায়ের পর পোশাক শিল্পের মালিকপক্ষ সরকার-ঘোষিত ‘সাধারণ ছুটি’ মেনে নিলো এবং পোশাক শ্রমিকসহ রাজধানী থেকে লাখে লাখে মানুষের বাড়ি ফেরার সেই দৃশ্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলো। লায়লাও বাড়ি ফিরে গেলো এবং অপেক্ষায় থাকলো বেতনের জন্য
লায়লার কোনও সঞ্চয় নেই, কোনও জমির মালিকানা নেই, নেই স্বামীর সেই যোগ্যতা, যা দিয়ে মোট পাঁচটি পেটের আহার মাসের পর মাস চালিয়ে যেতে পারে। লায়লা ধার করতে শুরু করলো, ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহণ করলো, যদিও প্রথমে বলা হয়েছিল যে কিস্তি এখনই দিতে হবে না, কিন্তু কিস্তি বাড়লে তারও সুদ জমা হবে সে হিসাব লায়লা বোঝে, ফলে লায়লা কিস্তি দেওয়ার চিন্তা থেকে সরলো না। এখন গ্রামে বা শহরে কোথাও কেউ কাউকে টাকা ধার দেয় না। কারণ, সবাই একথা জানে যে ক্ষুদ্রঋণ নামক টাকা জোগানদানকারী প্রতিষ্ঠান দেশময় কাজ করে যাচ্ছে, তাছাড়া টাকা ধার দিয়ে ফেরত না পাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়, আর ধার দিলে তো সুদ পাওয়া যাবে না, তাই কেউ আর কাউকে টাকা ধার দেয় না আজকাল, নিতান্ত আপনজন না হলে। লায়লার তেমন কেউই নেই। লায়লা বেতনের অপেক্ষা করে, সুপারভাইজারকে ‘মোবাইল’ করে, শেষ পর্যন্ত লায়লাকে বিকাশে টাকা পাঠায় কারখানার সুপারভাইজার, কিন্তু মূল বেতন থেকে সে টাকা প্রায় হাজার খানেক কম। কেন? প্রথমে টাকা ‘বিকাশ’ করতে কাটা গেছে, তারপর সুপারভাইজারও কিছু রেখেছেন সেখান থেকে। মাস কী করে যাবে লায়লা সেই চিন্তায় পড়ে যায়, ওদিকে গ্রামেও করোনা এসেছে, গ্রাম তো আর গ্রাম নেই, কত জায়গা থেকে যে লোকজন গ্রামে ফিরে/আশ্রয় নিতে এসেছে তার কী ঠিক আছে? লায়লা তার ছেলেদের নিয়ে চিন্তায় ঘুমাতে পারে না।
এরমধ্যে আবার শোনা গেলো যে কারখানা খুলে দেওয়া হচ্ছে। লায়লা কী করবে? ঢাকায় যাবে নাকি গ্রামেই থাকবে এই প্রশ্ন নিয়ে হিমশিম খেলো সপ্তাহখানেক, কিন্তু শেষ পর্যন্ত খাবে কী? চাকরি থাকবে তো যদি ফিরে না যায়? টিভিতে দেখা গেলো হাজারে হাজারে মানুষ ঢাকার দিকে হেঁটে যাচ্ছে, বাকিরা গেলে লায়লা একা থেকে চাকরিটা হারাবে নাকি? এসব ভেবেচিন্তে অস্থির হয়ে শেষ পর্যন্ত লায়লাও ঢাকায় ফিরলো। এখন লায়লা কারখানায় যাচ্ছে, আসছে, ওর সঙ্গে যারা থাকে তারাও বেশিরভাগই ফিরেছে। যাদের ‘রক্ষা’ করার মতো পারিবারিক ‘নিরাপত্তা’ আছে তাদের কেউ কেউ ফেরেনি কিন্তু সংখ্যায় তারা কম। আবার গম গম করছে কারখানা ও কারখানা-সংলগ্ন অঞ্চল। জীবন ও জীবিকার মধ্যে ‘জীবন’-কেই লায়লা বা লায়লার মতো অসংখ্য শ্রমিক নারী ‘দাও’-এ লাগিয়েছে। দেখাই যাক শেষ পর্যন্ত কী হয়, বেঁচে থাকতে হলে পেটের খোরাক জোগাতে হবে, করোনায় মারা না গেলে ‘ক্ষুধা’য় মারা যেতে হবে- এই সমীকরণ লায়লাকে আরও কঠিন করে তুলছে তাতে কোনোই সন্দেহ নেই।
দুই.
লায়লা বাংলাদেশের গ্রামের মেয়ে, তার সঙ্গে নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত চুল কাটার সেলুনে কাজ করা ডরোথির অবস্থার যে বর্ণনা পাওয়া যায় তাতে কোনোই পার্থক্য আমরা খুঁজে পাই না। নিউ ইয়র্কে বলতে গেলে প্রতিটি বাড়িতে মৃত্যু হানা দিয়েছে করোনার কারণে। প্রায় ১০ হাজারের কাছাকাছি মৃতের সংখ্যা নিয়ে নিউ ইয়র্কে ডরোথির মতো ‘দিন এনে দিন খাওয়া’ মানুষের কাজে না বেরিয়ে উপায় নেই। কারণ, সরকার তাকে যতটুকু সাহায্য করার করেছে, এর বাইরে তাকে সহযোগিতা করার কেউ নেই, কাজ না করলে ভাতা পাওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ, ফলে ‘সিঙ্গেল মাদার’ ডরোথির সামনে আর কোনও পথ খোলা নেই কাজে না গিয়ে। কিন্তু কাজে গেলে যে তাকে প্রতিদিন অন্তত দশজন গ্রাহককে চুল কেটে দিতে হবে, তাদের কাছ থেকে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা তৈরি হবে, সে ঝুঁকি ডরোথিকে নিতেই হবে।
একই অবস্থা ব্রিটেন, জার্মানি, ইতালি কিংবা স্পেনের ‘দিন এনে দিন খাওয়া’ মানুষগুলোর, অবস্থার ভিন্নতা সামান্যই। করোনাভাইরাস আক্রান্ত পৃথিবীর এই রূঢ় বাস্তবতা এড়ানোর সামর্থ্য নেই। তাই দেশে দেশে ‘লক ডাউন’ শিথিল করার তোড়জোড় শুরু হয়েছে। যদিও জানা নেই যে এই শিথিলতা নতুন কোনও বিপর্যয় ডেকে আনবে কিনা। বিশেষ করে যুক্তরাজ্যের মতো দেশে যেখানে করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা ঊর্ধ্বমান (আজকেও এই সংখ্যা প্রায় ৭০০) সেখানে আগামী সপ্তাহ থেকে ‘লকডাউন’ শিথিল করার যে পরিকল্পনা সরকার করছে তা নিঃসন্দেহে বড় ধরনের ‘বিপদ’ ডেকে আনবে বলে ‘করোনা বিশেষজ্ঞরা’ মনে করছেন। যদিও কোনও বিশেষ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে এখনও পর্যন্ত সত্যিকার অর্থে ‘করোনা বিশেষজ্ঞ’ বলা যাচ্ছে না, সবাই একটি ধারণাভিত্তিক পর্যবেক্ষণ দিয়ে চলেছেন সর্বত্র, যা সত্যিকার অর্থেই কার্যকর কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে। বিশেষ করে লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের ‘মহামারি বিশেষজ্ঞ’ নিল ফার্গুসন এতদিন ধরে যে সংখ্যাতত্ত্ব দিয়ে করোনা-মহামারির প্রকোপকে ব্যাখ্যা করছিলেন তাও এখনও সর্বাত্মকভাবে প্রমাণিত নয়। এদিকে ফ্রান্সের মতো শক্ত অর্থনীতির দেশও এখন ৬% অর্থনৈতিক সক্ষমতা হারিয়ে করোনার কারণে ‘লকডাউনজনিত ক্ষতি’ পুষিয়ে নিতে লকডাউন শিথিল করার ঘোষণা দিলেও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে ‘খেতে’ দিতে পারছে না, ফলে প্যারিসের শহরতলির গরিব এলাকায় পুলিশের সঙ্গে নিরন্ন মানুষের সংঘর্ষ বাধছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ দৃশ্য এখন ফ্রান্সের রাজধানীতে দেখা গেলেও অচিরেই তা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রাজধানীতে ছড়িয়ে পড়বে। তাহলে এতদিন ধনী দেশগুলোর গর্বের ভিত্তি কি ছিল? এখন এই প্রশ্ন তোলা বারণ।
বাংলাদেশ গরিব দেশ, কিন্তু মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার দাবিদার। সরকারের পক্ষ থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় বাংলাদেশকে ‘সিঙ্গাপুর কিংবা মালয়েশিয়া’ হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা অত্যন্ত দৃষ্টিকটু হলেও সরকারের চেষ্টা ছিল বাংলাদেশের অবস্থা পরিবর্তনের, বিশেষ করে অর্থনৈতিক অবস্থার, সে কথা মানতেই হবে। করোনাভাইরাস আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে দেশের মানুষের জন্য অর্থনৈতিক সহযোগিতায় সরকারের বাড়ানো হাতও প্রশংসার দাবি রাখে। এখন প্রশ্ন জাগে, এই সহযোগিতা কতদিন অব্যাহত রাখা যাবে? কতদিন পর্যন্ত মানুষকে খাদ্য জোগান দেওয়া যাবে? কতদিন মানুষকে ‘কাজ না করিয়ে বসিয়ে’ রাখা যাবে? এবং তারপর কী? এসব প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট কোনও উত্তর নেই। কারণ কোনও দেশেই এখনও পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যায়নি যে করোনা সংক্রমণ একেবারে বন্ধ হলো কিনা কিংবা করোনা সংক্রমণ কমলেও তা ফিরে আসবে কিনা। চীনের অভিজ্ঞতার ওপর কেউই তেমন ভরসা করতে পারছেন না। এমতাবস্থায় বাংলাদেশে ‘জীবন’কে লকডাউনে রেখে ‘জীবিকাকে’ খুলে দেওয়ার যে প্রবণতা লক্ষমান তা অব্যাহত সমালোচনার মুখে পড়াটাই স্বাভাবিক, যেমনটি পশ্চিমেও একাধিক সরকারকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে। তবে কেউ কেউ যে এই প্রচেষ্টার প্রশংসা করছেন না তা নয়। যুক্তরাজ্যের মতো দেশে যেখানে অর্থনীতি ১৪% পিছিয়ে পড়ছে সেখানে অতি দ্রুত মানুষকে ‘কাজে ফিরিয়ে’ না নিতে পারলে আগামী মাস থেকেই মানুষকে ‘খেতে দিতে’ না পারার দায়ে সরকারকে দোষী হতে হবে, সে হিসাব সরকারের অর্থনীতি বিষয়ক পরামর্শদাতারা খুব ভালোভাবে বুঝতে পেরেছেন বলেই আজ কিংবা কালকের মধ্যেই একটা ‘পথ’ (ওয়ে-আউট) ঘোষিত হতে যাচ্ছে ধাপে ধাপে লকডাউন তুলে নেওয়ার। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও বিষয়টি ‘ধাপে ধাপে’ হওয়াটা জরুরি, যাতে মানুষের ‘জীবন’ বিপন্ন না হয়, এবং ‘জীবিকা’র পথটিও খোলা থাকে। জীবন কিংবা জীবিকা- একটির জন্য আরেকটিকে ছাড় বা আড় কোনোটিই দেওয়া যায় না, এটাই বাস্তবতা, কিন্তু এই বাস্তবতাকে সঠিক ভারসাম্য দেওয়ারও কোনও বাস্তবানুগ উদাহরণ কেউ এখনও দেখাতে পারেনি, না ধনী দেশ, না দরিদ্র দেশ, কেউই নয়।-লেখক: সাংবাদিক