কাউয়ামুক্ত লীগ, জামায়াতমুক্ত বিএনপি, জঙ্গিমুক্ত দেশ চায় মানুষ-পীর হাবিব
পীর হাবিবুর রহমান।।
কাউয়ামুক্ত আওয়ামী লীগ, জামায়াতমুক্ত বিএনপি ও জঙ্গিমুক্ত বাংলাদেশ আজ মানুষের প্রত্যাশার জায়গায় দাঁড়িয়েছে। উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের শাসনামলের টানা সাড়ে ৮ বছরে সুবিধাবাদী, মতলববাজ যে শ্রেণীটি ক্ষমতার পাদপ্রদীপে জায়গা করে নিজেদের আখের গোছাতে গিয়ে সরকার ও দলের ইমেজে আঁচড় বসাচ্ছে, তাদেরকে হাইব্রিড ও কাউয়া বলে দলের নেতা ও কর্মীরা কখনো রুখতে বলেছেন, কখনোবা তাড়াতে বলেছেন। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এই সুবিধাভোগী বিতর্কিতদের সাম্প্রতিক সময়ে যেভাবে কাউয়া বলেছেন, তেমনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও কাউয়া বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন।
দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অনেক উত্থান পতন ঘটে গেছে। রাজনীতির নদীপথে জল অনেক গড়িয়েছে। ক্ষমতার নানামুখী পালাবদল ঘটেছে। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের আশ্রয় নিয়ে সুবিধাবাদী যারা নিজেদের আখের গোছায় তাদেরকে সেকালে বঙ্গবন্ধু, একালে ওবায়দুল কাদের কাউয়া বললেও, নাটোরের আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট সাজেদুর রহমান খান হাইব্রিড বলে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু সেকালে যেমন কাউয়া ও হাইব্রিডদের উপদ্রব কোন শাসক তাড়াতে পারেননি, তেমনি একালেও পারছেন না। কাউয়াদের উপদ্রব দিনে দিনে বাড়ছে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান জন্মের পর প্রথমে ছাত্রলীগ ও পরে কারাগার থেকে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠার সঙ্গেই জড়িত হননি। নিজের ক্যারিশমা, সাহস, সাংগঠনিক দক্ষতা ও লক্ষ্য অর্জনে দৃঢ়চিত্তের সংগ্রামমুখর নেতৃত্বের গুণে ঘাত-প্রতিঘাত, জেল, জুলুম, ফাঁসির মঞ্চ তোয়াক্কা না করে দীর্ঘ সংগ্রামের ভিতর দিয়ে আওয়ামী লীগকে তৃণমূল বিস্তৃত বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় জনপ্রিয় শক্তিশালী রাজনৈতিক দলেই পরিণত করেননি। স্বাধীকার, স্বাধীনতার পথে ৭০ এর গণরায় নিয়ে এই দলের নেতৃত্ব সুমহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
স্বাধীনতা উত্তর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে একদিকে পরাজিত আন্তর্জাতিক মোড়লদের ষড়যন্ত্র, সর্বহারার বিপ্লব ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে কিংবা মাও সেতুংয়ের লাল বিপ্লবের তুফান তুলে উগ্র-রোমান্টিক, হটকারী অন্ধকার রাজনীতির খেলা শুরু হয়েছিল। তেমনি বঙ্গবন্ধুর পিতৃহৃদয়ের উদার, কোমল হৃদয়ের সুযোগ নিয়ে এই গোষ্ঠীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরেও একটি সুবিধাভোগী, মতলববাজ চক্রের উন্মাসিকতা দৃশ্যমান হয়েছিল। আরেকপক্ষ মস্কোর ছাতা ধরে সরকারের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য রাখতে গিয়ে কার্যকর বিরোধীদলের ভূমিকা পালনে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দেন। সব মিলিয়ে গভীর অন্ধকার, অমাবস্যার আঁধার নেমেছিল স্বাধীন বাংলাদেশে।
৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের প্রেক্ষাপটে পরিবার পরিজনসহ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন। মানবসভ্যতার ইতিহাসের এই বর্বোরচিত হত্যাকাণ্ডের পথ ধরে আওয়ামী লীগের শীর্ষপর্যায়ের ৪ নেতাকে জেলখানার অভ্যন্তরে হত্যা করাই হয়নি; দলের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে মামলা আর কারাদহন দীর্ঘদিন ভোগ করতে হয়েছে। অনেককে নির্বাসিত জীবন বেছে নিতে হয়েছে। ৭৫ উত্তর দুঃসময়ে সেই সুবিধাভোগী কাউয়াদের খুঁজেও পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত রাষ্ট্রীয় মূলনীতি নির্বাসিত হয়েছিল সংবিধান, রাষ্ট্র পরিচালনা রাজনীতি থেকে।
সেনাশাসন কবলিত বাংলাদেশে খুনিদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা মিললেও আওয়ামী লীগের রাজনীতির জন্য ছিল স্রোতের বিপরীতে দীর্ঘ সাঁতার কাটার মতো। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দীর্ঘ সংগ্রামের পথ ধরে ৯৬ সালে একুশ বছর পর গণরায় নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল আওয়ামী লীগ। গণতন্ত্রের সেই নবযাত্রায় উত্তম শাসন দিলেও কাউয়াদের প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল। ২০০১ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পর শেখ হাসিনা নেতাকর্মীদের লাশের কফিন টেনেছেন। মামলা ও অত্যাচারের ক্ষতচিহ্ন শরীরে নিয়ে আসা কর্মীদের চিকিৎসা ও আইনী সহায়তা দিয়েছেন। অন্যদিকে, নতুন করে আন্দোলনের ফুল ফুটিয়েছেন তপ্ত পাথরের মধ্যে। সেই দুঃসময়েও ক্ষমতাকালীন সুবিধাভোগী কাউয়াদের পাশে পাননি, পাশে পাননি ওয়ান ইলেভের দুর্যোগকালীন সময়েও।
বিএনপি-জামায়াত শাসনামলের দগদগে ক্ষত এবং ওয়ান ইলেভেনের কঠিন বিপর্যয় মোকাবিলা করে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে দলকে পুনরায় ক্ষমতায় নিয়ে এলে এবার কাউয়াদের উপদ্রব চরম আকার দেখা দেয়। দিনে দিনে গোটা দেশ আওয়ামী লীগ হয়ে গেছে। যতদূর চোখ যায়, শুধু আওয়ামী লীগ আর আওয়ামী লীগ। এত আওয়ামী লীগ সেনাশাসন জামানায়, বিএনপি-জামায়াত জামানায় কিংবা ওয়ান ইলেভেনের দুঃসময়ে কোথাও দেখা যায়নি। বানের স্রোতের মতো ভেসে আসা কচুরিপানার মতো আওয়ামী লীগ আর আওয়ামী লীগ। সাজেদুর রহমান খান বলেছিলেন হাইব্রিড, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবার বলেছেন কাউয়া। এই কাউয়ারা শেখ হাসিনার ব্যাপক উন্নয়ন কর্মযজ্ঞকে দুর্নীতির পথে ব্যাংক লুট, শেয়ার কেলেংকারি এমনকি দলীয় পর্যায়ে ইউপি নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্যের কলংক মাথায় নিয়ে দলকে বিতর্কিতই করছেন না, সাংগঠনিক শৃঙ্খলা, আদর্শিক গণমূখী চরিত্র হারাচ্ছেন। এমনি পরিস্থিতিতে দলের তৃণমূল বিস্তৃত লাখো কর্মীর হৃদয় স্পর্শ করেছে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের আকুতি। কাউয়ামুক্ত আওয়ামী লীগ চান তারা।
২. পচাত্তরের রক্তাক্ত বিভীষিকাময় রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সামরিক ক্যু, পাল্টা ক্যুর ভেতর দিয়ে সেনাশাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে বিএনপি নামের রাজনৈতিক দলটি গঠন করে ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করেছিলেন। একাত্তরের পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর দোসর স্বাধীনতা উত্তর নিষিদ্ধ, ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে রাজনীতি করার অধিকার দিয়েছিলেন। নাগরিকত্ব বাতিল হওয়া জামায়াতের আমির গোলাম আজমকে দেশে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ দিয়েছিলেন। চীনাপন্থি ন্যাপ ও দক্ষিণপন্থী মুসলিম লীগারদের সঙ্গে সমাজে প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ বিরোধী বিশিষ্টজনদের টেনে নিয়ে এই দল গঠন করেছিলেন। স্বাধীনতা বিরোধীদের টানায় এবং নিষিদ্ধ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজনীতি করার অধিকার ফিরিয়ে দেয়ায় জন্মলগ্ন থেকে বিএনপি নেতৃত্ব মুক্তিযুদ্ধের গৌরবের উত্তরাধিকারিত্ব বহন করা, জনগণের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তিগুলোর কাছে কখনো সমালোচিত, কখনো নিন্দিত। দলের অভ্যন্তরেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ বিপক্ষের অভ্যন্তরীণ বিভক্তি শুরু থেকেই ছিল। ছোট আকারে হলেও এখনো সেটি রয়েছে।
৮১ সালে চট্টগ্রামের সেনাবিদ্রোহে প্রেসিডেন্ট জিয়া নিহত হন। বিচারপতি সাত্তারের আমলে বিএনপি সরকারের অভ্যন্তরে চরম কোন্দল, রাষ্ট্র পরিচালনায় নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি, আইন শৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটায় রক্তপাতহীন অভ্যুন্থানে সেনাশাসক এরশাদ ক্ষমতায় আসেন। বিএনপিতে ভাঙনই দেখা দেয়নি; কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যায়ে বিএনপির নেতারা এরশাদের সঙ্গে যোগ দেন। যুক্ত হন জাতীয় পার্টিতে। সেনাশাসক জিয়ার শাসনামলে সারা দেশজুড়ে বিএনপির যে রমরমা অবস্থা ছিল, সেখানে ভাঁটা পরে। ভঙ্গুর, দুর্বল বিএনপির নেতৃত্বে অভিষিক্ত হন অকাল বৈধব্যের শিকার বেগম খালেদা জিয়া। সারা দেশের শিক্ষাঙ্গনে সেনাশাসন বিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদল অপ্রতিরোধ্য, শক্তিশালী ছাত্র সংগঠনে পরিণত হয়ে উঠে। ছাত্রদলের উত্থানে দুই সহোদর ছানাউল হক নীরু ও বাবলু ব্যাপক জনপ্রিয়তা নিয়ে উঠে আসেন। বাবলু নিহত হলেও ছাত্রদলের শক্তিক্ষয় ঘটেনি। স্বশস্ত্র ক্যাডারনির্ভর রাজনীতিতে ছাত্রদল শক্তিশালী হয়ে উঠলে শিক্ষাঙ্গনগুলোতে ফ্যাশন সচেতন, স্মার্ট, তারুণ্যের শক্তি যুক্ত হয়। ছাত্রদলের ওপর ভর করেই বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া সেনাশাসন বিরোধী আন্দোলনে নিজের ইমেজ ও আপোসহীন নেত্রীর তকমা নিয়ে উঠে আসেন।
সেনাশাসনের অবসানের মধ্য দিয়ে ৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে একটি ভঙ্গুর দলকে সকল হিসাব নিকাশ পাল্টে দিয়ে ক্ষমতায় নিয়ে আসেন খালেদা জিয়া। সেই সময় জামায়াতের ১৮টি আসন লাভ ছিল বিস্ময়কর। জামায়াতের সমর্থন নিয়ে বিএনপি সরকার গঠন করলেও তাদের সঙ্গে জামায়াত যোগ দেয়নি। সংসদে দু’টি নারী আসন নিলেও জামায়াত পরবর্তীতে তত্তাবধায়ক সরকারের আন্দোলনে যুক্ত হয়। ৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলেও বেগম খালেদা জিয়া নেতৃত্বে বিএনপি ১১৬ টি আসন নিয়ে শক্তিশালী বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। পরবর্তীতে জাতীয় পার্টি, জামায়াত ও ইসলামী ঐক্যজোট নিয়ে সরকার বিরোধী আন্দোলন ও নির্বাচনী জোট করে সেই জোট থেকে এরশাদকে বেরিয়ে যেতে হলেও জামায়াত বিএনিপর ওপর শক্তিশালী প্রভাব বিস্তার করে। ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতাসীন বিএনপি জোটের অংশীদারিত্ব পায় জামায়াত। ৭১ এর মানবতা বিরোধী অপরাধে ফাঁসিতে দণ্ডিত মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুজাহিদ মন্ত্রী হন।
অন্যদিকে, ৯১ সালে বিএনপি জামায়াতের সমর্থনে সরকার গঠন করলেও শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রদলের প্রভাব কমতে থাকে, উল্টোপথে ছাত্র শিবিরের সাংগঠনিক শক্তি বাড়তে থাকে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণও তারা নিয়ে নেয়। ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার মধ্য দিয়ে দেশে ৭১ এর পরাজিত রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতাই বাড়েনি, একুশের গ্রেনেড হামলা জেমবিসহ জঙ্গিবাদী সংগঠন, বোমা, সন্ত্রাস ও আওয়ামী লীগ দলীয় রাজনৈতিক নেতাদের হত্যার ঘটনা ঘটতে থাকে। প্রশ্রয় পায় ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি। দশ ট্রাক অস্ত্রের চালান আটক হওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলা ভাইদের প্রকাশ্য আস্ফালনের নেপথ্যে বিএনপি-জামায়াত সরকারের আভ্যন্তরীণ প্রশ্রয়ের অভিযোগ উঠে। এক্ষেত্রে জামায়াতের সঙ্গে সরকার গঠন করার কারণে বিএনপিকে ওই দলটি গিলে খাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জামায়াতকে রাজনৈতিক মিত্র করে পথ চলায় বিএনপি নেতৃত্ব সমালোচনার তীরে ক্ষত বিক্ষত হতে থাকে।
ওয়ান ইলেভেনে এসে জামায়াতকে স্পর্শ না করলেও বিএনপির কোমড় ভেঙে দেয়, কিন্তু ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি নেতাদের অনেকেই অংশগ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করলেও জামায়েতের চাপের কাছে হার মেনে বিএনপিকে নির্বাচনে গিয়ে করুণ পরাজয় দেখতে হয়। ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ ৭১ এর মানবতা বিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসিতে ঝুলালেও বিএনপি তাদের সঙ্গ ছাড়তে পারেনি। জাতীয়-আন্তজার্তিক বিতর্কের মুখে যদি বলছে, জামায়াত তাদের নির্বাচনী অংশীদার; আদর্শিক নয়। কিন্তু একাত্তরের মানবতা বিরোধী বিচার প্রশ্নে ঘাতকদের পক্ষে শুরুতে সুর তুললেও পরবর্তীতে দলের ভেতরে বাইরে থেকে চাপের মুখে পরেও নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেনি। বিএনপিকে যারা ডান নয়, বাম নয়; মধ্যমপন্থী একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসাবে দেখতে চেয়েছেন তাদের আকুতি দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করতে পারেনি। তাই শত বিতর্কের মুখেও জামায়াতই এখনো বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৯ দলীয় জোটের প্রধান শরিক। দলের অগণিত নেতাকর্মীই নন, শুভাকাঙ্খীরাও জনগণের আবেগ অনুভূতিকে লালন করে জামায়াতের প্রভাবমুক্ত হবার তাগিদ দিলেও বিএনপি নেতৃত্ব সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারছে না। তারা ছেড়ে দিলেই আওয়ামী লীগ নিয়ে নেবে-এমন অভিযোগ মাঝে মধ্যেই বিএনপি নেতাদের কেউ কেউ বললেও জামায়াতমুক্ত হবার কোনো ইচ্ছা বা আগ্রহ কেউ দেখাতে পারেননি। অথচ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের যে শক্তিটি বিএনপির ভিতরে-বাইরে, কর্মী, সমর্থক, শুভাকাঙ্খী হিসাবে রয়েছে, তারা চায় জামায়াতমুক্ত বিএনপি।
৩. গোটা বিশ্ব রাজনীতি ধর্মের নামে সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ, আল কায়েদা, আইএসের ব্যানারে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে, সেখানে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক অবস্থাকেও অস্থির করে তুলেছে। ঢাকায়ও গুলশান হলি আর্টিজান ট্রাজেডির মতো রক্তাক্ত ঘটনা ঘটে গেছে। সরকার ও জনগণ জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স গ্রহণ করায় জাতীয় ও আন্তজার্তিকভাবে বিষয়টি প্রশংসিতই হচ্ছে না; এটির পক্ষে ব্যাপক জনসমর্থন রয়েছে। পৃথিবীর ২য় বৃহত্তম মুসলিম দেশ হলেও বাংলাদেশের মূলভিত্তি সুমহান মুক্তিযুদ্ধ। যেখানে পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক, ধর্মান্ধ রাজনীতির নামে শোষণের পরাজয় ঘটেছিল। তাদের দোসরদের করুণ পরিণতি ঘটেছে। ব্যালট বিপ্লবে দূরে থাক, কোনো পথেই ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তি জনসমর্থন যেমন নিতে পারেনি, তেমনি রাজনৈতিকভাবে পারেনি নিজেদের উত্থান ঘটাতে। এদেশের জনগণ ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে মুক্তিযুদ্ধে জীবন দিয়েছে। গণতন্ত্রের সংগ্রামে রক্ত দিয়েছে।
কোনো ধরণের উগ্রতা গ্রহণযোগ্যতা পায়নি বলেই সর্বহারার বিপ্লব, শ্রেণী সংগ্রাম বা সমাজতন্ত্রের নামে উগ্রপন্থিদের হটকারী বিপ্লবের পথ যেমন পরাস্ত হয়েছে, তেমনি রাজনীতিতে তাদেরকে জনসমর্থন হারিয়ে দেউলিয়াত্ব বরণ করতে হয়েছে। এখানে নাস্তিকতার নামে মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত যেমন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি, সমকামিতার অধিকার মাথা তুলতে পারেনি; তেমনি নানা সময়ে হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের উপসনালয়ে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ নিন্দিত ও ঘৃণিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত বাংলাদেশে যেমন সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তি ভোটযুদ্ধে গণরায় নিতে পারেনি, তেমনি ধর্মের নামে, জেহাদের নামে জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাসবাদের পথ জনগণ প্রশ্রয় দেয়নি। এমনকি অন্ধকার জঙ্গিবাদী তৎপরতায় গিয়ে যারা নিহত হয়েছে তাদের লাশ পর্যন্ত পরিবার গ্রহণ করেনি। এদেশের জনগণ সুমহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবের উত্তরাধিকারিত্ব বহন করে একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, শোষণমুক্ত রাষ্ট্র হিসাবেই দেশকে দেখতে চায়। জঙ্গিবাদমুক্ত বাংলাদেশ চায়।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সিনিয়র সাংবাদিক