‘কান খুলে শুনে রাখুন, আমরা কোথাও যাচ্ছি না’
তিনি লিখেছেন,
“আমরা অবশ্যই প্রচন্ড উদ্বিগ্ন, আর বড় ধরণের একটি আঘাত পেয়েছি। আপনারা যারা এই লেখাটি পড়ছেন তাদের অনেকের মত আমার মধ্যেও একটি অস্বস্তিকর আর দুঃখজনক অনুভূতি কাজ করছে যে আমার এই দেশটি আর নিরাপদ নেই। যেই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আমার বেড়ে ওঠা, ঠিক সেখানেই আমার বাবার ওপর হত্যাচেষ্টা চালানো হয়েছে। গতকাল আমার চেয়ে বয়সে ছোট এক বন্ধু আমাকে জিজ্ঞেস করছিল, ‘কেন ইয়েশিম আপু? এসব কিছু ঘটার পরও কেন তোমরা এই দেশে থাকবে?’ সঙ্গত কারণেই বোঝা যায়, অধিকাংশ মানুষই বর্তমানে দেশের অবস্থা ও হালচাল নিয়ে হতাশাগ্রস্ত। কিন্তু আমার কাছে আমার পরিবার এই দেশ ছেড়ে চলে যাবে কিনা তা জানতে চাওয়ার মানে হলো, আমার বাবা তাঁর কাজে ব্যর্থ হয়েছেন, আমরা তাঁকে ব্যর্থ করেছি।
তারপরও…
কিছু কথা আমি আপনাদের সবাইকে বলতে চাই। সত্যি বলতে কি, আমি এতটাই অলস যে হয়ত আমার বাবার কিছু কথাই এখন চুরি করব। কারণ আমি খুব ভালো করেই জানি যে তিনি পরিপূর্ণ সুস্থ হয়ে যখন আবার আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন, তখন ঠিক কোন কথাগুলি উচ্চারণ করবেন। দেখুন, আপনাদের হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। যেই জিনিসগুলি আপনাদের পছন্দের ও ভালো লাগার, সেগুলির জন্য আপনারা কখনোই লড়াই করা থামিয়ে দিতে পারেন না। এবং সেই দেশটির জন্য, যেই দেশে বাস করার স্বপ্ন আপনারা দেখেন, কিন্তু এখন পর্যন্ত তা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। কোন কিছুই সহজে পাওয়া যায় না। আজকের পৃথিবীতে আপনি যেসব জিনিস উপভোগ করছেন তার প্রতিটিই – স্বাধীন ব্যক্তি হিসেবে রাস্তার উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া, ক্ষুধা লাগলে খেতে পারা, অসুস্থ হলে চিকিৎসকের কাছে যেতে পারা, স্কুলে যাওয়ার অধিকার লাভ করা, ভোটাধিকার লাভ করা, এমন কোন কাজ করতে পারা যেখানে আপনাকে যোগ্য সম্মানী দেয়া হয়, এমনকি স্রেফ রিকশায় চড়ে ঘুরতে পারা এবং আপনার পেটে সমস্যা হতে পারে জেনেও ফুচকা খেতে পারা। এরকম প্রত্যেকটি জিনিসের জন্যই কেউ না কেউ একসময় যুদ্ধ করেছে, যে কারণে আজ আপনি নির্বিঘ্নে সেই কাজগুলি করতে পারছেন। কোন না কোন মানুষ এগুলির জন্য লড়াই করেছে; একটু একটু করে, ধাপে ধাপে, দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। হ্যাঁ, আমার বাবা-মায়ের মত মানুষেরা যেমন, তেমনি আমার এবং আপনার মত মানুষেরাও। এখন এটি শুধু আমাদের অধিকারই না, পাশাপাশি দায়িত্বও এইসব সুযোগের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অংশকে নিজেদের মত করে উপভোগ করা। এবং আমাদের আরও দায়িত্ব সেইসব জিনিসের জন্য লড়াই চালিয়ে যাওয়া, যেগুলি এখন পর্যন্ত আমরা পাইনি। সম্ভবত আমাদের বাচ্চাকাচ্চারা একদিন সেগুলি পাবে।
যখন বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে যায়, পরিস্থিতি অসম্ভব হয়ে পড়ে, তখন আপনারা চিৎকার করে কাঁদতে চান, বুকের ভেতরে পুঞ্জীভূত ক্ষোভের উদ্গীরণ ঘটাতে চান। আমি এটি জানি, কারণ আমি নিজেও এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গিয়েছি। কিন্তু এমন অবস্থায় আপনি কখনোই পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করবেন না। আপনি একটি নিঃশ্বাস নেবেন। খুব দীর্ঘ ও গভীর নিঃশ্বাস। তারপর আপনি চারপাশে তাকাবেন। একটি একটি করে সেইসব উদ্দীপনাগুলিকে সংগ্রহ করবেন, যেগুলিকে হয়ত আপনি নিজেই চলার পথে কোন এক জায়গায় ভুলবশত ফেলে এসেছিলেন। তারপর আপনি আপনার চিবুক উঁচু করে, শিরদাঁড়া সোজা করে সামনের দিকে তাকাবেন, পরবর্তী লক্ষ্য নির্ধারণ করবেন।
আমি খুব ভালো করেই জানি যে আজ আমি এইসব বলতে পারছি তার একটি প্রধান কারণ হলো আমার বাবা জীবিত ও সুস্থ আছেন, এবং ইতিমধ্যেই চিন্তাভাবনা শুরু করে দিয়েছেন তিনি কীভাবে এই সেমিস্টারের পাঁচটি কোর্সের পাঠদান সম্পন্ন করবেন। আমি এক মুহূর্ত নিতে চাই সেইসব মানুষদের পরিবার ও বন্ধুদের কথা চিন্তা করতে, যারা এই একই যুদ্ধে তাদের প্রাণ হারিয়েছেন। এমন অনেক মেয়েই আছেন যাদের বাবা আর নেই, কিংবা এখনও সেরে ওঠেননি। আমি আপনাদের কথাও ভাবছি। আমি এই দেশে বাস করি, তার কারণ আমি এই দেশকে পছন্দ করি। আমার কাছে এই দেশটি এইসব ঘটনার মত কদর্য নয়। দেশ কখনও কদর্য হতে পারে না। কদর্য তো সেইসব মানুষেরা যারা এগুলি ঘটাচ্ছে। এবং খুব তাড়াতাড়িই আমাদেরকে এদের মোকাবিলা করতে হবে। এইসব মানুষেরা আঁচিলের মত, কিংবা ফাঙ্গাসের মত। তারা এতটা বেড়েছে, কারণ আমরা তাদের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিতে পারিনি। এখন আমাদের প্রয়োজন তাদেরকে উৎখাত করা।
কিন্তু এই দেশটি কেমন, তা তারা সংজ্ঞায়িত করে না। এই দেশ তাদের নয়। এই দেশ হলো সেইসব অসাধারণ স্বেচ্ছাসেবীর, যাদের সাথে আমি কাজ করি ‘কান পেতে রই’-তে। এই দেশ হলো সপ্তাহের যেকোন দিনে ছায়ানট থেকে শিল্পকলায় ভ্রমণের। এই দেশ হলো সেইসব অনবদ্য বিজ্ঞান, শিল্প ও সাহিত্যের, আমাদের দেশের মানুষ অতীতে বহু ঝড়-ঝঞ্ঝা পার করে এসেও যা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। এই দেশ হলো সেইসব বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের, যাদের সাথে কথা বলে আমি কেবল সম্মানিতই বোধ করি না, অনেক কিছু শিখতেও পারি। এই দেশ আমার বাবা-মায়ের সেইসব তরুণ সহকর্মীদের, যারা ডিনার টেবিলে বসেও পরিকল্পনা করতে থাকেন কীভাবে তাদের পরের প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের জন্য ভালো কিছুর বন্দোবস্ত করা যায়। এই দেশ হলো সেইসব বন্ধুদের, যারা আমাকে জোরাজুরি করে ছোট মাছের কাবাব বানাতে, কারণ সুস্থ শিশুর জন্য এটি খুবই দরকারি। এবং এই দেশ আমার বাবা-মায়ের, যারা এই দেশ ছেড়ে কোথাও যাচ্ছেন না। আমি অনেক অনেক কৃতজ্ঞ। বিশেষ করে সেইসব মানুষের কাছে, যারা ওই ঘটনার পর দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নিয়েছেন, নিজেদের নিরাপত্তার কথা একবারের জন্যও চিন্তা করেননি, বরং চিন্তা করেছেন কীভাবে আমার বাবাকে সুস্থ করে তোলা যায়। আপনাদেরকে ধন্যবাদ। দেশব্যাপী যারা প্রতিবাদ কর্মসূচি চালাচ্ছেন, আপনাদেরকে ধন্যবাদ। আপনাদের স্লোগানের ধ্বনি আমাকে শক্তি যোগায়। আপনারা যারা আমার ও আমার পরিবারকে গত কয়েকদিনে ভালোবাসার সাগরে ভাসিয়েছেন, আপনাদেরকে ধন্যবাদ। আপনাদেরকেই এই মুহূর্তে আমার খুব দরকার। আবারও কান খুলে শুনে রাখুন। আমরা কোথাও যাচ্ছি না।”
সূত্র: এগিয়ে চলো