কার সম্পদ কে খায়
কামরুল হাসান::ঢাকা শহরে অর্ধশত কোটি টাকার ওপরে সম্পদ। তা-ও নগরের কেন্দ্রস্থলে পল্টন, হাতিরপুল, এলিফ্যান্ট রোডে। এই সম্পদ নিয়ে দুই পক্ষ মুখোমুখি। অথচ এসব সম্পদ তাঁদের কারোরই উপার্জিত বা বংশানুক্রমিক ধারায় পাওয়া নয়। যে ব্যক্তি এই সম্পদের মালিক, তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক থাকার কথা দুই পক্ষের কেউই প্রকাশ্যে স্বীকার করতে চান না।
সম্পদশালী এই ব্যক্তি একসময় ঢাকা শহর দাপিয়ে বেড়াতেন। চলতেন দলেবলে গাড়ি হাঁকিয়ে, আগে-পিছে অস্ত্রসমেত পাহারা নিয়ে। বছরে দু-তিনবার গ্রেপ্তার হয়ে সংবাদপত্রের শিরোনামও হতেন। তাঁর রাজনৈতিক পরিচয় ছিল, শুধু ছিল না সামাজিক স্বীকৃতি। বাবা মুরগির ব্যবসা করতেন, তাই নিজের নামের সঙ্গে দুপেয়ে প্রাণীর নামটি জড়িয়ে যায়। মা-বাবার দেওয়া হুমায়ূন কবির নামটি হারিয়ে যায় ‘মুরগি মিলন’ নামের আড়ালে। আর নিজের অর্জিত সন্ত্রাসী উপাধি যোগ হয়ে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি পরিচিতি পান ‘সন্ত্রাসী মুরগি মিলন’ নামে।
বিভিন্ন মামলার নথি থেকে জানা যায়, সোনা চোরাচালান আর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে বিপুল সম্পদ অর্জন করেছিলেন মুরগি মিলন। এলিফ্যান্ট রোডে দোকান, গার্মেন্টস কারখানা, পল্টনে ফ্ল্যাট, হাতিরপুলে বহুতল বাণিজ্যিক ভবন, আরও কত কী। কিন্তু কিছুই ভোগ করে যেতে পারেননি। রেখে যেতে পারেননি উত্তরাধিকার। এখন সেই সম্পদ চলে গেছে অন্যের হাতে।
গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শুরুতে যেসব সন্ত্রাসী ঢাকা শহর কাঁপাতেন, তাঁদের অনেকেই ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর নিজেদের যুবলীগ-ছাত্রলীগের পরিচয় দিতে শুরু করেন। এঁদেরই একজন মুরগি মিলন। তিনি ছিলেন প্রভাবশালী নেতা মোস্তফা মহসিন মন্টু, হেমায়েত উল্লাহ আওরঙ্গ ও লিয়াকত হোসেনের ঘনিষ্ঠ। অন্য সব সন্ত্রাসীর মতো মিলনেরও পেশা বলতে ছিল সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আর সোনা চোরাচালান। সেই চোরাচালান নিয়ে বিরোধের জের ধরেই প্রতিপক্ষের সন্ত্রাসীরা ২০০০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকার আদালত চত্বরে প্রকাশ্যে তাঁকে গুলি করে হত্যা করে।
হঠাৎ সামনে অন্ধকারের সম্পদ
মিলন নিহত হওয়ার পর তাঁর বিরুদ্ধে থাকা ১৭টি মামলা ও ৩৩টি জিডির তদন্ত একে একে নথিভুক্ত (বিচার স্থগিত) হয়ে যায়। পুলিশও ঝেড়ে-মুছে ফাইল গুটিয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডের ১৪ বছর পর আদালতে দায়ের করা একটি নালিশির মামলা নিয়ে হঠাৎ সবাই নড়েচড়ে বসেন। মামলাটি করেন মিলনের স্ত্রী নাসরিন কবির ওরফে ডলির মা ছালেহা খানম। মামলাটি হয় ২০১৪ সালে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে। এতে বলা হয়, মুরগি মিলন নিহত হওয়ার পর তাঁর স্ত্রী নাসরিন বিয়ে করেন মাহবুবুর রহমান সর্দার নামের এক ব্যক্তিকে। তাঁদের একটি ছেলেসন্তানও রয়েছে। কিন্তু সম্পত্তির লোভে মাহবুবুর রহমান শরীরে বিষাক্ত ইনজেকশন প্রয়োগ করে হত্যা করেন স্ত্রী নাসরিনকে।
নাসরিন কবিরের বাবা আবদুল কাদের খান ছিলেন জেলা জজ। ১৯৮৪ সালের ২৪ আগস্ট মিলনের সঙ্গে নাসরিনের বিয়ে হয়। তাঁরা ১৬ বছর সংসার করলেও কোনো সন্তান ছিল না। মুরগি মিলন নিহত হওয়ার পর তাঁর সব সম্পত্তি চলে যায় স্ত্রী নাসরিনের নিয়ন্ত্রণে। মিলনের তিন ভাই ও এক বোন সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হন।
মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, শরীরে বিষ প্রয়োগের পর ২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর ঢাকার একটি ক্লিনিকে মারা যান নাসরিন। এর ৩৪ দিনের মাথায় কাউকে কিছু না জানিয়ে আদালতের মাধ্যমে সব সম্পত্তি নাবালক সন্তানের নামে হস্তান্তর করিয়ে নেন মাহবুব। এরপর তিনি সেই নাবালকের অভিভাবক হয়ে সব সম্পত্তি ভোগ করতে থাকেন। ভোগ করা সম্পদের মধ্যে পুরানা পল্টনে ফ্ল্যাট ও হাতিরপুলে ইস্টার্ন প্লাজার পাশে বেলভিউ নামে নয়তলা একটি বাণিজ্যিক ভবন আছে, যে ভবন থেকে মাসে আট লাখ টাকা ভাড়া পাওয়া যায়। আদালতে করা মামলায় ছালেহা খানম মাহবুবের ভাই খোকন সর্দার ও নাসরিন যে হাসপাতালে মারা যান, সেই হাসপাতালের চিকিৎসক সালেহ আহমদকেও আসামি করেন।
তদন্ত কী বলছে
ছালেহা খানমের অভিযোগ নিয়ে প্রথমে তদন্তে নামে মোহাম্মদপুর থানার পুলিশ। উপপরিদর্শক জানে আলম মুন্সি অভিযোগ তদন্ত শেষে তথ্য-প্রমাণ না পেয়ে ২০১৫ সালের ৩০ মে আদালতে প্রতিবেদন দেন। সেই প্রতিবেদনের ব্যাপারে নারাজি দেন বাদী ছালেহা। আদালত বাদীর কাগজপত্র পর্যালোচনা করে এটাকে হত্যা মামলা হিসেবে তদন্ত হওয়া সমীচীন বলে মন্তব্য করেন। পরে আদালত কার্যবিধির ২০০ ধারায় তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) নির্দেশ দেন।
পিবিআইয়ের তদন্তে বলা হয়, মামলার বাদী ছালেহা খানম হলেন নাসরিনের বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী। নাসরিনের মা মারা যাওয়ার পর তাঁর বাবা আবদুল কাদের তাঁকে বিয়ে করেন। নাসরিনের আপন দুই ভাই আছেন, পরের মায়ের ঘরে এক ছেলে ও দুই মেয়ের জন্ম হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মুরগি মিলন নিহত হওয়ার পর স্ত্রী নাসরিন তাঁর আপন ছোট ভাই জিয়াউল আলম ও মামা বাবুল মোল্লাকে নিয়ে পুরানা পল্টনের ফ্ল্যাটে বসবাস করতে থাকেন। জিয়াউল এর আগে সুইজারল্যান্ডে ছিলেন, সেখানে থাকার সময় নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানার কাশিপুর গ্রামের মাহবুব রহমান সর্দারের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়। মাহবুব মাঝেমধ্যে নাসরিনের ফ্ল্যাটে আসা-যাওয়া করতে থাকেন। এর মধ্যে জিয়াউল আলম আমেরিকা আর বাবুল ইতালি চলে গেলে নাসরিন একা হয়ে যান। এ অবস্থায় ২০০৫ সালের ১৫ এপ্রিল নাসরিন ও মাহবুব বিয়ে করেন। ২০০৬ সালে তাঁদের পুত্রসন্তান রাইয়ান মাহবুবের জন্ম হয়।
বিষ প্রয়োগে নাসরিনের মৃত্যুর ব্যাপারে আনা অভিযোগ প্রসঙ্গে পিবিআই বলেছে, নাসরিন আগে থেকে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিলেন। পরে তাঁর কিডনিসংক্রান্ত জটিলতা দেখা দেয়। সেই জটিলতায় তাঁকে মোহাম্মদপুরে কেয়ার স্পেশালাইজড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় একদিন তিনি হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। পিবিআই ওই হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করে। তবে ওই সময় নাসরিনের মৃতদেহের সুরতহাল বা ময়নাতদন্ত করা হয়নি। যে চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে, সেই সালেহ আহমদ এখন কিডনি ইনস্টিটিউটে কর্মরত। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, তিনি যা জানেন তা পুলিশকে বলেছিলেন। নাসরিন অনেক জটিল রোগে ভুগছিলেন বলে জানান তিনি।
নাসরিনের মৃত্যু, সম্পদের হাতবদল
নাসরিনের মৃত্যুর পর তাঁর মৃতদেহ নিয়ে মাহবুব মাদারীপুরে নাসরিনের নানির বাড়িতে চলে যান। মাদারীপুরে যাওয়ার পর সেখানকার এটি স্কুলে নাসরিনের ছেলেকে ভর্তি করে দেন মাহবুব। এরপর আদালতে মামলা করে নাবালক সন্তানের পক্ষে সম্পত্তির ডিক্রি নেন। ডিক্রি পাওয়ার পর নাবালকের অভিভাবক হিসেবে তিনি সম্পত্তি ভোগদখলে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হন। সেই থেকে তিনি মুরগি মিলনের সম্পদের দখলদার হয়ে যান। এখনো তিনি এসব সম্পদ ভোগদখল করছেন।
পিবিআইয়ের তদন্তের ব্যাপারে জানতে চাইলে সংস্থাটির প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, পিবিআই অনেক চেষ্টা করেছে। আসলে এটা অনেক দিনের ঘটনা হওয়ায় বাদীর অভিযোগের সপক্ষে সব তথ্য-প্রমাণ জোগাড় করা সম্ভব হয়নি। সে কারণে বাদীর অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি মর্মে আদালতে প্রতিবেদন দেয় পিবিআই। ২০১৮ সালের ১১ মার্চ পিবিআই আদালতে এই প্রতিবেদন দেয়। এরপর আদালত মামলাটি খারিজ করে দেন। ছালেহা খানম সেই আদেশ চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে যান। মামলাটি এখনো হাইকোর্টে চলমান আছে।
কেউ কথা বলেন না
পিবিআইয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে ছালেহা খানমের অভিযোগ প্রমাণিত না হলেও এ ঘটনার খোঁজ করতে গিয়ে বেশ কিছু অস্বাভাবিক ঘটনা চোখে পড়ে। যেমন এ ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে পিবিআই প্রধান সাক্ষী করে নাসরিনের মামা বাবুল মোল্লাকে। তিনি এখন বিদেশে। তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। নাসরিনের আপন দুই ভাই জিয়াউল আলম খান ও মাহাবুব আলম খানও আমেরিকাপ্রবাসী। তাঁদেরও খোঁজ পাওয়া যায়নি। দ্বিতীয় সাক্ষী ছিলেন নাসরিনের আরেক ভাই (দ্বিতীয় মায়ের সন্তান) শফিউল আলম খান ওরফে দিনার। ফোনে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলো কার্যালয়ে আসবেন বলে জানান। পরে জানান, এসব নিয়ে কথা বলতে চান না।
স্বপন কুমার হোড় নামের এক ব্যক্তিকে সাক্ষী করেছিল পিবিআই। স্বপন কুমার জানান, তিনি মুরগি মিলনের বেলভিউ টাওয়ারের ভাড়াটে। মুরগি মিলনের সম্পদ ও তাঁদের পরিবারের ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না। আরেকজন আশরাফুল আলমও বেলভিউ টাওয়ারের ভাড়াটে। কুষ্টিয়ার বাসিন্দা আশরাফুল আলম দাবি করেন, মাহবুবকে তিনি মামা বলে ডাকেন। তিনিও এ নিয়ে কোনো কথা বলতে চান না।
বাদীও একই পথে
মাহবুব ও তাঁর পক্ষের লোকজনের চেয়েও বিস্ময়কর আচরণ করেন মামলার বাদী ছালেহা খানম। তাঁর সঙ্গে কথা বলতে সিদ্ধেশ্বরী লেনের বাসায় গেলে তিনি কোনো কথা বলতে চাননি। বাড়ির দারোয়ানকে বলে দেন, এ ব্যাপারে তাঁরা কোনো কথা বলবেন না। একই অবস্থা মাহবুবের দখলে থাকা বেলভিউ টাওয়ারের লোকজনের। সেখানে খোঁজ নিতে গেলে কর্তব্যরত দারোয়ান খুবই অস্বাভাবিক আচরণ করেন। তিনি এই প্রতিনিধিকে ওই ভবনের ভেতরে যেতেও আপত্তি জানান। বলেন, এটা বাণিজ্যিক ভবন হলেও সবাইকে যেতে দেওয়া হয় না। ওপরে যেতে হলে মালিকের অনুমতি লাগবে। মাহবুবের দখলে থাকা পুরানা পল্টনের শেরেনা অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে খোঁজ করতে চাইলেও সেখানকার দারোয়ান সন্দেহের চোখে আপাদমস্তক দেখে নেন। এরপর মাহবুবকে ফোন করে সব জানান। পরে এই প্রতিনিধি মাহবুব সর্দারের ফোন নম্বর পেয়ে তাঁর সঙ্গে কয়েক দফা যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। তাঁর ছোট ভাই এই মামলার আরেক আসামি খোকন সর্দারের নম্বর পেয়ে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, মাহবুব সর্দার ফোন ব্যবহার করেন না। তিনি নিজেও এ ঘটনা নিয়ে কিছু বলতে পারবেন না। বাদী-বিবাদীসহ দুই পক্ষের সবাই এ নিয়ে রহস্যময় নীরব হলেও নির্মম বাস্তবতা হলো, ত্রাসের রাজত্ব চালিয়ে মিলন যে বিপুল সম্পত্তি করেছিলেন, তা এখন ভোগদখল করছেন অন্য লোক। যাঁদের সঙ্গে তাঁর দূরতম সম্পর্কও ছিল না।-প্রথম আলো