কুলাউড়ায় ট্রেন দুর্ঘটনার জন্য রেল কর্মকর্তারা দায়ী: তদন্ত কমিটি
মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার বরমচাল এলাকায় উপবন এক্সপ্রেস ট্রেন দুর্ঘটনার তদন্ত রিপোর্টে পূর্বাঞ্চল রেলওয়ে প্রকৌশল বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দায়ী করা হয়েছে। সোমবার এ প্রতিবেদন জমা দেয় তদনবত কমিটি। সংস্কারহীন ঝুঁকিপূর্ণ লাইনের কারণেই ওই দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়েছে। এ জন্য পূর্বাঞ্চল রেলওয়ে প্রকৌশল বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী ও গ্যাং ইনচার্জকে দায়ী করা হয়। ওই বিভাগের প্রধান প্রকৌশলীও এ দুর্ঘটনার দায় এড়াতে পারেন না বলেও রিপোর্টে বলা হয়েছে। কিন্তু, একদিন পরই এ চিত্র পাল্টে দেয়ার মতো রিপোর্ট জমা দিয়েছেন খোদ পূর্বাঞ্চল রেলওয়ে প্রধান প্রকৌশলী আবদুল জলিল। তদন্ত রিপোর্ট ও প্রধান প্রকৌশলীর ‘ভিন্ন মতের রিপোর্ট’-এর পর তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে রেলভবনসহ রেলের দু’অঞ্চলে। তাদের রিপোর্টেই কংকাল বেরিয়ে আসছে রেলের। এ নিয়ে খোদ রেলওয়েতে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। রিপোর্টে ভয়ঙ্কর তথ্য বেরিয়ে আসায় বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ মতবিরোধের সৃষ্টি হচ্ছে।
রেলওয়েতে দুর্ঘটনা লাফিয়ে বাড়ছে। লাইন থেকে শুরু করে, ইঞ্জিন, যাত্রীবাহী কোচ, বগিসহ রেলসেতুগুলোর ত্রুটি বেরিয়ে আসছে একের পর এক। একেকটি দুর্ঘটনায় একাধিক তদন্ত কমিটিও গঠিত হচ্ছে। কমিটি তদন্ত প্রতিবেদনও জমা দিচ্ছে, কিন্তু সেই প্রতিবেদন কখনও জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি। রেলের তদন্ত কমিটির রিপোর্ট যেন এক ‘ভয়াবহ গোপনীয়’ রিপোর্ট। যে রিপোর্ট নিয়ে সংশ্লিষ্টদের কেউ কথা বলতে চায় না। ফলে দায়ী ব্যক্তিরা খুব সহজেই আড়াল হয়ে যাচ্ছে। কুলাউড়ায় উপবন এক্সপ্রেন ট্রেন দুর্ঘটনায় তদন্ত কমিটির রিপোর্টও আড়ালের দিকে যাচ্ছে। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট নিয়ে মন্ত্রণালয় তথা রেল বিভাগ ৪ জুলাই সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে গণমাধ্যমকে জানানোর কথা ছিল, সেই তারিখে সংবাদ সম্মেলনটি হচ্ছে না। প্রধান প্রকৌশলীর দেয়া ‘ভিন্নমত’ রিপোর্ট পাওয়ার পর রেলওয়েতে উদ্বেগের সৃষ্টি হচ্ছে।
এ বিষয়ে রেলওয়ে মহাপরিচালক কাজী মো. রফিকুল আলম জানান, কুলাউড়ায় ট্রেন দুর্ঘটনায় আঞ্চলিক পর্যায়ে গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট সোমবার আমার হাতে এসেছে। ওই রিপোর্টে দায়ী করা হয়েছে প্রকৌশল বিভাগকে। কিন্তু, ওই তদন্ত কমিটির প্রথম সদস্য পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান প্রকৌশলী আবদুল জলিল জমাকৃত রিপোর্টটিতে স্বাক্ষর না করে পুরো রিপোর্টের ওপর না রাজি দিয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করেন। মঙ্গলবার দুপুরে প্রকৌশলী আবদুল জলিল তার মতামত প্রকাশ করেছেন। প্রায় ৭ পাতার মতামত প্রকাশে আরও ভয়ঙ্কর তথ্য উঠে এসেছে। তদন্ত রিপোর্ট ও তার বক্তব্যের ওপর আমাদের অনেক কাজ করতে হবে জানিয়ে মহাপরিচালক বলেন, বিষয়টি এখন অন্যদিকে মোড় দিচ্ছে। ভিন্নমতের এ রিপোর্টিতে সে পুরোপুরি মেকানিক্যাল বিভাগকে দায়ী করেছে। ট্রেনের ইঞ্জিন, চাকা, বগির ( চাকার ওপর যে বডি থাকে) ত্রুটির কারণেই নাকি ওই দুর্ঘটনা ঘটেছে। এ দুর্ঘটনার জন্য প্রকৌশল বিভাগ দায়ী নয় জানিয়ে সে আরও বলেছে, দুর্ঘটনাটি পুরোপুরিই ত্রুটিযুক্ত ট্রেনের চাকা, বডির জন্য হয়েছে। বিষয়টি খুবই উদ্বেগের জানিয়ে মহাপরিচালক বলেন, আমার কাছে জমা দেয়া তদন্ত রিপোর্ট এবং আবদুল জলিলের দেয়া বক্তব্যের রিপোর্টটি পড়ে আতঙ্কিত হয়েছি। দুটি রিপোর্ট আমি অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) মিয়াজাহানের হাতে দিয়েছি। অপারেশন বিভাগ ও প্রকৌশলী আবদুল জলিলের রিপোর্টে ভয়ঙ্কর তথ্য বেরিয়ে আসছে। তদন্ত রিপোর্ট ও আবদুল জলিলের দেয়া বক্তব্যের মধ্যে এটাই বের হয়ে আসছে যে, লাইন থেকে শুরু করে বিভিন্ন ট্রেনের যন্ত্রাংশই নড়বড়ে, মেয়াদোত্তীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ। এ বিষয়ে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) মিয়াজাহান জানান, মোট তিনটি তদন্ত কমিটির রিপোর্টের মধ্যে একটি তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আসতেই পক্ষে-বিপক্ষে বক্তব্য আসতে শুরু হয়েছে।
প্রকৌশলী আবদুল জলিল তার ‘ভিন্নমতের’ রিপোর্টে যে তথ্যউপাত্ত দিয়ে নিজের প্রকৌশল বিভাগকে দায়মুক্ত করতে চাচ্ছেন, সেটার তথ্যউপাত্ত আরও ভয়ঙ্কর। তার প্রায় ৭ পাতার রিপোর্টে বলতে চেয়েছেন, আঞ্চলিক পর্যায়ে তদন্ত কমিটির যে রিপোর্টে প্রকৌশল বিভাগকে একতরফা দায়ী করা হয়েছে, তা একেবারেই ঠিক নয়। ওই দুর্ঘটনা মূলত সংঘটিত হয়েছে ট্রেনের সমস্যার কারণে। এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ের ঊধ্বর্তন এক কর্মকর্তা জানান, নিজেদের দায় এড়াতে এক বিভাগ অপর বিভাগের ওপর দোষ চাপাতে চাচ্ছে। একই অবস্থা হবে রেলপথ মন্ত্রণালয় ও ঢাকা রেলওয়ে বিভাগের পক্ষ থেকে গঠিত বাকি দুটি তদন্ত কমিটির রিপোর্টেও। গত ২৩ জুন কুলাউড়ার বরমচলে ঢাকাগামী উপবন এক্সপ্রেস ট্রেনটি একটি সেতুর ওপর দুর্ঘটনায় পড়ে। এতে চারজন নিহত হন। এ দুর্ঘটনায় প্রায় ৩০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। রেলে ছোট বড় ট্রেন দুর্ঘটনায় গড়ে প্রায় ৫ কোটি টাকার উপরে ক্ষতি হয়। উল্লেখ্য, উপবন এক্সপ্রেস ট্রেন দুর্ঘটনায় ৪ যাত্রীর মৃত্যু হয়। আহত হন অর্ধশতাধিক।