কেন হামলা, কী বলছেন ছাত্রলীগের ‘পদবঞ্চিত’রা
সিরাজুল ইসলাম রুবেল— বাংলাদেশ ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই অন্তর্কোন্দলে জড়িয়ে পড়েন সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। পদ না পাওয়া নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ মিছিল করে ঘোষিত পূর্ণাঙ্গ কমিটিকে ‘অবৈধ’ অভিহিত করেন। তারা এই কমিটি বাতিলের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করার সময় তাদের ওপর হামলা চালায় কমিটিভুক্ত অংশের একদল নেতাকর্মী। এতে ১০ জন আহত হন। পদ না পাওয়া নেতাকর্মীদের অভিযোগ, সোমবার (১৩ মে) ঘোষিত ছাত্রলীগের ৩০১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে বিতর্কিত অনেকে পদ পেয়েছেন। ঘোষিত এই কমিটিতে অছাত্র, ছাত্রদলের সাবেক নেতাকর্মী, বিবাহিত, নতুন (আগে কোনও পদে ছিল না) ও বিতর্কিতদের স্থান দেওয়া হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পদ না পাওয়া নেতাকর্মীদের মধ্যে অধিকাংশই আগের কমিটির সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ এবং সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইনের অনুসারী। ছাত্রলীগের গত সম্মেলন হতে দেরি হওয়ায় সোহাগ-জাকিরের প্রতি কিছু নেতাকর্মী ক্ষুব্ধ ছিলেন। তারা সম্মেলন দেওয়ার দাবি করলে তাদের ওপর সোহাগ-জাকিরের অনুসারীরা তখন কয়েক দফা হামলা চালিয়েছিলেন।
সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে রোকেয়া হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শ্রাবণী দিশা, ছাত্রলীগের সাবেক উপ-অর্থ সম্পাদক ও ডাকসুর সদস্য তিলোত্তমা শিকদার, গত কমিটির প্রচার সম্পাদক সাঈফ বাবু, ডাকসুর ক্রীড়া সম্পাদক তানভীর ভুঁইয়া শাকিল, ডাকসুর সদস্য ও কুয়েত মৈত্রী হল ছাত্রলীগের সভাপতি ফরিদা পারভীন, সাধারণ সম্পাদক শ্রাবণী শায়লা, ডাকসুর কমনরুম ও ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক ও রোকেয়া হল ছাত্রলীগের সভাপতি বিএম লিপি আক্তার হামলার শিকার হন। চেয়ারের আঘাতে রোকেয়া হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শ্রাবণী দিশার মাথা ফেটে যায়।
যাদের বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ-
ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন এবং সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর অনুসারীরাই হামলা চালিয়েছেন বলে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন। তাদের দাবি, ঘোষিত কমিটির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আরিফুজ্জামান আল ইমরানের নেতৃত্বেই এই হামলা হয়েছে। তবে হামলা করার কথা ইমরান অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, ঘটনার সময় তিনি মধুর ক্যান্টিনে উপস্থিত থাকলেও তিনি হামলায় অংশ নেননি। তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করা হচ্ছে। হামলার শিকার ডাকসুর কমনরুম ও ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক বিএম লিপি আক্তার বলেন, ‘আমাদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে মূলত সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকের নির্দেশে। তাদের অনুসারী সদ্য পদপ্রাপ্ত যুগ্ম-আহ্বায়ক আরিফুজ্জামান আল ইমরানের নেতৃত্বে একাত্তর হলের ফাহিম হাসান, অমর একুশে হলের অনু আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছে।’ হামলার বিষয়ে বিজয় একাত্তর হল সংসদের সাহিত্য বিষয়ক সম্পাদক ফাহিম হাসান ও অমর একুশে হলের অনুর মোবাইলে একাধিকার ফোন দেওয়া হলেও তারা রিসিভ করেননি।
যেভাবে বিরোধের সূচনা-
গত কমিটির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক সায়েম খান সেই সময় ছাত্রলীগের সাধারণ সভায় প্রশ্ন তুলেছিলেন জাকির-সোহাগের বিলাসী জীবন, টাকার ভাগাভাগি, দরপত্র নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। এরপর এ নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। এ ঘটনার পরপরই গোলাম রাব্বানী ও সায়েম খানেরা সোহাগ-জাকিরের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করে সম্মেলন দেওয়ার দাবি জানান। অবশেষে ২০১৮ সালের ৩১ মার্চ ২৯তম সম্মেলন হয়। তবে সম্মেলনের প্রায় আড়াই মাস পর ছাত্রলীগ নতুন নেতৃত্ব পায়। শোভন-রাব্বানীর হাতে নেতৃত্ব তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
পদে পেয়েও আন্দোলনে তারা-
ঘোষিত কমিটিতে পদ পেয়েও সন্তুষ্ট নন বেশ কয়েকজন। তারা পদ না পাওয়া নেতাকর্মীদের সঙ্গে আন্দোলন করে হামলার শিকার হয়েছেন। ‘কাঙ্ক্ষিত’ পদ না পেয়ে আন্দোলনে নেমেছেন ছাত্রলীগের উপ-সাংস্কৃতিক সম্পাদক তিলোত্তমা শিকদার, উপ-গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক ফরিদা পারভীন এবং উপ-সাংস্কৃতিক সম্পাদক বিএম লিপি আক্তার।
৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম-
ছাত্রলীগের ঘোষিত পূর্ণাঙ্গ কমিটি বাতিল করে আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে নতুন কমিটি গঠনের আল্টিমেটাম দিয়েছেন পদ না পাওয়া নেতাকর্মীরা। এই দাবি না মানা হলে অনশন, বিক্ষোভ-মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি দেওয়ার কথা জানান তারা। মঙ্গলবার (১৪ মে) দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যানটিনে সংবাদ সম্মেলন করে হামলার সঙ্গে জড়িতদের বিচার দাবি করেন তারা। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়েছেন পদবঞ্চিত এই নেতাকর্মীরা।
পদ না পাওয়া নেতাকর্মীদের ভাষ্য-
পদবঞ্চিত হওয়া গত কমিটির প্রচার সম্পাদক সাঈফ বাবু বলেন, “যারা সোহাগ-জাকিরের সঙ্গে রাজনীতি করেছে, তাদের কেউ এই কমিটিতে কোনও পদ পায়নি। অনেক ত্যাগী নেতাকর্মীকে ‘মাইনাস’ করা হয়েছে। আবার এমনও আছে যারা মাঠে ছিল না; এখন দেখছি কমিটিতে বড় পদ পেয়েছে।” শোভন-রাব্বানী স্বজনপ্রীতি করেছেন বলে অভিযোগ করেন তিনি। বলেন, ‘মাদারিপুর জেলার অনেক নেতাকর্মী ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে পদ পেয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, ছাত্রলীগের সভাপতি শোভনের ভাইকে এ কমিটিতে পদ দেওয়া হয়েছে। এটা কোনও আদর্শ কমিটিতে হতে পারে না। আমরা এই কমিটি মানি না, আপার (প্রধানমন্ত্রী) কাছে আমরা অনুরোধ জানাবো এই কমিটি ভেঙে দিয়ে নতুন কমিটি ঘোষণা করা হোক।’
নবগঠিত কমিটির নেতাদের বক্তব্য-
সার্বিক বিষয়ে জানতে ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন এবং সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে একাধিকবার ফোন করেও সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে মঙ্গলবার দুপুর ৩টার দিকে শোভন ও রাব্বানী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে সাংবাদিকদের কিছু প্রশ্নের জবাব দেন। সেখানে শোভন বিবাহিতদের কমিটিতে স্থান দেওয়ার অভিযোগের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তা সত্ত্বেও তিনি বলেন, এ ব্যাপারে কমিটি করে খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একই সঙ্গে তিনি বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীদের আশ্বস্ত করে বলেন, কিছু দিন পর কমিটি বর্ধিত করে যোগ্যদের নিয়ে আসা হবে। আর ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. নাজিম উদ্দীন বলেন, ‘ছাত্রলীগের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক ৩০১ সদস্যের একটি তালিকা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের দিয়েছেন৷ তারা আবার সেটি প্রধানমন্ত্রীকে দিয়েছেন৷ প্রধানমন্ত্রী গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে যাচাই-বাচাই করার পরে পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনুমোদন দিয়েছেন৷ এখানে বিতর্কিত কমিটি হওয়ার কোনও সুযোগ নেই৷’ তিনি বলেন, ‘ছাত্রলীগ একটি বৃহৎ সংগঠন৷ সে অনুযায়ী পদের সংখ্যাও কম৷ তাই সবাইকে পদ দেওয়া যায়নি৷ যারা যোগ্য, ত্যাগী তাদের পদ দেওয়া হয়েছে৷ আপার সিদ্ধান্ত সবাইকে মেনে চলা উচিত।’