বাড়ি থেকে ক্যাডার দিয়ে তুলে নিয়ে গিয়ে এক ছাত্রীকে ধর্ষণ করেছেন বগুড়ার শহর শ্রমিক লীগের আহ্বায়ক তুফান সরকার। বগুড়ার এই প্রভাবশালী নেতা শুধু ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হননি, বিষয়টি ধামাচাপা দিতে দলীয় ক্যাডার ও এক নারী কাউন্সিলরকে ধর্ষণের শিকার মেয়েটির পেছনে লেলিয়ে দেন। শুক্রবার বিকেলে তাঁরা কিশোরী ও তার মাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে চার ঘণ্টা ধরে নির্যাতন চালান।  এরপর দুজনেরই মাথা ন্যাড়া করে দেন।  এই ঘটনায় প্রধান আসামি তুফানসহ চারজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।  এরইমধ্যে ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ফুঁসে উঠেছে মানুষ। অনেকেরই প্রশ্ন, কে এই তুফান সরকার?

অনুসন্ধানে জানা যায়, বগুড়া শহরের চকসুত্রাপুর কসাইপাড়া এলাকার ক্ষুদে ব্যবসায়ী মজিবর রহমান সরকারের আট ছেলের মধ্যে সবার ছোট তুফান সরকার।  ২৪ বছর বয়সী তুফান পারিবারিকভাবে চমড়া ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হলেও ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তার বড় ভাই যুবলীগ নেতা মতিন সরকারের মাধ্যমে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন।  বড় ভাই আব্দুল মতিন বগুড়া শহর যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক হওয়ায় রাজনীতিতে তুফান সরকারের দ্রুত উত্থান ঘটে। এক সময় তিনি মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে তিনি একটি বাহিনীও গড়ে তোলেন।  মাদকের টাকায় তিনি দ্রুত ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ বনে যান।

২০১২ সালের ৪ এপ্রিল তুফানকে ইয়াবা ও ফেন্সিডিলসহ গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে তিনি জামিনে বেড়িয়ে আসেন।  একই বছরের ২০ জুলাই একটি হত্যা চেষ্টা মামলায় তুফান এবং তার তিন ভাই ঝুমুর, ওমর ও সোহাগ গ্রেফতার হয়। তবে কোনো বারই তাদের বেশি দিন জেলে কাটাতে হয়নি।  ফলে তুফানের বেগেই যাবতীয় কুকর্ম অব্যাহত রাখেন তুফান সরকার। পরের বছর অর্থাৎ ২০১৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ইমরান হোসেন নামে প্রতিবেশী এক যুবদল নেতা খুন হন। ইমরানের মা তার ছেলে হত্যাকাণ্ডে তুফান ও তার ভাইদের জড়িত থাকার অভিযোগ করেন। ইমরানের মা তখন সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন, মতিন এবং তার ভাইদের নেতৃত্বে সন্ত্রাসীরা তার ছেলেকে হত্যা করেছে।  তিনি বলেন, একই সন্ত্রাসীরা খোকন নামে তার আরো এক ছেলেকে হত্যার চেষ্টা চালায়। ওই ঘটনায় থানায় মামলা দিতে গেলে পুলিশ নেয়নি। আক্ষেপ করে ইমরানের মা বলেন, পুলিশ কখনোই এই সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয় না। যদি নিত তাহলে ইমরানকে মরতে হতো না।

একাধিক মামলার আসামি তুফান সরকার এক সময় জাতীয় শ্রমিক লীগে যোগদান করেন।  তাকে ওই সংগঠনের বগুড়া শহর শাখার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর তিনি সংগঠনের ওই পদবি ব্যবহার করে শহরে ব্যাটারিচালিত তিন চাকার রিকশা-ভ্যান মালিক সমিতির নেতৃত্ব নেন।  প্রতিটি রিকশা মালিককে সমিতিতে ভর্তি বাধ্যতামূলক করে তাদের কাছ থেকে ভর্তি ফি বাবদ এক বছরের জন্য ২০ হাজার টাকা করে আদায় করেন।  সেই হিসাবে বগুড়া শহরে চলাচলকারী ১০ হাজার রিকশা-ভ্যান থেকে এক বছরেই আয় হয় ২০ কোটি টাকা।  এছাড়া সমিতির প্রতিটি রিকশা-ভ্যান থেকে তার সমিতির নামে ২০ টাকা করে প্রতিদিন ২ লাখ টাকা করে বছরে আরো ২৪ লাখ টাকা আদায় করা হয়।  ভর্তি এবং চাঁদার নামে তোলা এই অর্থের ভাগ আজ পর্যন্ত কোনো রিকশা-ভ্যান মালিককে দেওয়া হয়নি। বরং চাঁদাবাজির পুরো টাকা তুফান ও তার সহযোগীরাই ভাগ-বাটোয়ারা করে নেন।

এভাবে প্রায় দুই বছর চলার পর কয়েক মাস আগে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বগুড়া সফরকালে চাঁবাবাজি বন্ধের নির্দেশ দিলে তা বন্ধ হয়ে যায়।  তবে ততদিনে তুফান কোটিপতি বনে যান। সম্প্রতি তিনি নিজ এলাকায় প্রাসাদতুল্য বাড়ি নির্মাণ করেছেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ‘তুফান বাহিনী’র প্রধান তুফানের বিরুদ্ধে শহরের বিভিন্ন স্থানে জায়গা-জমি এবং দোকান-পাট দখলেরও বহু অভিযোগ রয়েছে।  প্রায় ৩ মাস আগে তিনি ক্যাডার বাহিনী নিয়ে শহরের তালুকদার মার্কেটে জনৈক রাজা মিয়া নামে এক ব্যক্তির দোকান দখল করে এক ব্যক্তিকে সেখানে বসিয়ে দেন। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ তুফানের বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ করেও কোনো লাভ হয় না। তবে কিশোরী ধর্ষণ মামলায় ফেঁসে যাওয়ার পর পুলিশ তুফানের অপরাধ জগতের খোঁজ খবর নিতে শুরু করেছে।

বগুড়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সনাতন চক্রবর্তী জানান, তুফানের বিরুদ্ধে হত্যা, হত্যার চেষ্টা এবং মাদক ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগে ৫টি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। তিনি বলেন, ‘তার বিরুদ্ধে আরো মামলা আছে কিনা তা খুঁজে দেখা হচ্ছে। ’ এদিকে সহযোগীদের দিয়ে তুলে নিয়ে কিশোরীকে ধর্ষণের ঘটনায় গ্রেপ্তার শ্রমিক লীগ নেতা তুফান সরকারকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।  তুফানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আওয়ামী লীগের নির্দেশের পর শ্রমিক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটি এই সিদ্ধান্ত নেয়। রোববার ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগের সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বগুড়া ধর্ষণ নিয়ে কথা বলেন।  তিনি বলেন, বগুড়ায় একটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে।  আমাদের সহযোগী সংগঠন শ্রমিক লীগের এক নেতার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ নিয়ে আমাদের মধ্যে কথা হয়েছে। এটা আমাদের সহযোগী সংগঠন, তাই আমরা সরাসরি ব্যবস্থা নিতে পারি না।  তবে তাদের অভ্যন্তরীণ সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে আমরা নির্দেশ দিয়েছি।  আওয়ামী লীগের এই নির্দেশের পর তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে শ্রমিক লীগ থেকে তুফান সরকারকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেয় সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটি। শ্রমিক লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি শুক্কুর মাহমুদ বলেন, আমরা তুফানকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করেছি।  এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেবে।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn