ক্ষমতাসীনদের ডুবাচ্ছে অতি উৎসাহীরা
অতি উৎসাহীদের একের পর এক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে বারবার বেকায়দায় পড়ছে শাসক দল আওয়ামী লীগ। ‘নব্য আওয়ামী লীগার’ বলে পরিচিত এই অতি উৎসাহীদের মধ্যে রয়েছে সাবেক ও বর্তমান আমলা, আইনজীবী, শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলীসহ পুলিশ প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা। কে কত বড় আওয়ামী লীগার, কে কতটা সরকারের কাছের- তা প্রমাণ করতে, সবার নজর কাড়তে, লাইম লাইটে আসতে নিজ উদ্যোগেই এরা একের পর এক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্ম দিচ্ছেন। বিষয়টি দিন দিন এমন পর্যায়ে চলে যাচ্ছে- খোদ সরকার প্রধানকেই এসব ইস্যুতে হস্তক্ষেপ করতে হচ্ছে। এমনকি কোনো কোনো ঘটনার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীও জানেন না। বিষয়টি নিয়ে বেশ চিন্তিত দলটির হাইকমান্ড। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে অনুপ্রবেশকারী অতি উৎসাহীদের তালিকা তৈরির কাজ শুরু করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি বিকৃতির অভিযোগে বরগুনার ইউএনও গাজী তারিক সালমনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের ও কারাগারে পাঠানো এবং তীব্র সমালোচনার মুখে মামলা প্রত্যাহারের ঘটনায় বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছে ক্ষমতাসীনরা। পাশাপাশি শাহবাগে শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে অহেতুক পুলিশের মারমুখী ভূমিকা এবং সেখানে পুলিশের টিয়ারশেল নিক্ষেপে তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী সিদ্দিকুর রহমানের দৃষ্টি হারানোর (একটি চোখ সম্পূর্ণ এবং অপরটি প্রায় নষ্ট) ঘটনায় বেশ সমালোচনার মুখে পড়েছে সরকার। এছাড়া কথায় কথায় বিভিন্ন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের মেয়রসহ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বরখাস্ত, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা প্রয়োগ করে বাকস্বাধীনতা হননের অভিযোগসহ অসংখ্য ঘটনা সমাজের প্রায় সব স্তরের মানুষের নেতিবাচক মন্তব্য শুনতে হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের। অথচ দেখা গেছে, অধিকাংশ ঘটনায় ছিল না সরকারের উচ্চ পর্যায়ের ‘সবুজ সংকেত’। গত এপ্রিলে বিএনপি থেকে নির্বাচিত দুই সিটি ও এক পৌর মেয়রকে সাময়িক বরখাস্ত করার বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তখন তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, এটি প্রধানমন্ত্রীর অজ্ঞাতসারেই ঘটেছে। এমন পরিস্থিতিতে জনমত পক্ষ রাখতে অনেক ঘটনার পরপরই দ্রুতগতিতে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়াচ্ছে সরকার। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এসব ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হতে হচ্ছে শাসক দল আওয়ামী লীগকেই। তাদের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। অতি উৎসাহীরা এসব বিতর্কিত ঘটনার জন্ম দিয়ে সুযোগ বুঝে সটকে পড়ে। কিন্তু দায়ভার নিতে হচ্ছে ক্ষমতাসীনদেরই। তাদের মতে, টানা দুই মেয়াদের আওয়ামী লীগের ক্ষমতার নয় বছরে বহু সুযোগসন্ধানী ভোল পাল্টে দলে ঢুকেছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাবেক ও বর্তমান আমলা, আইনজীবী, শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলীসহ পুলিশ প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরাও ভোল পাল্টিয়ে আওয়ামী লীগের খাতায় নাম লেখাতে শুরু করেছে। এই নব্যরাই দলকে বারবার বেকায়দায় ফেলছে বলে মন্তব্য তাদের।
বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরাও উদ্বিগ্ন। শুক্রবার আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার নির্বাচন মনোনয়ন বোর্ডের সভায় এ ইস্যুতে আলোচনা হয়। জানা গেছে, ওই সভায় দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুপ্রবেশকারীদের তালিকা করতে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে নির্দেশ দেন। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘অনুপ্রবেশকারীরা অতি উৎসাহী হয়ে ছোট ছোট অনেক বিষয়কে বড় করে দেখাতে চাইবে। একটি অঘটন ঘটিয়ে দল ও সরকারকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করবে। তাই অনুপ্রবেশকারীদের ব্যাপারে আগেভাগেই সতর্ক ও সজাগ থাকতে হতে হবে।’
গত ২০ মে গণভবনে এক বিশেষ বর্ধিত সভায় দলে অনুপ্রবেশকারীদের ‘আবর্জনা’ উল্লেখ করে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার কাছে তথ্য আছে, গ্রুপিং ভারি করতে অন্য দল থেকে সুবিধাবাদীদের দলে টানা হচ্ছে, এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। মনে রাখবেন, এরা দলে ঢুকে কমিশন খাওয়ার লোভে। এরা তখন এত বেশি শক্তিশালী হয়ে যায় যে, এদের কনুইয়ের গুঁতায় আমার দলের নিবেদিতরা টিকতে পারে না। অন্য দলের লোক আওয়ামী লীগে দরকার নেই।’
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরুল্লাহ মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, ‘দল ক্ষমতায় থাকলে সুবিধাভোগী মহল এর ভেতরে জায়গা করে নেয়ার চেষ্টা করে। এই মহলটি প্রকৃত নেতাকর্মীর চেয়ে যে কোনো কিছুতেই বেশি উৎসাহী হয়ে ওঠেন। যাদের অতি উৎসাহী বলা হয়। এই অংশ তৈরি হয় ক্ষমতাকে ঘিরে। এ গ্রুপের কাজই হল অনেক ছোটখাটো বিষয়কে বড় করে দেখিয়ে ফায়দা হাসিল করা। বিতর্কের জন্ম দেয়া। এদের বিষয়ে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে।’
বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান বলেন, ‘রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীসহ সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবারই উচিত সংযত আচরণ করা। তাদের অসংযত আচরণ নানা প্রশ্নের জন্ম দেয় এবং বিতর্কের সৃষ্টি করে। যার দায়ভার সরকারকেই নিতে হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘দেশে একটি নির্বাচনী আবহ তৈরি হয়েছে। আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল যে যার মতো নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করেছে। এ রকম একটি সময় সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে অতি উৎসাহী একাধিক চক্র তৎপর কিনা- সেদিকে সরকারি দলকেই নজর দিতে হবে।’
সম্প্রতি পঞ্চম শ্রেণীর এক শিশুর আঁকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি দিয়ে স্বাধীনতা দিবসের আমন্ত্রণপত্র ছাপানোয় মামলার আসামি হন বরিশালের আগৈলঝাড়ার সাবেক ইউএনও গাজী তারিক সালমন। বর্তমানে তিনি বরগুনা সদরের ইউএনও। বুধবার বরিশাল মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে হাজির হয়ে জামিন চাইলে আবেদন নাকচ করে তাকে হাজতে পাঠানো হয়। তবে দুই ঘণ্টা পর আবার জামিন দেন একই বিচারক। অতি উৎসাহী মনোভাব থেকেই এ ঘটনার সৃষ্টি হয়েছে বলে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি খোদ সরকারি দলের শীর্ষ নেতারাও মনে করছেন।
জানা গেছে, স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের নানা দুর্নীতি ও অপকর্মের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়াই কাল হয়েছে গাজী তারিক সালমনের। আগৈলঝাড়ায় দায়িত্ব পালনকালে পরীক্ষায় নকলের দায়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতার এক ছেলেকে বহিষ্কার এবং অসদাচরণের কারণে ছয় মাসের কারাদণ্ড, সরকারি বরাদ্দের যথাযথ ব্যয় নিশ্চিত করা, সরকারি জমিতে অবৈধ স্থাপনা গড়তে না দেয়ার কারণেই মূলত তারিক সালমনের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন তারা।
এ ঘটনার পরপরই প্রশাসনজুড়ে সৃষ্টি হয় চরম ক্ষোভ ও অসন্তোষ। তাৎক্ষণিকভাবে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানায়। এমন পরিস্থিতিতে মামলার বাদী বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট ওবায়েদ উল্লাহ সাজুকে দল থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পরবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। জনমতের চাপে বাধ্য হয়ে পরে মামলাটি প্রত্যাহার করে নিতেও বাধ্য হন অ্যাডভোকেট ওবায়েদ উল্লাহ সাজু। এ ঘটনার জের হিসেবে দু’জন জেলা প্রশাসককেও প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিকবিষয়ক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম শনিবার বেসরকারি নিউজ চ্যানেল যমুনা টিভিকে বলেন, ‘যারা আওয়ামী লীগে পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকেছে এটি তাদের পরিকল্পিত কাজ। তারা চেয়েছে প্রশাসনের সঙ্গে আওয়ামী লীগের একটা দূরত্ব তৈরি হোক। এটিই তারা করতে চেয়েছে তা স্পষ্ট ও প্রমাণিত।’ তিনি আরও বলেন, ‘একজন প্রথম শ্রেণীর সরকারি কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করতে হলে বা আইনগত ব্যবস্থা নিতে হলে সরকারের অনুমতি নিতে হয়। প্রশ্ন হল তারা কার অনুমতি নিয়েছে? এ ক্ষেত্রে সিএমএমেরও দায়িত্বহীনতা রয়েছে। এটি তো জামিনে আমলযোগ্য অপরাধ, কেন করা হল না তা দেখা হবে। পুলিশের আচরণও গ্রহণযোগ্য নয়। তারা এ ধরনের আচরণ করতে পারেন না। সেটিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’
এখানেই শেষ না, সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে অতর্কিত হামলা চালায় পুলিশ। এতে আহত হয়ে চোখ হারাতে বসেছে সরকারি তিতুমীর কলেজের ছাত্র মো. সিদ্দিকুর রহমান। জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সিদ্দিকুরের চোখে আলো ফেরার সম্ভাবনা ক্ষীণ বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সিদ্দিকুরকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারতে পাঠানো হচ্ছে।
এছাড়া প্রশ্ন উঠেছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের নিবর্তনমূলক ৫৭ ধারা নিয়েও। অনেকেই মনে করছেন, সরকারকে বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে ফেলতেই প্রশাসনের একটি অতিউৎসাহী মহল এই ধারাটি যোগ করেছে। জানা গেছে, মঙ্গলবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে ৫৭ ধারার বিষয়টি তোলেন একাধিক মন্ত্রী। বিদ্যমান আইসিটি আইনের এই ধারা নিয়ে দেশের সর্বত্র যে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে, সেটি তুলে ধরেন তারা। এরপর একাধিক মন্ত্রী বলেন, ৫৭ ধারা নিয়ে নানামুখী আলোচনা-সমালোচনা চলছে। সাংবাদিকদের নামে এই ধারায় মামলা হচ্ছে বলে গণমাধ্যমে খবর আসছে। এ সম্পর্কে সরকারের অবস্থান পরিষ্কার করা দরকার। না হলে সমস্যা বাড়বে বলেও মন্তব্য করেন একাধিক মন্ত্রী।
বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক এ প্রসঙ্গে মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, ‘সবাই এখন সরকারি দলের আস্থায় থাকতে চায়। এই আস্থায় থাকতে গিয়ে তারা একের পর এক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্ম দিচ্ছেন। যার খেসারত দিতে হচ্ছে শাসকদলকে।’
সংশ্লিষ্টদের মতে, সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে দলের ভেতরে থাকা সুবিধাভোগী গোষ্ঠী ছাড়াও প্রশাসন এবং পুলিশের অতিউৎসাহীরা এ ধরনের একের পর এক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্ম দিচ্ছে। এর আগে কয়েক দফা সিলেট, কুমিল্লা, রাজশাহী ও গাজীপুরের নির্বাচিত মেয়রদের বহিষ্কার করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এতে ব্যাপক সমালোচিত হয় সরকার। জনপ্রতিনিধিদের এভাবে কথায় কথায় বহিষ্কার করা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। বহিষ্কৃত মেয়ররাও বিষয়টি নিয়ে উচ্চআদালতের শরণাপন্ন হয়ে আবার স্বপদে ফিরে আসেন।
বিশ্লেষকদের মতে, এসব ঘটনা দলে এবং সরকারের ভেতরে সুবিধাভোগীদের অনপ্রবেশের কুফল। দলের ভেতরে যেমন অনুপ্রবেশকারীতে ঠাসা, তেমনি সরকারের ভেতরেও বিভিন্ন পদে সুযোগ-সন্ধানীরা ভরা। এ কারণেই একের পর এক অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটছে। কেউ কেউ দলে এবং সরকারের কাছে আস্থায় আসতে এবং নিজেকে আওয়ামী লীগার হিসেবে বিশ্বাসযোগ্য করাতে নানা কৌশল-অপকৌশলের পথ বেছে নিচ্ছেন। কারণ যাই হোক, নিজেকে সরকারি দলের লোক হিসেবে জাহির করতে অনেকে এখন ব্যতিব্যস্ত। আর এমন প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে নেই আমলা থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, যারা এক সময় আওয়ামী লীগের কঠোর সমালোচনা ছাড়াও আওয়ামীবিরোধী রাজনীতিও করেছেন তারাই এখন ব্যক্তিস্বার্থে আওয়ামী লীগে যোগ দিচ্ছেন। অনেকেই এদের নাম দিয়েছেন ‘হাইব্রিড’। ঘরে-বাইরে এখন এ হাইব্রিডদের ছড়াছড়ি। এমনকি রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির অনেক নেতাও নিজেকে ও সম্পদ রক্ষায় পর্দার আড়ালে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সমঝোতা করে চলেছেন। কেউ কেউ উপায়ান্তর না পেয়ে ভোল পাল্টে যোগ দিচ্ছেন আওয়ামী লীগে। বসে নেই জামায়াতও। মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী এ দলটির বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী গত কয়েক বছরে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। অনেক বাম নেতাও দীর্ঘদিনের আদর্শ বিসর্জন দিয়ে আওয়ামী লীগে একাকার হয়েছেন। এর ফলে প্রকৃত ও ত্যাগী আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা হারিয়ে গেছে নব্যদের দাপটে। এ অবস্থা প্রশাসনসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও।
জানতে চাইলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, দেশে মূলত ফায়দাতন্ত্রের রাজনীতি চলছে। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তখন সেই দলকে ঘিরে একশ্রেণীর চাটুকার এবং সুবিধাভোগী শ্রেণীর আত্মপ্রকাশ ঘটে। মূলত এ চাটুকার এবং সুবিধাভোগীরা অবৈধ উপায়ে নানারকম অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা নিতে বারবার ভোল পাল্টায়। ক্ষমতাসীন দলের ছাতার নিচে আশ্রয় নেয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। তাই সবাই যে কোনো মূল্যে গায়ে আওয়ামী লীগের লেবাস লাগাতে ব্যস্ত। রাজনীতিবিদ, আমলা, পুলিশ, ব্যবসায়ী, আইনজীবী, শিক্ষক, সাংবাদিক, প্রকৌশলী, বুদ্ধিজীবী সবাই এই লেবাস লাগাতে ব্যস্ত। কারণ এতে তাদের ফায়দা ভালো হবে। আয়-উন্নতি হবে। অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত হবে। পদোন্নতি মিলবে। অপরাধ করে পার পাওয়া যাবে। মূলত তারা বসন্তের কোকিল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এরা কিন্তু দুঃসময়ে থাকে না। এর আগে বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল, তখনও একই চিত্র ছিল।’
সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি বিকৃতির অভিযোগে বরগুনার ইউএনও গাজী তারিক সালমনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের ও কারাগারে পাঠানো এবং তীব্র সমালোচনার মুখে মামলা প্রত্যাহারের ঘটনায় বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছে ক্ষমতাসীনরা। পাশাপাশি শাহবাগে শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে অহেতুক পুলিশের মারমুখী ভূমিকা এবং সেখানে পুলিশের টিয়ারশেল নিক্ষেপে তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী সিদ্দিকুর রহমানের দৃষ্টি হারানোর (একটি চোখ সম্পূর্ণ এবং অপরটি প্রায় নষ্ট) ঘটনায় বেশ সমালোচনার মুখে পড়েছে সরকার। এছাড়া কথায় কথায় বিভিন্ন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের মেয়রসহ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বরখাস্ত, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা প্রয়োগ করে বাকস্বাধীনতা হননের অভিযোগসহ অসংখ্য ঘটনা সমাজের প্রায় সব স্তরের মানুষের নেতিবাচক মন্তব্য শুনতে হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের। অথচ দেখা গেছে, অধিকাংশ ঘটনায় ছিল না সরকারের উচ্চ পর্যায়ের ‘সবুজ সংকেত’। গত এপ্রিলে বিএনপি থেকে নির্বাচিত দুই সিটি ও এক পৌর মেয়রকে সাময়িক বরখাস্ত করার বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তখন তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, এটি প্রধানমন্ত্রীর অজ্ঞাতসারেই ঘটেছে। এমন পরিস্থিতিতে জনমত পক্ষ রাখতে অনেক ঘটনার পরপরই দ্রুতগতিতে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়াচ্ছে সরকার। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এসব ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হতে হচ্ছে শাসক দল আওয়ামী লীগকেই। তাদের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। অতি উৎসাহীরা এসব বিতর্কিত ঘটনার জন্ম দিয়ে সুযোগ বুঝে সটকে পড়ে। কিন্তু দায়ভার নিতে হচ্ছে ক্ষমতাসীনদেরই। তাদের মতে, টানা দুই মেয়াদের আওয়ামী লীগের ক্ষমতার নয় বছরে বহু সুযোগসন্ধানী ভোল পাল্টে দলে ঢুকেছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাবেক ও বর্তমান আমলা, আইনজীবী, শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলীসহ পুলিশ প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরাও ভোল পাল্টিয়ে আওয়ামী লীগের খাতায় নাম লেখাতে শুরু করেছে। এই নব্যরাই দলকে বারবার বেকায়দায় ফেলছে বলে মন্তব্য তাদের।
বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরাও উদ্বিগ্ন। শুক্রবার আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার নির্বাচন মনোনয়ন বোর্ডের সভায় এ ইস্যুতে আলোচনা হয়। জানা গেছে, ওই সভায় দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুপ্রবেশকারীদের তালিকা করতে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে নির্দেশ দেন। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘অনুপ্রবেশকারীরা অতি উৎসাহী হয়ে ছোট ছোট অনেক বিষয়কে বড় করে দেখাতে চাইবে। একটি অঘটন ঘটিয়ে দল ও সরকারকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করবে। তাই অনুপ্রবেশকারীদের ব্যাপারে আগেভাগেই সতর্ক ও সজাগ থাকতে হতে হবে।’
গত ২০ মে গণভবনে এক বিশেষ বর্ধিত সভায় দলে অনুপ্রবেশকারীদের ‘আবর্জনা’ উল্লেখ করে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার কাছে তথ্য আছে, গ্রুপিং ভারি করতে অন্য দল থেকে সুবিধাবাদীদের দলে টানা হচ্ছে, এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। মনে রাখবেন, এরা দলে ঢুকে কমিশন খাওয়ার লোভে। এরা তখন এত বেশি শক্তিশালী হয়ে যায় যে, এদের কনুইয়ের গুঁতায় আমার দলের নিবেদিতরা টিকতে পারে না। অন্য দলের লোক আওয়ামী লীগে দরকার নেই।’
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরুল্লাহ মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, ‘দল ক্ষমতায় থাকলে সুবিধাভোগী মহল এর ভেতরে জায়গা করে নেয়ার চেষ্টা করে। এই মহলটি প্রকৃত নেতাকর্মীর চেয়ে যে কোনো কিছুতেই বেশি উৎসাহী হয়ে ওঠেন। যাদের অতি উৎসাহী বলা হয়। এই অংশ তৈরি হয় ক্ষমতাকে ঘিরে। এ গ্রুপের কাজই হল অনেক ছোটখাটো বিষয়কে বড় করে দেখিয়ে ফায়দা হাসিল করা। বিতর্কের জন্ম দেয়া। এদের বিষয়ে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে।’
বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান বলেন, ‘রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীসহ সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবারই উচিত সংযত আচরণ করা। তাদের অসংযত আচরণ নানা প্রশ্নের জন্ম দেয় এবং বিতর্কের সৃষ্টি করে। যার দায়ভার সরকারকেই নিতে হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘দেশে একটি নির্বাচনী আবহ তৈরি হয়েছে। আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল যে যার মতো নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করেছে। এ রকম একটি সময় সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে অতি উৎসাহী একাধিক চক্র তৎপর কিনা- সেদিকে সরকারি দলকেই নজর দিতে হবে।’
সম্প্রতি পঞ্চম শ্রেণীর এক শিশুর আঁকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি দিয়ে স্বাধীনতা দিবসের আমন্ত্রণপত্র ছাপানোয় মামলার আসামি হন বরিশালের আগৈলঝাড়ার সাবেক ইউএনও গাজী তারিক সালমন। বর্তমানে তিনি বরগুনা সদরের ইউএনও। বুধবার বরিশাল মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে হাজির হয়ে জামিন চাইলে আবেদন নাকচ করে তাকে হাজতে পাঠানো হয়। তবে দুই ঘণ্টা পর আবার জামিন দেন একই বিচারক। অতি উৎসাহী মনোভাব থেকেই এ ঘটনার সৃষ্টি হয়েছে বলে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি খোদ সরকারি দলের শীর্ষ নেতারাও মনে করছেন।
জানা গেছে, স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের নানা দুর্নীতি ও অপকর্মের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়াই কাল হয়েছে গাজী তারিক সালমনের। আগৈলঝাড়ায় দায়িত্ব পালনকালে পরীক্ষায় নকলের দায়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতার এক ছেলেকে বহিষ্কার এবং অসদাচরণের কারণে ছয় মাসের কারাদণ্ড, সরকারি বরাদ্দের যথাযথ ব্যয় নিশ্চিত করা, সরকারি জমিতে অবৈধ স্থাপনা গড়তে না দেয়ার কারণেই মূলত তারিক সালমনের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন তারা।
এ ঘটনার পরপরই প্রশাসনজুড়ে সৃষ্টি হয় চরম ক্ষোভ ও অসন্তোষ। তাৎক্ষণিকভাবে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানায়। এমন পরিস্থিতিতে মামলার বাদী বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট ওবায়েদ উল্লাহ সাজুকে দল থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পরবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। জনমতের চাপে বাধ্য হয়ে পরে মামলাটি প্রত্যাহার করে নিতেও বাধ্য হন অ্যাডভোকেট ওবায়েদ উল্লাহ সাজু। এ ঘটনার জের হিসেবে দু’জন জেলা প্রশাসককেও প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিকবিষয়ক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম শনিবার বেসরকারি নিউজ চ্যানেল যমুনা টিভিকে বলেন, ‘যারা আওয়ামী লীগে পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকেছে এটি তাদের পরিকল্পিত কাজ। তারা চেয়েছে প্রশাসনের সঙ্গে আওয়ামী লীগের একটা দূরত্ব তৈরি হোক। এটিই তারা করতে চেয়েছে তা স্পষ্ট ও প্রমাণিত।’ তিনি আরও বলেন, ‘একজন প্রথম শ্রেণীর সরকারি কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করতে হলে বা আইনগত ব্যবস্থা নিতে হলে সরকারের অনুমতি নিতে হয়। প্রশ্ন হল তারা কার অনুমতি নিয়েছে? এ ক্ষেত্রে সিএমএমেরও দায়িত্বহীনতা রয়েছে। এটি তো জামিনে আমলযোগ্য অপরাধ, কেন করা হল না তা দেখা হবে। পুলিশের আচরণও গ্রহণযোগ্য নয়। তারা এ ধরনের আচরণ করতে পারেন না। সেটিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’
এখানেই শেষ না, সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে অতর্কিত হামলা চালায় পুলিশ। এতে আহত হয়ে চোখ হারাতে বসেছে সরকারি তিতুমীর কলেজের ছাত্র মো. সিদ্দিকুর রহমান। জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সিদ্দিকুরের চোখে আলো ফেরার সম্ভাবনা ক্ষীণ বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সিদ্দিকুরকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারতে পাঠানো হচ্ছে।
এছাড়া প্রশ্ন উঠেছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের নিবর্তনমূলক ৫৭ ধারা নিয়েও। অনেকেই মনে করছেন, সরকারকে বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে ফেলতেই প্রশাসনের একটি অতিউৎসাহী মহল এই ধারাটি যোগ করেছে। জানা গেছে, মঙ্গলবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে ৫৭ ধারার বিষয়টি তোলেন একাধিক মন্ত্রী। বিদ্যমান আইসিটি আইনের এই ধারা নিয়ে দেশের সর্বত্র যে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে, সেটি তুলে ধরেন তারা। এরপর একাধিক মন্ত্রী বলেন, ৫৭ ধারা নিয়ে নানামুখী আলোচনা-সমালোচনা চলছে। সাংবাদিকদের নামে এই ধারায় মামলা হচ্ছে বলে গণমাধ্যমে খবর আসছে। এ সম্পর্কে সরকারের অবস্থান পরিষ্কার করা দরকার। না হলে সমস্যা বাড়বে বলেও মন্তব্য করেন একাধিক মন্ত্রী।
বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক এ প্রসঙ্গে মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, ‘সবাই এখন সরকারি দলের আস্থায় থাকতে চায়। এই আস্থায় থাকতে গিয়ে তারা একের পর এক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্ম দিচ্ছেন। যার খেসারত দিতে হচ্ছে শাসকদলকে।’
সংশ্লিষ্টদের মতে, সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে দলের ভেতরে থাকা সুবিধাভোগী গোষ্ঠী ছাড়াও প্রশাসন এবং পুলিশের অতিউৎসাহীরা এ ধরনের একের পর এক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্ম দিচ্ছে। এর আগে কয়েক দফা সিলেট, কুমিল্লা, রাজশাহী ও গাজীপুরের নির্বাচিত মেয়রদের বহিষ্কার করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এতে ব্যাপক সমালোচিত হয় সরকার। জনপ্রতিনিধিদের এভাবে কথায় কথায় বহিষ্কার করা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। বহিষ্কৃত মেয়ররাও বিষয়টি নিয়ে উচ্চআদালতের শরণাপন্ন হয়ে আবার স্বপদে ফিরে আসেন।
বিশ্লেষকদের মতে, এসব ঘটনা দলে এবং সরকারের ভেতরে সুবিধাভোগীদের অনপ্রবেশের কুফল। দলের ভেতরে যেমন অনুপ্রবেশকারীতে ঠাসা, তেমনি সরকারের ভেতরেও বিভিন্ন পদে সুযোগ-সন্ধানীরা ভরা। এ কারণেই একের পর এক অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটছে। কেউ কেউ দলে এবং সরকারের কাছে আস্থায় আসতে এবং নিজেকে আওয়ামী লীগার হিসেবে বিশ্বাসযোগ্য করাতে নানা কৌশল-অপকৌশলের পথ বেছে নিচ্ছেন। কারণ যাই হোক, নিজেকে সরকারি দলের লোক হিসেবে জাহির করতে অনেকে এখন ব্যতিব্যস্ত। আর এমন প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে নেই আমলা থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, যারা এক সময় আওয়ামী লীগের কঠোর সমালোচনা ছাড়াও আওয়ামীবিরোধী রাজনীতিও করেছেন তারাই এখন ব্যক্তিস্বার্থে আওয়ামী লীগে যোগ দিচ্ছেন। অনেকেই এদের নাম দিয়েছেন ‘হাইব্রিড’। ঘরে-বাইরে এখন এ হাইব্রিডদের ছড়াছড়ি। এমনকি রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির অনেক নেতাও নিজেকে ও সম্পদ রক্ষায় পর্দার আড়ালে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সমঝোতা করে চলেছেন। কেউ কেউ উপায়ান্তর না পেয়ে ভোল পাল্টে যোগ দিচ্ছেন আওয়ামী লীগে। বসে নেই জামায়াতও। মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী এ দলটির বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী গত কয়েক বছরে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। অনেক বাম নেতাও দীর্ঘদিনের আদর্শ বিসর্জন দিয়ে আওয়ামী লীগে একাকার হয়েছেন। এর ফলে প্রকৃত ও ত্যাগী আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা হারিয়ে গেছে নব্যদের দাপটে। এ অবস্থা প্রশাসনসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও।
জানতে চাইলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, দেশে মূলত ফায়দাতন্ত্রের রাজনীতি চলছে। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তখন সেই দলকে ঘিরে একশ্রেণীর চাটুকার এবং সুবিধাভোগী শ্রেণীর আত্মপ্রকাশ ঘটে। মূলত এ চাটুকার এবং সুবিধাভোগীরা অবৈধ উপায়ে নানারকম অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা নিতে বারবার ভোল পাল্টায়। ক্ষমতাসীন দলের ছাতার নিচে আশ্রয় নেয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। তাই সবাই যে কোনো মূল্যে গায়ে আওয়ামী লীগের লেবাস লাগাতে ব্যস্ত। রাজনীতিবিদ, আমলা, পুলিশ, ব্যবসায়ী, আইনজীবী, শিক্ষক, সাংবাদিক, প্রকৌশলী, বুদ্ধিজীবী সবাই এই লেবাস লাগাতে ব্যস্ত। কারণ এতে তাদের ফায়দা ভালো হবে। আয়-উন্নতি হবে। অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত হবে। পদোন্নতি মিলবে। অপরাধ করে পার পাওয়া যাবে। মূলত তারা বসন্তের কোকিল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এরা কিন্তু দুঃসময়ে থাকে না। এর আগে বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল, তখনও একই চিত্র ছিল।’