ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে-‘সাব্বির আমার জীবন নষ্ট করে দিয়েছে। স্ত্রী হিসেবে তাকে কাছে পাইনি। সে আমাকে জিন্দা লাশ করে ফেলেছে। তার প্রতি ক্ষোভে-কষ্টে আমি আমার মেয়েকে বালিশ চাপা দিয়েছি।’ সিলেটে মেয়ে হন্তারক মা নাজমিন নাহার ১৫ মাস বয়সী মেয়ে সাবিহাকে হত্যার কথা স্বীকার করেছেন। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে নাজমিন এসব কথা বলেছেন। গতকাল বিকালে সিলেটের আদালতেও মেয়ে হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন। শিশু সন্তান নুসরাত জাহান সাবিহা হত্যার ঘটনাটি সিলেটের মানুষকে নাড়া দিয়েছে। মা নাজমিন নাহার বুধবার তাকে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করেছে। এরপর নিজে এসে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে।
এদিকে ঘটনার পর রাতে সিলেট শাহপরাণ থানায় মামলা দায়ের করেছেন শিশুটির পিতা কাতার প্রবাসী সাব্বির আহমদ। মামলায় একমাত্র আসামি করা হয়েছে নিহত শিশুর মা নাজমিন নাহারকে। সিলেটের কোতোয়ালি থানায় আটককালে নাজমিন নাহার সাংবাদিকদের কাছে পুরো ঘটনা বলেন। বারবার বলছিলেন, ‘আপনারা আমাকে ফাঁসি দিন। নতুবা আমি আত্মহত্যা করবো।’ খুনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে নাজমিন জানান- ‘আমি ইমোশন থেকে আমার বাচ্চাটাকে খুন করেছি। কিন্তু বালিশা চাপা দেয়ার পর আমার আবেগ জেগে ওঠে। আমি আমার মেয়েকে মারার পর তাকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরি এবং অনেকক্ষণ কান্না করি। এ সময় আমার বাচ্চার হৃদস্পন্দন আমি বুঝতে পারি। ওই সময় বাড়িওয়ালি এসে আমার কাছ থেকে আমার মেয়েকে নিয়ে নেন। এর পরপরই আমার মেয়ে হড়হড়িয়ে বমি করে। পরে ওসমানী হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।’
নাজমিন নাহার সিলেটের একটি বেসরকারি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষিকা। তার বাড়ি গোলাপগঞ্জ উপজেলার কালিকৃষ্ণপুর গ্রামে। সাব্বির আহমদ সিলেট দক্ষিণ সুরমার বলদি এলাকার বাসিন্দা। তিনি কাতারে বসবাস করেন। স্বজনরা জানিয়েছেন, ২০১৫ সালের মে মাসে সাব্বির হোসেনের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। বিয়ের ৬ মাস পর সাব্বির বিদেশে চলে যান। এরপর থেকে নাজমিন শহরতলির শাহপরাণ এলাকার নিপোবন-৪৯নং বাসায় বসবাস করছিলেন। বিয়ের চার বছরের মাথায় সাব্বির ২০২০ সালে দেশে আসেন। তখন তিনি স্ত্রী নাজমিনের সঙ্গেই বসবাস করেন। এরপর কাতার যাওয়ার সময়ই তাদের মধ্যে মনোমানিল্য দেখা দেয়। নাজমিন নাহার জানিয়েছেন, বিদেশের যাওয়ার পর থেকে স্বামী সাব্বির আর তার খোঁজ নেননি। ভরণ-পোষণও করেননি। বিদেশে থাকা অবস্থায় সাব্বির পরিচিতজনদের মাধ্যমে নাজমিনকে ডিভোর্স দেয়ার কথা বলতেন। কাতার যাওয়ার পরপরই গর্ভের সন্তান নিজের নয় বলে দাবি করেন সাব্বির। এ কারণে তিনি আরও বেশি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন।
তিনি জানান, ‘আমি তখন ডিএনএ টেস্ট করার কথা বলি। কিন্তু এরপরও সাব্বির আমার বিরুদ্ধে পরিচিত মহলে কুৎসা রটাতে থাকে এবং আমাকে অপবাদ দিতে থাকে। তবে জন্মের পর মেয়ের চেহারা অবিকল তার বাবার মতো হওয়ায় মানুষের প্রশ্ন থেকে আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন।’ সাম্প্রতিক ঘটনা তুলে ধরে নাজমিন জানান, ‘সাব্বির ১৫ দিন আগে দেশে এসেছেন। কিন্তু আমার কাছে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। চার-পাঁচ দিন পরপর শুধু কয়েক মিনিটের জন্য মেয়েকে দেখতে যান। কিন্তু আমি স্ত্রী হিসেবে তাকে কাছে পাইনি। ও পরকীয়া করে না। বহু নারীর কাছে যায়। একজনের সঙ্গে পরকীয়া করলে হয়তো তাকে ফেরাতে পারতাম।’ নিজেকে মেয়ের খুনি দাবি করে নাজমিন বলেন, ‘আমি কাউকে ফাঁসাবো না। সাব্বিরকেও ফাঁসাবো না। সব দোষ আমার। আমি আমার মেয়েকে খুন করেছি। আমার ফাঁসি হোক। অথবা কেউ আমার দুটো হাত কেটে ফেলুন। আপনারা যদি আমাকে শাস্তি না দেন তবে আমি যেকোনো সময় সুইসাইড করতে পারি।’
এদিকে বুধবার বিকালে নাজমিন নাহার আত্মসমর্পণের পর পুলিশ খবর দিয়ে সাব্বির আহমদকে থানায় নিয়ে আসে। সাব্বির জানান, ‘তার স্ত্রী নাজমিন নাহার মানসিক রোগী। সম্প্রতি তার মানসিক অবস্থার অবনতি হওয়ার কারণে নগরীর বাগবাড়িস্থ একটি মানসিক হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে ডাক্তার তাকে দেখেছেন। ইঞ্জেকশন দিয়ে বলেছেন ভর্তি করে রাখার জন্য। তিনি ভর্তি করেননি। স্ত্রীকে নিয়ে বাসায় চলে এসেছেন। আফসোস করে সাব্বির জানান, ‘যদি তিনি ডাক্তারের পরামর্শ মতো ভর্তি করে চলে আসতেন তাহলে তার সন্তানটি হয়তো খুন হতো না।’ এদিকে, রাতে সিলেটের কোতোয়ালি থানা থেকে আটক থাকা নাজমিন নাহারকে শাহপরাণ থানা পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়। এরপর রাতে সাব্বির আহমদ বাদী হয়ে থানায় মামলা করেন। দুপুরে পুলিশ নাজমিন নাহারকে জবানবন্দি প্রদানের জন্য আদালতে প্রেরণ করেন। বিকালে আদালতে তার জবানবন্দি গ্রহণ শেষে কারাগারে পাঠিয়ে দিয়েছেন। শাহপরাণ থানার ওসি সৈয়দ আনিসুর রহমান জানিয়েছেন, দোষ স্বীকার করার পর নাজমিনকে আদালতে স্বীকারোক্তি প্রদানের জন্য পাঠানো হয়। তিনি জানান, এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। এখন তদন্ত চলবে। তদন্তের পর আদালতে চার্জশিট প্রদান করা হবে।
সংবাদ টি পড়া হয়েছে :
১৫৯ বার