মহিউদ্দিন খান মোহন: বিএনপির চরম দুঃসময়ে দলটির হাল ধরেছিলেন খালেদা জিয়া। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে কতিপয় সেনা কর্মকর্তার হাতে নিহত হন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। তার মৃত্যুর পর প্রকট নেতৃত্বশূন্যতায় পড়ে দলটি। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার দলের ঐক্য ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছিলেন। এমনই এক প্রেক্ষাপটে ১৯৮২ সালে বিএনপির প্রাথমিক সদস্য হন খালেদা জিয়া। ওই বছরই ২৪ মার্চ সেনাপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতা দখল করেন। বিএনপি পতিত হয় চরম বিপর্যয়ে।

প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বিচারপতি আবদুস সাত্তার দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনে অপারগ হলে পরবর্তী সময়ে কে দলের নেতৃত্বে আসবেন, তা নিয়ে দ্বন্দ্ব-কোন্দলে জড়িয়ে পড়েন শীর্ষস্থানীয় নেতারা। সে সময় দলের ঐক্য ধরে রাখতেই খালেদা জিয়াকে সামনে নিয়ে আসা হয়। সে সময়ের অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতাদের অংশটি তাকে দলের নেতৃত্ব গ্রহণের অনুরোধ জানান। তারা তাকে এটা বোঝাতে সক্ষম হন যে, তিনি ব্যতীত অন্য কারও পক্ষেই দলকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। সব দিক বিবেচনা করে খালেদা জিয়া রাজি হন বিএনপির নেতৃত্বের স্টিয়ারিং হাতে নিতে। তার পর দীর্ঘ তিন যুগ ধরে তিনি দেশের অন্যতম বৃহৎ দলটির শীর্ষ নেতৃত্বে আছেন। এ দীর্ঘ সময়ে তাকে পাড়ি দিতে হয়েছে অনেক চড়াই-উতরাই। সম্মুখীন হতে হয়েছে নানা চ্যালেঞ্জের।

সবকিছুকে মোকাবিলা করে তিনি এগিয়ে গেছেন অভীষ্ট লক্ষ্যে। স্বৈরশাসক এরশাদবিরোধী আন্দোলনে আপসহীন ভূমিকা তাকে নিয়ে যায় অনন্য উচ্চতায়। অভিষিক্ত হন আপসহীন নেত্রীর অভিধায়। তার পর সাফল্যের সূর্যকে স্পর্শ করেন স্বৈরশাসনোত্তর প্রথম সংসদ নির্বাচনেই। দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সৃষ্টি করেন ইতিহাস।

বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনে খালেদা জিয়ার ভূমিকাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। জোর করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকারীর অধীনে কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার যে দৃঢ়তা তিনি দেখিয়েছেন, তা আমাদের দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত হিসেবে স্বীকৃত। আপসহীন নেত্রীর খেতাবে তিনি ভূষিত হয়েছেন এ কারণেই। দলীয় কর্মীদের দ্বারা অভিষিক্ত হয়েছেন দেশনেত্রী অভিধায়ও।

বাংলাদেশের সমকালীন রাজনীতিতে খালেদা জিয়া এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। একাধারে তিনি বিএনপি নামের রাজনৈতিক দলটির ঐক্যের প্রতীক। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী পদে শেখ হাসিনার বিকল্প হিসেবেও তার নামই উচ্চারিত হয় এখনো। তার রয়েছে কোটি কোটি ভক্ত-অনুরক্ত। কিন্তু বর্তমানে তার রাজনৈতিক জীবন এক মহাসংকটের মুখোমুখি। বলার অপেক্ষা রাখে না, ২০০৭ সালে কতিপয় ভুলের কারণে জরুরি অবস্থার যে ঝড় তার এবং তার দলের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে, তার রেশ এখনো কাটেনি।

৩৬ বছরের রাজনৈতিক জীবনে খালেদা জিয়াকে অনেক প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হলেও ২০০৭ সালের ওয়ান-ইলেভেনের মতো সংকটে আর পড়েননি। ওই রাজনৈতিক সিডর একদিকে যেমন তার দলকে লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেছে, অন্যদিকে তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারকেও করেছে হুমকির সম্মুখীন। সেই ওয়ান-ইলেভেন সরকারের দায়ের করা দুটি মামলায় আদালত কর্তৃক দণ্ডিত হয়ে তিনি এখন কারাবন্দি। এ কারাবন্দিত্ব তার কবে ঘুচবে, তা এক বিরাট প্রশ্ন।

দুই বছর পার হয়েছে খালেদা জিয়ার কারাবাস চলছে। এই দুই বছরে তার দল তাকে মুক্ত করতে পারেনি, এমনকি তার মুক্তি আদায়ের জন্য কোনো কার্যকর আন্দোলনও গড়ে তুলতে পারেনি। তার আইনজীবীরাও আদালতে সাফল্যের কোনো স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হননি। বরং ‘আইনি প্রক্রিয়ায় খালেদা জিয়ার মুক্তি সম্ভব নয়’- শীর্ষ আইনজীবীদের এমন মন্তব্য তাদের ব্যর্থতার স্বীকারোক্তি হিসেবেই দেশবাসীর কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। গত ১২ ডিসেম্বর (২০১৯) হাইকোর্ট তার জামিন আবেদন খারিজ করে দেওয়ার পর বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে চরম হতাশা নেমে আসে। অনেকেই খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয় নিয়ে হতাশায় নিমজ্জিত।

তবে অতি সম্প্রতি তার মুক্তির বিষয়টি আবার আলোচনায় এসেছে। এ নিয়ে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি বেশ কয়েকটি দৈনিকে এ বিষয়ে প্রতিবেদন বেরিয়েছে। বলা যায়, হঠাৎ করেই খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি আলোচনায় উঠে এসেছে। আর এর সূত্রপাত হয় তার মেজো বোন সেলিমা ইসলামের একটি উক্তিতে। সম্প্রতি তিনি খালেদা জিয়ার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে দেখা করে এসে জানান, খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের মারাত্মক অবনতি ঘটেছে, তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য দ্রুত বিদেশে নেওয়া দরকার।

এ ব্যাপারে সরকারের কাছে মানবিক বিবেচনার প্রত্যাশার কথাও বলেন তিনি। তিনি এও বলেছিলেন যে, এ ব্যাপারে তারা সরকারের কাছে আবেদন জানাবেন। খবরে বলা হয়েছে, বিদেশে খালেদা জিয়ার চিকিৎসার সুপারিশের জন্য বিএসএমএমইউর পরিচালকের কাছে তার ছোট ভাই শামীম ইস্কান্দার একটি আবেদপত্র জমা দিয়েছেন।

এদিকে ১৫ ফেব্রুয়ারির পত্রিকাগুলোয় প্রকাশিত যে খবরটি জনমনে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে তা হলো, খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য (জামিন বা প্যারোল) প্রধানমন্ত্রীর কাছে সুপারিশ করতে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে ফোন করেছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এই ফোনালাপের খবরটি সংবাদকর্মীদের ওবায়দুল কাদের নিজেই জানিয়েছেন।

অন্যদিকে এ-সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা আলমগীর। তবে ভেতরের খবর হলো, আদালত ও রাজপথ উভয় ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পর বিএনপি এখন সরকারের সঙ্গে সমঝোতার পথেই হাঁটছে। বিশেষত খালেদা জিয়ার পরিবারের ইচ্ছাতেই তারা নেত্রীর মুক্তির জন্য আপস করতে যাচ্ছেন। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেন, এ মুহূর্তে আপস ছাড়া খালেদা জিয়ার বাইরে বেরিয়ে আসার কোনো পথ নেই।

তবে অনেকেই সংশয় প্রকাশ করে বলছেন, দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত ‘আপসহীন নেত্রী’র গৌরবময় অভিধাকে বিসর্জন দিয়ে খালেদা জিয়া জেলের বাইরে আসবেন কিনা। এ প্রক্রিয়ায় মুক্তি নিলে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের সাময়িক বিরতিরও আশঙ্কা রয়েছে। সে হিসেবে দলের অনেকেই আপসের বিনিময়ে নেত্রীর মুক্তিকে মেনে নিতে পারছেন না। তবে রাজনীতির চেয়ে জীবন মূল্যবানÑ এ কথা মাথায় রেখেই তারা সরকারের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করছেন।

তা ছাড়া খালেদা জিয়ার পরিবারের কাছে তার আপসহীন নেত্রীর খেতাব বা রাজনৈতিক জীবনের চেয়ে তার জীবন ও সুস্থতাই মুখ্য বিষয়। তারা যে কোনো উপায়ে তাকে কারাগারের বাইরে নিতে চান। এ বিষয়ে তারা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন এবং তা অনেক দূর এগিয়েছে বলে প্রচারিত আছে। শেষ পর্যন্ত যদি খালেদা জিয়া প্যারোলে বা অন্য কোনো সমঝোতায় মুক্তি নিতে রাজি হন, তা হলে বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপ্রবাহ নতুন এক মোড় নেবে। কেননা প্যারোল বা জামিনের শর্ত অনুযায়ী তাকে রাজনীতি থেকে দূরে অবস্থান করতে হতে পারে। সে ক্ষেত্রে তিনি বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে মাইনাস হয়ে যাবেন কিনা, সে প্রশ্নও উঠেছে।

গৃহবধূ থেকে রাজনীতিতে এসে খালেদা জিয়া সৃষ্টি করেছেন এক অনন্য ইতিহাস। বর্ণাঢ্য সে রাজনৈতিক জীবনের পরিসমাপ্তি কি ঘটতে যাচ্ছে? তিন যুগের রাজনৈতিক জীবনে যত প্রতিকূল পরিস্থিতি তাকে মোকাবিলা করতে হয়েছে, এবারের পরিস্থিতি তার থেকে ভিন্ন। এবার তিনি এমন এক পরিস্থিতির মুখোমুখি, যা উতরে যাওয়া খুবই কঠিন। যেসব মামলায় তিনি দণ্ডিত হয়েছেন, সেগুলোর চূড়ান্ত বিচারে রায় কী হবে, কারও জানা নেই। তবে এখন তার জামিন পাওয়াটাই মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা তার স্বাস্থ্য এতটাই অবনতির শিকার যে, পরিবারের মতে অধিক বিলম্বে তার জীবন সংশয় দেখা দিতে পারে।

সরকারও হয়তো শেষ পর্যন্ত সবদিক বিবেচনা করে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির কিছুটা পরিবর্তন করতে পারে; যার ফলে খালেদা জিয়ার জামিনে বেরিয়ে আসা ত্বরান্বিত হতে পারে। তবে সে জামিনের শর্ত হিসেবে সম্ভাব্য যে বিষয়গুলো থাকতে পারে, সেগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত না হওয়া বা কোনোরূপ রাজনৈতিক বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত থাকা অন্যতম। কেননা তাকে শুধু চিকিৎসার জন্যই মুক্তি দেওয়া হবে। শর্ত ভঙ্গ হলে সঙ্গে সঙ্গে জামিন বাতিলের বিধানও নিশ্চয়ই তাতে সংযুক্ত থাকবে। আর সে জন্যই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের অকাল অবসান ঘটতে যাচ্ছে কিনা।

২০০৭ সালের জরুরি অবস্থার পর ‘মাইনাস ফর্মুলা’ কথাটি বেশ প্রচলিত হয়েছিল। সে সময় দেশের দুই প্রধান নেত্রীকে রাজনীতি, এমনকি দেশ থেকে মাইনাস করার চেষ্টা হতে দেখা গেছে। কিন্তু দেশবাসী সে ফর্মুলাকে গ্রহণ না করে দুই নেত্রীর ওপরই তাদের আস্থা রেখেছিল। আজ ১২ বছর পর খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে সে মাইনাস ফর্মুলা কার্যকর হচ্ছে কিনা, জনমনে এ প্রশ্ন উঠেছে। এক চরম দুঃসময়ে বিএনপির কাণ্ডারি হয়ে হাল ধরেছিলেন খালেদা জিয়া। নিয়তির নির্মম পরিহাস, তার জীবনের সবচেয়ে চরম দুঃসময়ে সে দল কোনো ভূমিকাই রাখতে পারল না। অবশ্য রাজনীতির পথে পা রাখতে না রাখতেই তাকে এমন বিরূপ পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়েছিল।

১৯৮৩ সালে তার নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে দল ভেঙেছিলেন রিয়াজউদ্দিন আহমেদ ভোলা মিয়া, শামসুল হুদা চৌধুরী ও ডা. এমএ মতিন। তার পর একে একে তাকে পরিত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, কেএম ওবায়দুর রহমান, ব্যারিস্টার অনিসুল ইসলাম মাহমুদ, ব্যারিস্টার আবুল হাসনাত, শাহ্ আজিজুর রহমান, আবদুল আলীমসহ অনেকেই। এরা কেউ কেউ এরশাদের মন্ত্রিসভার শোভাবর্ধন করেছিলেন।

আর ওয়ান-ইলেভেনের পর দলের তৎকালীন মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে সংস্কারের নামে খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে নির্বাসনে পাঠানোর চেষ্টা তো নিকট ইতিহাস। বলা নিষ্প্রয়োজন, সেসব কঠিন পরিস্থিতি খালেদা জিয়া বেশ শক্ত হাতেই মোকাবিলা করতে পেরেছিলেন। কিন্তু এবার তিনি এমন বেকায়দায় পড়েছেন যে, এখান থেকে উদ্ধার পাওয়া সহজ নয়।

খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য মির্জা আলমগীরের ওবায়দুল কাদেরকে ফোন করার ঘটনা প্রমাণ করে যে, নেত্রীর মুক্তির আর কোনো পথ তারা দেখছেন না। অনেকেই বলছেন, নেত্রীকে মুক্ত করতে ব্যর্থ মির্জা সাহেবরা এখন তার পরিবারের ইচ্ছাকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন। কেউ কেউ এটাও বলছেন যে, পরিবারের ইচ্ছা ও উদ্যোগে সরকারের সঙ্গে বিশেষ সমঝোতায় জামিন কিংবা প্যারোল যে পন্থায়ই হোক, অচিরেই হয়তো খালেদা জিয়া কারাগার থেকে বেরিয়ে আসবেন।

এ বিষয়টি আঁচ করতে পেরেই কিছুটা ‘অবদান’ রাখার সাক্ষী সৃষ্টির জন্যই মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ওবায়দুল কাদেরেকে ফোন করেছিলেন। ঘটনাপ্রবাহ যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে খালেদা জিয়ার মুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা হয়তো রয়েছে। তবে পাশাপাশি এ আশঙ্কাও রয়েছে, এখানেই তার রাজনৈতিক জীবনের ইতি ঘটে কিনা।
-সৌজন্যে: দৈনিকআমাদেরসময়

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn