গ্রামীণফোন ও রবির বিরুদ্ধে আসছে অপারেশনাল ব্যবস্থা
প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা বকেয়া আদায়ে মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোন ও রবির বিরুদ্ধে অপারেশনাল ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। এমন পদক্ষেপে এই দুই অপারেটরের বিপুলসংখ্যক গ্রাহকের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা থাকার পরও বিটিআরসির সর্বশেষ সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গ্রামীণফোন ও রবির বিরুদ্ধে সম্ভাব্য আট ধরনের অপারেশনাল ব্যবস্থা নেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে বিটিআরসি। একই সঙ্গে এসব ব্যবস্থায় কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে সে বিষয়টিও বিবেচনায় রাখা হয়েছে। আট ধরনের ব্যবস্থার মধ্যে প্রথমেই রয়েছে, বিটিআরসি থেকে এ দুই প্রতিষ্ঠানের পক্ষে অনাপত্তি বা অনুমোদনপত্র জারি বন্ধ করে দেওয়া। এতে প্রতিষ্ঠান দুটির নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে। এমএনপি পোর্ট ইন বন্ধ বা সীমিত করার পরিকল্পনাও হাতে রাখা হয়েছে। এর ফলে সংশ্লিষ্ট অপারেটর তাদের নেটওয়ার্কে পোর্ট ইন সুবিধা গ্রহণ করতে পারবে না বা এই সুবিধা সীমিত হয়ে পড়বে। এর চেয়েও কড়া পদক্ষেপ হতে পারে, নতুন গ্রাহক নেওয়া বন্ধ বা সীমিত করে দেওয়া। ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে বা আইজিডাব্লিউ প্রান্ত থেকে ব্যান্ডউইডথ বন্ধ বা সীমিত করার পরিকল্পনাও রয়েছে বিটিআরসির। এর ফলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ইন্টারনেট সেবার মান কমবে বা ব্যাহত হবে। আইজিডাব্লিউ প্রান্ত থেকে অন্তর্গামী বা বহির্গামী কল বন্ধ বা সীমিতকরণের পদক্ষেপও নেওয়া হতে পারে। ইন্টার কানেকশন এক্সচেঞ্জের (আইসিএক্স) মাধ্যমে বন্ধ বা সীমিত করে দেওয়া হতে পারে স্থানীয় কল। নেটওয়ার্ক ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম বা এসএমএসের মাধ্যমে সারা দেশ বা নির্দিষ্ট এলাকায় থ্রিজি ও ফোরজি সেবা বন্ধ করে দেওয়ার পদক্ষেপও নেওয়া হতে পারে।
জানা যায়, গত ২২ মে অনুষ্ঠিত কমিশন সভায় গ্রামীণফোন ও রবি আজিয়াটা লিমিটেডের বিরুদ্ধে এসব অপারেশনাল ব্যবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত কার্যপত্র উপস্থাপন করে বিটিআরসির ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড অপারেশন (ই অ্যান্ড ও) বিভাগ। সভায় একই সঙ্গে জানানো হয়, অডিট রিপোর্ট অনুসারে বারবার দাবিপত্র পাঠানোর পরও এ দুই প্রতিষ্ঠান পাওনা পরিশোধ করেনি। সূত্র জানায়, গ্রামীণফোন ও রবির বিরুদ্ধে প্রথমে আইনগত ব্যবস্থার উদ্যোগ নেওয়া হলেও পরে অপারেশনাল ব্যবস্থা নেওয়ার পরিকল্পনা হয় এবং সে অনুসারে বিটিআরসির ২২৭তম সভায় এ বিষয়ে প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়। এদিকে বিটিআরসির উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, গত মার্চ পর্যন্ত দেশে মোবাইল ফোনের ভয়েস গ্রাহক পৌঁছেছে ১৬ কোটির ওপরে। এর মধ্যে গ্রামীণফোনের গ্রাহক সাত কোটির ওপরে। দেশের মোবাইল ইন্টারনেট গ্রাহক ৯ কোটি ৩১ লাখের ওপরে। এর মধ্যে গ্রামীণফোনের গ্রাহক তিন কোটি ৭৫ লাখের ওপরে। গ্রামীণফোনের মার্কেট শেয়ার ৪৬ শতাংশ। অন্যদিকে রবির গ্রাহক চার কোটি ৭৩ লাখের কাছাকাছি। এই অপারেটরের ইন্টারনেট গ্রাহক দুই কোটি ৯০ লাখের কাছাকাছি। মার্কেট শেয়ারও ৩০ শতাংশ। এ অবস্থায় অপারেশনাল ব্যবস্থা নেওয়া হলে গ্রাহকদের ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। কিন্তু এই উদ্বেগ সত্ত্বেও বিটিআরসির সভায় সিদ্ধান্ত হয়, অডিট আপত্তিকৃত চূড়ান্ত দাবির অর্থ পরিশোধ না করার জন্য এ দুই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কেস-টু-কেস ভিত্তিতে কমিশনের নির্দেশক্রমে অপারেশনাল ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
প্রসঙ্গত, বিটিআরসি গ্রামীণফোনকে ১০ কার্যদিবস বা গত ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়ে ১২ হাজার ৫৭৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা পরিশোধ করতে বলেছিল। গত ২ এপ্রিল মঙ্গলবার বিকেল ৪টা ২০ মিনিটে গ্রামীণফোন বিটিআরসির ওই চিঠি গ্রহণ করে। গ্রামীণফোনের সিস্টেম নিরীক্ষার পর সর্বশেষ এই পাওনার পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে বিটিআরসির পাওনা আট হাজার ৪৯৪ কোটি এক লাখ টাকা এবং এনবিআরের পাওনা চার হাজার ৮৫ কোটি ৯৪ লাখ টাকা।গ্রামীণফোনের কাছ থেকে এই পাওনা আদায়ের জন্য গত মঙ্গলবার এনবিআরকেও আলাদা চিঠি দেওয়া হয়েছে। মোবাইল ফোন অপারেটরদের সিস্টেম নিরীক্ষার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে আলোচনায় থাকলেও এ বিষয়ে প্রথম উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১১ সালে। সে সময় প্রতিষ্ঠানটির কাছে ১৮ বছরের পাওনা নির্ধারণ করা হয় তিন হাজার ৩৪ কোটি ১১ লাখ আট হাজার ৫৮১ টাকা। বিটিআরসি ২১ দিনের মধ্যে ওই পাওনা পরিশোধের জন্য গ্রামীণফোনকে চিঠি দেয় ওই বছরের ৩ অক্টোবর। কিন্তু গ্রামীণফোন ওই নিরীক্ষার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করলে পাওনা আদায়ের বিষয়টি ঝুলে যায়। এরপর দ্বিতীয় নিরীক্ষায় ১২ হাজার ৫৭৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা পাওনা নির্ধারণ করা হয়। বিটিআরসি সূত্র জানায়, পর্যালোচনায় মূল পাওনা থেকে ১৫ কোটি টাকা বাদ দিলেও দীর্ঘদিনের এ পাওনা সম্পর্কে গত ২৩ এপ্রিল রাজধানীর ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি বসুন্ধরায় (আইসিসিবি) ২২তম বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম) বিটিআরসির এই দাবিকে ‘আইনগতভাবে ভিত্তিহীন’ বলে আখ্যায়িত করেন গ্রামীণফোনের পরিচালনা পর্ষদের প্রধান পিটার বি. ফারবার্গ।
গতকাল এ বিষয়ে গ্রামীণফোনের এক্সটার্নাল কমিউনিকেশনস বিভাগের প্রধান সৈয়দ তালাত কামাল বলেন, ‘আমরা বিটিআরসির সভার সর্বশেষ সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কোনো তথ্য পাইনি। সে কারণে কোনো মন্তব্য করা সম্ভব হচ্ছে না।’ এদিকে বিটিআরসি ২০১৭ সালের ২৮ নভেম্বর মোবাইল অপারেটর রবি আজিয়াটা লিমিটেডের অডিটের চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে। গত বছরের ৩১ জুলাই ১০ কার্যদিবসের মধ্যে পাওনা পরিশোধের জন্য চিঠি দেওয়া হয়। এতে রবির কাছে পাওনার পরিমাণ উল্লেখ করা হয় এক হাজার
২৫১ কোটি ৬৭ লাখ ৯৭ হাজার ৫৫১ টাকা। বিটিআরসি এ বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়ে রবির কাছে চিঠি পাঠায়। পরে রবির যুক্তি ও দাবি মেনে পাওনার পরিমাণ ৩৮৪ কোটি ৪৪ লাখ ছয় হাজার ৭৫ টাকা কমিয়ে ৮৬৭ কোটি ২৩ লাখ ৯১ হাজার ৪৭৬ টাকা পুনর্নির্ধারণ করা হয়; কিন্তু তাতেও সম্মত নয় রবি। বিটিআরসির সর্বশেষ সিদ্ধান্ত সম্পর্কে গতকাল রবির এক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাত্ক্ষণিকভাবে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। বিটিআরসির কমিশনার মো. রেজাউল কাদের (ই অ্যান্ড ও) কমিশনের সর্বশেষ সিদ্ধান্ত সম্পর্কে গতকাল বলেন, বিটিআরসি গ্রামীণফোণ ও রবির বিরুদ্ধে অপারেশনাল ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কার বিরুদ্ধে কী ধরনের অপারেশনাল ব্যবস্থা নেওয়া হবে সে বিষয়ে বিটিআরসির পরবর্তী নির্দেশনা অনুসারে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।