জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ভবিষ্যৎ কী?
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করার পর আনুষ্ঠানিকভাবে সংসদে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্তে বিএনপির ওপর ক্ষুব্ধ জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটের শরিক দলগুলো। ঐক্যফ্রন্ট ও জোটের শীর্ষ নেতারা বলছেন, ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের আগের রাতে ভোটদখলের অভিযোগ ও নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করার মধ্য দিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক জোটের যে অবস্থান ছিল, সংসদে বিএনপির অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে তা পুরোপুরি প্রশ্নবিদ্ধ হলো। সে হিসেবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটের ভবিষ্যৎ নিয়ে টানাপড়েন শুরু হয়েছে শরিক দলগুলোর মধ্যে। বিষয়টি নিয়ে কথা হয় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট, বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটসহ বিএনপির রাজনীতিঘনিষ্ঠ একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে। তাদের অনেকেই ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম প্রভাবশালী একজন নেতা মনে করেন, বিএনপি নিজস্ব পলিসি ঠিক করতে পারছে না। যে কারণে শেষমুহূর্তে সংসদে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্তে এসেছে। এ সিদ্ধান্ত তারেক রহমান যে নিয়েছেন, তা মির্জা ফখরুল আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছেন। যদিও মির্জা ফখরুল শপথ গ্রহণ করেননি। কেন শপথ নেননি, তা তিনি বলতে পারবেন। সংসদে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত বিএনপি যে যুক্তিতেই গ্রহণ করুক, সে ক্ষেত্রে অন্তত ফ্রন্টের শীর্ষ একাধিক নেতাকে তা জানানো যেতো। বিএনপি তা করেনি। এরমধ্য দিয়ে ঐক্যফ্রন্ট বা ২০ দলীয় জোটের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক বলেও তিনি মনে করেন।
ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য আবদুল মালেক রতন এ সিদ্ধান্তকে দেখছেন ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ হিসেবে। শনিবার (৪ মে) বিকালে তিনি বলেন, ‘ভালো কাজের মধ্যেই বিশ্বাসঘাতক থাকে। এ বিশ্বাসঘাতকদের কারণে কখনও ভালো কাজ আটকে থাকে না। যেমন ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় ৫১ জন এমএনএ-এমপি পাকিস্তানের দালালি করেছেন। এরমধ্যে ৫ জনের বিরুদ্ধে দালালি আইনে মামলা দিয়েছে বঙ্গবন্ধুর সরকার। বাকিদের বহিষ্কার করেছেন বঙ্গবন্ধু। তাদের ওই দালালির কারণে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় কিন্তু থেমে থাকেনি।’ বিএনপির সংসদে যোগ দেওয়ার বিষয়ে জেএসডির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন বলেন, ‘আজকে যারা পাঁচ-সাতজন দালালি করতে সংসদে গেছেন, তাদের দালালির কারণে কোনও দিনই এই দেশে গণতন্ত্র, ভোটাধিকার, প্রগতির আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে না। তবে সাময়িক বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে। কেউ যদি মনে করেন, এটাই চূড়ান্ত, তারা সেই জায়গায় চলে যাবে। কিন্তু আমরা আমাদের ঐক্য ধরে রাখবো। কেউ যদি বেরিয়ে যেতে চান, যেতে পারেন। কিন্তু আমাদের ঐক্যফ্রন্ট অক্ষুণ্ন রাখবো।’
ঐক্যফ্রন্ট থেকে বিএনপির বেরিয়ে যাওয়ার আলোচনা শুরু হয়েছে কি না—এমন প্রশ্নের উত্তরে আবদুল মালেক রতন বলেন, ‘এখনও শুরু হয়নি। সাংগঠনিক কিছু সমস্যা আছে। সেগুলো শেষ হতে হবে আগে। আমাদের উদ্দেশে বিএনপি এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যাখ্যা দেয়নি। তবে বিভিন্ন সূত্রে জেনেছি, কেউ আদিষ্ট হয়ে, কেউ সাংগঠনিক ঐক্য বজায় রাখতে গিয়ে শপথ নিয়েছেন।’ ফ্রন্টটির স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য ও গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি সুব্রত চৌধুরী জানান, রবিবার (৫ মে) তাদের দলের কমিটি ঘোষণা করা হবে। তারা এ বিষয়টি শেষ করার পরই সংসদের বিষয়টি নিয়ে ভাববেন।
প্রসঙ্গত, ইতোমধ্যে গণফোরাম থেকে নির্বাচন করে জয়ী সুলতান মোহাম্মদ মনসুর ও মোকাব্বির খান শপথ নিয়ে সংসদে যোগ দিয়েছেন। জানতে চাইলে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘আমি এখনই কিছু বলতে চাই না। পুরো পরিস্থিতি আরও বুঝতে চাই, তারপরই মন্তব্য করা যাবে।’ জেএসডির আরেক কেন্দ্রীয় নেতা ও ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য ডা. জাহেদ উর রহমান বলেন, ‘যতই বলা হোক না কেন, কৌশলগত কারণে বিএনপির এই যোগদান আদতে সরকারের ইচ্ছাপূরণ করে বিএনপির অবস্থান গণমানুষের আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধেই গেছে। আশা করি, দলটি এই ব্যাপারে সচেতন থাকবে এবং এই সমস্যা দ্রুত কাটিয়ে ওঠার কর্মকৌশল ঠিক করবে। বিএনপির মনে রাখতে হবে স্বল্পমেয়াদে এই রাষ্ট্রের পুনঃগণতন্ত্রায়নের সংগ্রামের নেতৃত্ব তাকেই দিতে হবে।’ সংসদে যোগ দেওয়ার বিষয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নতুন কোনও মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে ২৯ এপ্রিল রাতে তিনি বলেছিলেন, ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে প্রশ্ন ওঠার সুযোগ খুব একটা হবে বলে মনে হয় না। কারণ, তাদের দু’জন আগে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’
পরদিন ৩০ এপ্রিল একটি অনুষ্ঠানে সংসদে যোগ দেওয়ার বিষয়টিকে মির্জা ফখরুল দেখেছিলেন, ইউটার্ন হিসেবে। তিনি বলেছেন, ‘২৯ এপ্রিল থেকে রাজনীতি খুব গরম হয়ে উঠেছে। কারণ বিএনপির নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা শপথ নিয়েছেন। বলা যেতে পারে, এটি নিঃসন্দেহে একটা চমক, ইউটার্ন। আমাদের দলীয় সিদ্ধান্ত ছিল ৩০ তারিখের যে নির্বাচন হয়েছে, সেটা কোনও নির্বাচন হয়নি।’ বিএনপির দায়িত্বশীল একটি সূত্র বলছে, ঐক্যফ্রন্ট অক্ষুণ্ন থাকবে। তবে বিরোধী রাজনৈতিক কৌশল নতুনভাবে তৈরি হবে। সেক্ষেত্রে ঐক্যফ্রন্ট, ২০ দলীয় জোটের সুনির্দিষ্ট একাধিক দল ও দুই জোটের বাইরে থাকা দুই-একটি দলের সমন্বয়ে একটি ‘সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ’ ধরনের বৃহৎ প্ল্যাটফরম গড়ে তোলা হবে।এ প্ল্যাটফরমে ড. কামাল হোসেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, এলডিপির সভাপতি অলি আহমদকে উপদেষ্টা করার বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। সমন্বয়ক হিসেবে মির্জা ফখরুল ও মুখপাত্র হিসেবে মাহমুদুর রহমান মান্নাকে সামনে রাখার চিন্তা চলছে। তবে, এ বিষয়ে দায়িত্বশীল কোনও নেতার মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের মতো ক্ষুব্ধ ২০ দলীয় জোটের শরিক খেলাফত মজলিশের আমির মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাকও। তিনি বলেন, ‘বিএনপির আচার-আচরণে আমি বিস্মিত হয়েছি। তাদের কথাবার্তার মধ্যে কোনো ধরনের মিল নেই। তারা একটি সিদ্ধান্ত নেয়, আর লন্ডন থেকে ওহি নাজিল হলে সব পাল্টে যায়। তাদের এই আচরণে আমি মর্মাহত। তাদের এই আচরণের নিন্দা জানানোর ভাষাও আমি খুঁজে পাচ্ছি না।’ মুহাম্মদ ইসহাক আরও বলেন, ‘২০ দলীয় জোট নিয়ে আমার মন খুব বেশি ভালো নয়। এখনই ২০ দলীয় জোট ছেড়ে যাচ্ছি, এটা বলবো না। একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরে শেষ পর্যন্ত তা ঠিক রাখতে না পারলে তাদের সঙ্গে কাজ করা কঠিন।’ বিএনপির এমপিদের শপথ নেওয়ার মধ্যে দিয়ে দলটির আর কোনও রাজনীতি থাকলো না বলেও মনে করেন মাওলানা ইসহাক। তিনি বলেন, ‘বিএনপির রাজনীতি হবে এখন ধোঁকার রাজনীতি। তাদের এই সিদ্ধান্ত ২০ দলীয় জোটের জন্য অত্যন্ত ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ।’ জোটের আরেক শরিক দল কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) ইব্রাহিম বলেন, ‘গণফোরামের ২ জন সংসদে যোগ দেওয়ায় যেই প্রতিক্রিয়া হয়েছিল সবার মধ্যে, বিএনপির একজন সংসদে গেলেই সেটা ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। এরপর ৩ দিনের ব্যবধানে যখন বিএনপির আরও ৪ জন শপথ নেন, তখন আমার প্রতিক্রিয়া শূন্য হয়ে গেলো।’
বিএনপির এমপিদের শপথ নেওয়া প্রসঙ্গে ২০ দলীয় জোটে কোনও আলোচনা হয়নি বলে জানান ইব্রাহিম। তিনি বলেন, ‘আমার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবেও আলোচনা হয়নি। ফলে তাদের শপথ নেওয়া আমরা বিস্মিত হয়েছি। জোটের মধ্যে আস্থাহীনতার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কারণ এত বড় ঘটনা যদি রাতের অন্ধকারে হয়, তাহলে জোটের সদস্য হিসেবে পরিস্থিতি মোকাবিলার সুযোগ থাকে না।’ সাবেক এই সেনাকর্মকর্তা বলেন, ‘বিএনপির সংসদে যোগ দেওয়াকে এখন হঠাৎ করে বৈধ বলতে পারি না। তবে বিএনপির এই সিদ্ধান্তে জোটে কোনও ভাঙনের আশঙ্কা দেখছি না।’ দেড় বছরের মধ্যে রাজনীতিতে নতুন জোট হবে বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন।