টাঙ্গুয়ার হাওড়ের তিন গ্রাম এখনও শিক্ষাবঞ্চিত
চার বছরের রিফাত কিংবা অষ্টাদশী রাশেদা -কেউই স্কুলের আঙিনায় পা রাখার সুযোগ পায়নি। ওদের মতো টাঙ্গুয়ার হাওড়ে পানিবন্দী গ্রাম শ্রীআরগাঁও এর প্রায় শ’খানেক শিশু স্কুলের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। শ্রীআরগাঁও ছাড়াও পাশ্ববর্তী মোহনপুর ও রহিমপুরে কোন স্কুল নেই। এই তিন গ্রাম মিলিয়ে শিশুর সংখ্যা প্রায় আড়াই’শ। টাঙ্গুয়ার হাওড়ের এই গ্রামগুলো সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার শ্রীপুর ইউনিয়নের অন্তর্ভূক্ত। এসব গ্রাম খণ্ড খণ্ড দ্বীপের মতো।এখানকার অধিবাসীদের মূলত সারা বছর স্বাচ্ছন্দে সংসার চালানোর মতো জীবিকার ব্যবস্থা নেই। যার জমি আছে সে কৃষিকাজ করে। বছরে একটা ফসল পায়। তাতে সংসার চলে না। কেউ কেউ কৃষিশ্রমিক। আবার এরাই বিভিন্ন সময়ে কাজের খোঁজে পাশ্ববর্তী তামাবিল ও ছাতক এলাকায় যায় কয়লা ও পাথর শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে।
এ বছরের মার্চ-এপ্রিল মাসে আকস্মিক পাহাড়ী ঢলে সৃষ্ট বন্যায় এই এলাকার সব জমির ফসল তলিয়ে যায়। পরে আগস্ট মাসে দ্বিতীয় দফা বন্যার শিকার হয় সুনামগঞ্জ, সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জের বিস্তৃত হাওড় এলাকা। নতুন আবাদের মৌসুম শুরু হয়েছে কিন্তু হাওড়ের পানি না শুকানোয় সেই আবাদও অনিশ্চিত। এখনও হাওড়ের আবাদী জমি স্থানভেদে ৬ থেকে ১২ ফুট পানির নীচে। কাজ নেই, আয় নেই। তাই হাওড়ের এই গ্রামগুলোতে শিশুদের জন্য তিন বেলা খাবার জোটে না। পরিবারের বড়রা দিনে কোনরকমে একবেলা খেয়ে বেঁচে আছে। আয় না থাকায় সঞ্চিত অর্থ, গবাদিপশু (গরু ও হাস-মুরগী) বিক্রি করে বেশ কিছুদিন সংসারের অত্যাবশ্যকীয় খরচ মিটিয়েছে। এনজিওর ঋণ কারো কারো জন্য পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করতে একধরণের সহযোগীতা করেছে। কিন্তু ঋণের দায়ভার তাদেরকে আরো দুশ্চিন্তাগ্রস্থ করে তুলেছে।
পঞ্চাশোর্ধ আলেয়া বেগম বললেন, ‘এইখানে জীবন এমনই। বাচ্চা-কাইচ্চা আমাগো লগে থাহে। পোয়াইন ( ছেলেরা) মাছ ধরতে জোগাল (সহযোগীতা) দেয়। মাইয়ান (মেয়েরা) ঘরত সংসারের কামো মায়ের লগে থাহে (থাকে)।’ আলেয়া বেগমের সাত মেয়ে। তাদের কেউ কোনোদিন স্কুলে যায়নি। স্বামী নায়েব আলী কৃষক। এখন জমিতে চাষাবাদ নেই বলে কয়লাখনিতে কাজ খুঁজতে গেছে। আলেয়ার সঙ্গে কথা হয় গত ৩ নভেম্বর। টাঙ্গুয়ার হাওরের গাঁ ঘেঁেষ ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত প্রদেশ মেঘালয়। সারি সারি পর্বত মালার যেখানে শেষ সেখানেই বাংলাদেশের সীমানা শুরু। এই সীমান্তবর্তী অঞ্চলেই এসব গ্রাম। একসময় যাতায়াত দূর্গম ছিলো। বিগত কয়েক বছরে তাহিরপুর উপজেলা সদর থেকে সুনামগঞ্জ জেলা শহর পর্যন্ত সড়ক যোগাযোগ হওয়ায় এসব গ্রামে এখন যাতায়াত করা যায়। তাহিরপুর উপজেলা সদর থেকে এসব গ্রামে যেতে হলে নৌকার বিকল্প নেই। কেউ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাহিরপুর উপজেলা সদর কিংবা শ্রীপুর ইউনিয়ন পরিষদ এলাকায় যেতে হয়। যাতায়াত ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ।
জন্মহার এখানে উচ্চ। ঘনবসতি জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। স্যানিটেশন ব্যবস্থা ও খাবার পানি সংকটও রয়েছে। গ্রামে গ্রামে টিউবওয়েল থাকলেও কোনো কোনোটি মাঝে মাঝে বিকল হয়ে পড়ে। স্থানীয় তাহিরপুর উপজেলা চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, ‘স্কুল ফ্যাসিলিটি না থাকায় প্রজন্মের পর প্রজন্ম এখানে অশিক্ষিত থেকে যাচ্ছে। আমরা বিষয়টি নিয়ে কয়েকদফা আলোচনা করেছি, স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য শিক্ষা অফিসে প্রস্তাবনাও পাঠানো হয়েছে।’