টেকেরঘাটের ‘শহীদ সিরাজ লেক’ হচ্ছে ‘নীলাদ্রি ডিসি পার্ক’, ক্ষোভ
তাহিরপুর উপজেলার টাঙ্গুয়া হাওরতীরবর্তী সীমান্ত এলাকা টেকেরঘাটে পর্যটকদের জন্য পার্ক নির্মানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পর্যটন কর্পোরেশনের অর্থায়নে জেলা প্রশাসন ‘নীলাদ্রি ডিসি পার্ক’ নামের ওই পার্ক নির্মান করছে। গত শুক্রবার (২১ জুলাই) সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক সাবিরুল ইসলাম এই উন্নয়ন কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পর্যটকদের আকর্ষনে ও তাদের সেবা প্রদানের লক্ষ্যে এই পার্কটি নির্মান করা হচ্ছে। তবে পার্কের নামকরণ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয়রা। তাদের মতে, মুক্তিযুদ্ধের সময় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চলে অনেক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। পরবর্তীতে শহীদ সিরাজুল ইসলাম বীর বিক্রম-এর নামে এখানকার হ্রদের নামকরণ করা হয় ‘সিরাজ লেক’। মুক্তিযোদ্ধা সিরাজের নাম বদলে ‘নীলাদ্রি ডিসি পার্ক’ নামকরণের আপত্তি জানিয়েছেন তাঁরা।
জানা যায়, মেঘালয় পাহাড় ঘেষা ট্যাকেরঘাটের ৩২৭ একর ভূমিতে ১৯৬৬ সাল থেকে চুনারপাথর উত্তোলন শুরু হয়। ১৯৯৬ সালে চুনপাথর উত্তোলন ও কারখানার কার্যক্রম বন্ধ হয়ে পড়ে। দীর্ঘদিন চুনপাথর উত্তোলনের ফলে বিশাল এলাকা জুড়ে হ্রদের সৃষ্টি হয়। একপাশে বিশাল মেঘালয় পাহাড়, আরেক পাশে বিস্তৃর্ণ জলরাশির টাঙ্গুয়ার হাওড়; মাঝখানে সবুজ দ্বীপের মতো একটি জায়গায় ছোট্ট হ্রদ। শুষ্ক মৌসুমে যার পানি নীলাভ বর্ণ ধারণ করে।
হাওর, পাহাড় আর এই হৃদ দেখতে প্রতিবছর অসংখ্য পর্যটক ভিড় করেন টেকেরঘাটে। অনেক তরুণ পর্যটকদের কাছে ছবির মতো সুন্দর এই হ্রদ ‘নীলাদ্রি লেক’ নামে পরিচিত। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন ভ্রমনবিষয়ক লেখায় এই নামেই হ্রদটিকে আখ্যায়িত করে থাকেন কিছু পর্যটকরা। এতোদিন কিছুসংখ্যক পর্যটকরা বলে আসলেও এবার খোদ জেলা প্রশাসনের নির্মানাধীন পার্কের নাম রাখা হয়েছে- ‘নীলাদ্রি ডিসি পার্ক’। এমন নামকরণের মাধ্যমে ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে বলে অভিযোগ স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের। স্থানীয় কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা জানান, ’৭১-এ টেকেরঘাট ছিলো মুক্তিযুদ্ধের ৫ নং সেক্টরের বড়ছড়া সাবসেক্টরের হেডকোয়ার্টার। এখান থেকেই সমগ্র ভাটি অঞ্চলের বৃহৎ অংশে যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষন ক্যাম্পও হয়েছে এখানে। শহীদ জগতজ্যোতি দাসের নেতৃত্বাধিন দাসপার্টি এই ট্যাকেরঘাট সাব-সেক্টরেই ছিলো।
মুক্তিযোদ্ধারা জানান, মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে এই সাব-সেক্টরে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সমাহিত করা হয়। এঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন জামালগঞ্জ-সাচনা যুদ্ধে শহীদ দাসপার্টির গেরিলা যোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম বীর বিক্রম। তাঁর স্মৃতিতে এই হ্রদের নামকরণ করা হয় ‘সিরাজ লেক’। হ্রদের পাশেই সিরাজুল ইসলামসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার কবরও সংরক্ষিত রয়েছে। পর্যটক আকর্ষনের নামে নীলাদ্রি পার্ক নামকরণের ফলে শহীদ সিরাজের নাম মুছে ফেলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে দাবি স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখক হাসান মোরশেদ জেলা প্রশসনের ‘নীলাদ্রি পার্ক’ নামকরণকে ‘কফিনের শেষ পেরেক’ আখ্যা দিয়ে ফেসবুকে লেখেন- ডিসি সাহেব ‘নিলাদ্রী’ নাম কোথায় পেলেন? আর আপনি তো প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। ভুয়া এক নামের সাথে আপনার পদবী জুড়ে জনগনের করের টাকায় অপ্রয়োজনীয় পার্ক বানানোর এখতিয়ার আপনাকে কে দিলো? ‘ডিসি পার্ক’ কি জিনিস বলুন তো? মোরশেদ লিখেন- ‘মুক্তিযুদ্ধের একটা সাব-সেক্টর কমান্ড, শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কবর যথাযথ সংরক্ষন না করে উল্টো একজন শহীদ বীর বিক্রমের নাম মুছে দেবার ধৃষ্টতা আপনি করছেন কোন সাহসে?
সুনামগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা ও লেখক বজলুল মজিদ খসরু সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এই এলাকা মুক্তিযুদ্ধের সময়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। শহীদ সিরাজসহ আরো অনেক শহীদের কবর রয়েছে এখানে। পরবর্তীতে ওখানকার লেকটির নামও সিরাজ লেক নামকরণ করা হয়। তিনি বলেন, বর্তমান জেলা প্রশাসক একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। তিনি কেনো মুক্তিযোদ্ধার নাম বাদ দিয়ে অন্য নাম করতে গেলেন তা আমার বোধগম্য নয়। আমি এই লেকটি শহীদ সিরাজের নামে নামকরণের দাবি জানাচ্ছি। এদিকে, এই দাবিতে রোববার জেলা প্রশাসক বরাবরে স্মারকলিপি প্রদান করবে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিরক্ষা পরিষদ, সুনামগঞ্জ। সংগঠনটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা শামস শামীম এ তথ্য জানিয়েছেন।
তবে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক সাবিরুল ইসলাম শনিবার সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকম বলেন, এই হ্রদের নাম একজন মুক্তিযোদ্ধার ছিলো বলে আমার জানা ছিলো না। আগে কেউ আমাকে একথা বলেওনি। শুক্রবারের অনুষ্ঠানে স্থানীয় অনেক মুক্তিযোদ্ধা ও আ্ওয়ামী লীগ নেতারাও ছিলেন। তারাও কোনো আপত্তি করেননি। আজকে আমি বিষয়টি শুনেছি। আমরা কোনো মুক্তিযোদ্ধার নাম বাদ দিতে চাই না। ফলে পুরো এই ভ্যালিটির (ট্যাকেরঘাট) নামকরণই আমরা শহীদ সিরাজুল ইসলামের নামে করে দেবো। পার্ক নির্মান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ওই এলাকায় প্রচুর পর্যটক সমাগম হলেও তাদের জন্য তেমন কোনো সুযোগ সুবিধাই নেই। তাই আমরা ওখানে কিছু বসার জায়গা, টয়লেট, ওয়াশ রুম তৈরি করবো, নৌকাসহ কিছু রাইড থাকবে। যাতে পর্যটকরা আরো আকৃষ্ট হন। এজন্য প্রাথমিকভাবে পর্যটন কর্পোরেশন থেকে ৪৭ লাখ টাকা বরাদ্ধ পাওয়া গেছে বলে জানান তিনি।