তাহলে বিদেশে আমাদের কোনও বন্ধু নেই?
একরামুল হক:
আমরা এতোদিন শুনে আসছি চীন-ভারত আমাদের পরম বন্ধু। একটি অংশ বলেন, ভারত আমাদের প্রকৃত বন্ধু। আবার বাকি অংশটি বলেন, চীনই অকৃত্তিম বন্ধু। আমাদের নেতা-নেত্রীরাও প্রায়ই বলে থাকেন, বিদেশে আমাদের কোনও প্রভু নেই, বন্ধু আছে। বন্ধু অনেকেই আছে, তবে তারমধ্যে এ দু’টির কদর একেবারেই ভিন্ন। এই বন্ধুদের জন্য আমরা বিভিন্ন সময়ে অনেক ত্যাগ স্বীকারও করে থাকি। এই দু’টি দেশের পণ্যের বাজার হিসেবেই আমরা বরাবর ব্যবহৃত হয়ে আসছি। পশ্চিমা দেশগুলোতে গার্মেন্টস পণ্য রফতানি, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সসহ বিদেশ থেকে আমরা যত বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে থাকি তার সিংহভাগই নিয়ে যাচ্ছে চীন এবং ভারত। বিশ্বের ১৯৮টি দেশের সঙ্গে আমাদের আমদানি-রফতানির বাণিজ্য রয়েছে। তবে আমাদের মোট আমদানি বাবদ ব্যয়ের প্রায় ৩৬ শতাংশ এই দুটি দেশ দখল করে রেখেছে। অন্যদিকে এই দু’টি দেশ থেকে রফতানি বাবদ আয় আসে মাত্র ৩.৯১ শতাংশ। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, আর্থিক দিক দিয়ে এরা আমাদের কাছ থেকে ব্যাপকভাবে লাভবান হচ্ছে। এছাড়া অন্যান্য লাভ তো আছেই। অথচ, আমাদের এই কঠিন সময়ে দেশ দুটোর কাউকে পাশে পাচ্ছি না।
পার্শ্ববর্তী মায়ানমার থেকে লাখ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান বাংলাদেশে এসে প্রবেশ করছে। সেদেশের নোবেল বিজয়ী দানব সু চি সরকার, বৌদ্ধ সন্ত্রাসী ও সামরিক বাহিনীর বর্বর হত্যা-নির্যাতন থেকে পালিয়ে প্রাণ বাঁচাতে এদেশে ঢুকতে বাধ্য হচ্ছে নিরীহ রোহিঙ্গা মুসলমানরা। মুসলমান- শুধু এই অপরাধে তাদের উপর এমন হত্যা ও ধ্বংসলীলা চালানো হচ্ছে। মুসলমান হিসেবে ঈমানী দায়িত্ব ও মানবিক দিক বিবেচনায় এদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের একান্ত কর্তব্য। সেই দায়িত্ব পালনের জন্য সরকার-বিরোধীদলসহ সবাই পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তবে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এই রোহিঙ্গা ইস্যুটা সার্বিকভাবে আমাদের জাতীয় জীবনে এখন এক সংকটময় অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এই সংকট উত্তোরণের জন্য মায়ানমারের বিরুদ্ধে বিশ্বে জনমত গঠনসহ আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, সবচেয়ে বড় দু’টি বন্ধুই আমাদের জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা পাশে তো নেই-ই, বরং আমাদের শত্রুদের সঙ্গে গলাগলি করতে দেখা যাচ্ছে তাদের।
ভারত মিয়ানমারের সঙ্গে সুর মিলিয়ে নিরীহ-নির্র্যাতিত রোহিঙ্গাদেরকে ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যা দিচ্ছে। এমনকি সর্বশেষ খবরে দেখা যাচ্ছে, ভারতের প্রতিনিধিদল মায়ানমার গেছে ‘অস্ত্রবিক্রি’র আলোচনা করতে। অন্যদিকে চীন রোহিঙ্গাদের পাশে তো নেই-ই, উল্টো বিশ্ববাসীর ধিক্কার ও পদক্ষেপ ঠেকাতে মিয়ানমারের পক্ষে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। এই দুটো দেশ ছাড়াও বাংলাদেশের আরেক পরম বন্ধু রাষ্ট্র রাশিয়াও আজ মায়ানমারের বর্বরতম হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসলীলার পক্ষে জোরালো ভূমিকা রাখছে। এটা কে না জানে, এ রাশিয়া থেকেই আমরা বিশাল বাজেটের পরমাণু বিদ্যুৎ কিনছি। ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাশিয়া সফরকালে ১০০ কোটি ডলারের সমরাস্ত্র ক্রয়ের চুক্তিও করে এসেছেন। এ দেশগুলো আমাদের পাশে নৈতিক সমর্থন তো নয়ই, উল্টো আমাদের বিপক্ষে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। রাশিয়া হুংকার দিয়ে বলেছে, রোহিঙ্গা ইস্যু নাকি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ ইস্যু। এটি নিয়ে বিশ্বকে নাক গলাতে নিষেধ করেছে তারা।
এসব দেখে আমি ঘোরের মধ্যে পড়েছি, তাহলে কী বিদেশে আমাদের কোনও বন্ধু নেই? আমরা যাদেরকে এতোদিন বন্ধু হিসেবে ভাবতাম এরা কেউই আমাদের বন্ধু নয়, শোষক। ১৯৭১ সালে ভারত আমাদের পাশে ছিল। আমরা নিশ্বাসে-বিশ্বাসে সেই কথা স্মরণ করে চলেছি। সমালোচকরা কেউ কেউ যদিও বলেন, ‘৭১-এ ভারত তার স্বার্থেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমাদেরকে সহায়তা করেছে। সমালোচকদের এমন মন্তব্যে আমরা কান দেই না। আমরা বিশ্বাস করি, ভারত নিখাদ বন্ধু। তাই, স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৬ বছর পরেও আমরা ভারতীয় যোদ্ধাদের বা যুদ্ধে যারা ভূমিকা রেখেছিল এদের খুঁজে খুঁজে এনে পদক দিচ্ছি। কিন্তু, ৭১ সালের পর আর কী কখনো ভারতকে সামান্যতমও আমাদের উপকারে পেয়েছি? না, পাইনি। বরং পানি বণ্টনসহ বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক ইস্যুতে ভারত আমাদের উপর একের পর এক নিপীড়ন চালিয়েছে। শোষণ তো করেছেই।
তারপরও আমরা বরাবর বুক চিতিয়ে দিয়ে গেছি ভারতকে। যে কারণে ভারতের পণ্য এতোবেশি আসার সুযোগ পাচ্ছে বাংলাদেশে। এমনকি সর্বশেষ, ভারতের আবদার রক্ষা করতে গিয়ে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে আমরা অনেক বড় ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছি। দেশি-বিদেশি পরিবেশবিদ, ইউনেস্কোসহ সবাই যখন বিরুদ্ধে, সবার মতামত ও বিরোধিতাকে উপেক্ষা করে ভারতের ইচ্ছের কাছে আমরা আত্মসমর্পণ করেছি। আমাদের অমূল্য সম্পদ- বিশ্বের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবনকে আমরা ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছি। চীন থেকে আমরা বিমান-ট্যাংকসহ একের পর এক সমরাস্ত্র কিনছি। সবশেষে সাবমেরিনও ক্রয় করেছি। এছাড়া অন্যান্য বাণিজ্য সুবিধা তো দিচ্ছিই। তারপরও চীন আমাদের পাশে নেই, এ দুঃখের কথা কাকে বলি? কোথায় রাখি এ দুঃখ?
সরকারি হিসাবে দেখা যাচ্ছে, আমাদের সবচে’ বেশি বাণিজ্য ঘাটতি চীন ও ভারতের সঙ্গে এবং তা অস্বাভাবিকই বলা চলে। এ ঘাটতির পরিমাণ প্রতি বছর উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছেই। গত ১০ বছর এ কথাটি ব্যাপকভাবে শুনে আসছি, পার্শ্ববর্তী ভারত আমাদের পরম বন্ধু। এদিকে চীনও আমাদের দীর্ঘদিনের বন্ধু হিসেবে পরিচিত। আর এই ১০ বছরের হিসাবেই দেখা যায়, ভারত এবং চীন উভয়ের সঙ্গেই আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে প্রায় চার গুণ। ২০০৬-০৭ অর্থবছরে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ২৪৪ কোটি ৪৪ লাখ ডলারের। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এ ঘাটতি বেড়ে দাঁড়ায় ৮৮৩ কোটি ৭৬ লাখ ডলারে। অন্যদিকে, ২০০৫-০৬ অর্থবছরে ভারতের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ১৬০ কোটি ৬৫ লাখ ডলার, যা ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়ায় ৫৯৭ কোটি ৩০ লাখ ডলার।
এই দুঃসময়ে আমরা কাকে পাশে পেলাম? বিশ্বের অন্য মোড়ল দেশগুলোকেও সেইভাবে পাচ্ছি না। তারা শুধু বড় বড় বুলি আওড়াচ্ছে। কার্যকর কোনও পদক্ষেপ নিচ্ছে না। আমরা এতোদিন যাদেরকে বন্ধু হিসেবেই ভাবিনি সেই তুরষ্কই সবার আগে এগিয়ে এসেছে। আমাদের সরকারি হিসাবে দেখা যাচ্ছে, তুরষ্কের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক দিক দিয়েও আমরা বরাবর লাভবান। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তুরষ্কে ৬৩ কোটি ১৬ লাখ ডলারের পণ্য রফতানি করেছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে একই সময়ে বাংলাদেশ আমদানি করেছে ২১ কোটি ২৩ লাখ ডলারের পণ্য। ৪১ কোটি ৯৩ লাখ ডলার অর্থাৎ ৩৩৫৫ কোটি টাকার বাণিজ্য উদ্বৃত্ত এক বছরে। সেই দেশটিই আবার এই দুঃসময়ে সবার আগে আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সূতরাং আমি মনে করি, নিজেদের জাতীয় স্বার্থেই বন্ধুত্বের পুনর্মূলায়ন করতে হবে।বিপদেই বন্ধুর পরিচয়- এরকমের একটা প্রবাদ আছে বাংলায়। এমন একটা বিপদের সময় আমাদের নিশ্চয়ই বন্ধু-শত্রু চিনতে কষ্ট হচ্ছে না। তবে এটি ভবিষ্যতে যাতে না ভুলে যাই সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
(সাপ্তাহিক শীর্ষ কাগজে ২০১৭ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত)