তাহিরপুরের ৩ শিশুকে আশুগঞ্জের রাইসমিলে আটকে রাখার অভিযোগ
আল-হেলাল : শিশুশ্রম আইনত নিষিদ্ধ হলেও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আশুগঞ্জ উপজেলার একটি অটোমেটিক রাইছমিলে জোর করে আটককৃত ৩ শিশুকে বাধ্য করা হচ্ছে ঝুকিপূর্ণ শিশুশ্রমে। আটককৃত শিশুরা হচ্ছে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার বালিজুরি গ্রামের কামরুল ইসলামের পুত্র মুবাশ্বির (৭) এবং শফিকুল ইসলামের ২ পুত্র যথাক্রমে তালহা (৬) ও হৃদয় (৪)।
বাইরের জেলা থেকে বিভিন্ন দালাল মাধ্যমে শিশুদেরকে সুকৌশলে আয়ত্বে নিয়ে এই কাজে নিয়োজিত করে শিশুদের উপর শারীরিক নির্যাতন পর্যন্ত চালানো হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আশুগঞ্জ থানার মেসার্স দানিস বয়লার রাইস মিলের প্রোপাইটর সিদ্দিকুর রহমানের পুত্র বাবুল মিয়ার বিরুদ্ধে। আশুগঞ্জ উপজেলা খাদ্য বিভাগের তালিকাভূক্ত মোট ১৩৯টি সিদ্ধ রাইছমিলের মধ্যে ৬৩ নং ক্রমিকভূক্ত ও ১৬১১ নং লাইসেন্সধারী এই চালকলটি উপজেলার সোহাগপুর গ্রামে অবস্থিত।
জানা যায়,গত ডিসেম্বর মাসে সুনামগঞ্জ জেলার জামালগঞ্জ থানার নয়াহালট গ্রামের কালা মিয়ার পুত্র কামাল মিয়া এলাকায় এসে,দানিস অটোমেটিক রাইছমিলে কাজের সুযোগ আছে বলে আটককৃত শিশুদের পিতা সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার বালিজুরি গ্রামের কামরুল ইসলাম ও শফিকুল ইসলামসহ তাদের স্ত্রী সন্তানদেরকে সেখানে ধান শুকানোর কাজে নিয়ে যায়। কিন্তু দিনের পর দিন নিয়মিত কাজ করার পরও মিল কর্তৃপক্ষ তাদেরকে যথারীতি পারিশ্রমিক পরিশোধ করেনি। গত ঈদুল ফিতরের সময় পরিবার দুটি বাড়িতে আসতে চাইলে মিল কর্তৃপক্ষ উল্টো তাদের কাছে মিলের টাকা পাওনা আছে বলে অন্যায় অজুহাতে বাড়িতে যেতে দেয়নি। এরপর থেকে বাড়ির কথা বললেই মিল কর্তৃপক্ষ পরিবার দুটির উপর শারীরিক নির্যাতন চালায়। একপর্যায়ে নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে গত ৮ জুন মঙ্গলবার সকাল ৮টায় পিতামাতা তাদের সন্তানদেরকে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে মিলের ম্যানাজার ও সর্দারগন তাদেরকে আটক করে ২ পরিবারের ৩ সন্তানদেরকে জিম্মি করে রেখে দেয়। অসহায় পিতামাতা বাধ্য হয়ে সন্তানদেরকে জিম্মি রেখে কোনরকমে প্রাণ নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসেন।
ঘটনাটি জেনে বালিজুরি গ্রামের লোকজন বিভিন্ন মাধ্যমে মিলের সর্দার কামাল মিয়া কে কল করলে সে মিলের নামে ২ লাখ টাকা পাওনা দাবী করে। আটককৃত সন্তানদের পিতা অসহায় কামরুল ইসলাম ও শফিকুল ইসলাম বলেন, মিলের মালিক আমাদের কাছে আদৌ কোন টাকা পয়সা পায়না। বরং আমরা তাদের মিলে কাজ করে ঠিকমতো খাবার ও পারিশ্রমিক পাইনি। আটককৃত শিশুদের দাদা সাফির উদ্দিন তার নাতিদের উদ্ধারের জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কঠোর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে মিলের সর্দার কামাল মিয়া আটককৃত ৩ শিশু ঐ মিলেই আছে স্বীকার করে বলেন, আমি গত ৬ বছর ধরে আছি। শফিকুল মিয়া সম্পর্কে আমার মামা হন। সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার কারেন্টের বাজারের ফারুক মিয়াসহ তারা ৩টি পরিবার আমাদের মিলে আসে। তাদের ৩ পরিবারকে অগ্রীম নন জুডিসিয়েল সাদা স্টাম্পে স্বাক্ষর ও ভোটার আইডি রেখে এক বছরের জন্য চুক্তি করে আমি ৩ লাখ টাকা প্রদান করেছি। কিন্তু ৯ মাসের ব্যবধানে তারা পালিয়ে যাওয়ায় আমরা বাধ্য হয়ে তাদেরকে আটক করার চেষ্টা করি। একপর্যায়ে ৩ শিশুকে রেখে তাদের অভিভাবকরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
অন্যদিকে শফিকুল ইসলাম ও কামরুল ইসলাম বলেন, কামাল মিলের সর্দারের পাশাপাশি ঐ মিলের দালাল। সে আমাদেরকে প্রতিদিন ১২ শত টাকা পারিশ্রমিক দেওয়ার কথা বলে ৩ পরিবারকে খাটায়। কিন্তু কোন টাকা পারিশ্রমিক দেয়নি। আমরা ঈদুল ফিতরের সময় বাড়িতে আসতে চেষ্টা করেছি। আমাদেরকে পারিশ্রমিক পরিশোধ করাতো দূরের কথা বাড়িতে পর্যন্ত আসতে দেয়নি। অগ্রিম কোন টাকাপয়সা না দিয়েই আমাদের কাছ থেকে নন জুডিসিয়েল সাদা স্টাম্পে কামাল ও বাবুল মিয়া নাম দস্তখত নিয়েছে। আমরা কাজ করতে গিয়ে তাদের কাছে প্রতারিত হয়েছি।
জানতে চাইলে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ঘটনার ব্যাপারে কোন অভিযোগ পেলে আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে শিশু উদ্ধারে ব্যবস্থা নেবো। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পুলিশ সুপার আনিছুর রহমান বলেন, শিশু উদ্ধারের ব্যাপারে অভিভাবকরা নিজের থানায় অভিযোগ দায়ের করলে এবং সংশ্লিষ্ট থানা আমাদেরকে জানালে আমরা শিশুদেরকে উদ্ধার করে দিতে পারি।
আশুগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার অরবিন্দ বিশ্বাস বলেন, অভিভাবকদের পক্ষ হতে কেউ যদি বাচ্চাগুলো নেয়ার জন্য আমার কাছে আসে তাহলে আমি এ ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারি। তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ রায়হান কবির বলেন,বিষয়টি জেনেছি এবং শিশুদের উদ্ধারের চেষ্টা করছি। তাহিরপুর থানার ওসি আব্দুল লতিফ তরফদার বলেন, মিল মালিক, দালাল ও মজুরদের মধ্যে যাই ঘটে থাকুক না কেন সেটা পরে দেখা যাবে। আমরা আপাতত শিশুগুলো উদ্ধারের জন্য চেষ্টা করছি।