আজকাল গুম আর অপহরণ এ বিষয়গুলো আমাদের কাছে খুব সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজ এ, তো কাল সে গুম হচ্ছে। বাড়িতে ঈদ করে ঢাকায় ফেরার আগেই উদ্বেগ হওয়ার মতো ঘটনাটি ঘটে। মঙ্গলবার ভোরে ঢাকার শ্যামলীতে নিজের বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর নিখোঁজ হন কবি-প্রাবন্ধিক ফরহাদ মজহার, যিনি ডানপন্থি অধিকারকর্মী হিসেবে পরিচিত। যতদূর জানা যায়, ওষুধ কেনার জন্য বাসা থেকে বের হন কবি ও কলামিস্ট ফরহাদ মজহার। এরপরই তাকে একদল দুর্বৃত্ত চোখ বেঁধে সাদা রঙের মাইক্রোবাসে তুলে নেয়। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে এসব কথাই জানিয়েছেন তিনি।

নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে একটি কলের বিষয়ে নানা ধরনের কানাঘুষা হলেও প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণ করে প্রকৃতপক্ষে ফরহাদ মজহারের ফোন রেকর্ডে এর কোনো অস্তিত্ব পাননি গোয়েন্দারা। উদ্ধার হওয়ার পর তার সেলফোন ঘেঁটে কোনো অ্যাপস্ থেকেও কল আসা কিংবা যাওয়ার প্রমাণ পাননি গোয়েন্দারা। বিষয়টি নিয়ে রীতিমতো রহস্য দানা বাঁধছে বিভিন্ন মহলে। তাহলে আমাদের সবারই প্রশ্ন— কার ফোন পেয়ে ভোররাতে তিনি বাসা থেকে বের হন?

অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণের পর কোনো প্রমাণ না পাওয়া গেলে ফরহাদ মজহার নিজেই বলতে পারবেন তিনি কেন এত ভোরে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন। আবার তার ফোন থেকে মুক্তিপণের জন্য টাকা চাওয়া হয় বলে দাবি পরিবারের। ফরহাদ মজহারের স্ত্রী ফরিদা আখতার আদাবর থানায় লিখিত অভিযোগ করার পর পুলিশ অনুসন্ধান শুরু করে। অপহৃত হওয়ার পর ফরহাদ মজহার তার স্ত্রীকে মোবাইলে ফোন করে জানান, কে বা কারা তাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছেন। তাকে মেরেও ফেলা হতে পারে। ৩৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। তবে কীভাবে তিনি যশোর পৌঁছালেন বা কারা তাকে সেখানে নিয়ে গেছে সেসব বিষয়ে এখনো পরিষ্কার নয় পুলিশ।

আমরা জানতে পেরেছি, খুলনা মহানগরীর নিউমার্কেট এলাকায় গ্রিল হাউজ রেস্তোরাঁ। বিত্তবান ও প্রভাবশালীরা সাধারণত সেখানে ভিড় জমান। তবে সোমবার রাতে প্রাবন্ধিক ফরহাদ মজহার সেখানে অবস্থান করেছেন ও খাবার খেয়েছেন জানাজানি হওয়ার পর থেকে আলোচনায় উঠে আসে গ্রিল হাউজ রেস্তোরাঁ। খবর পেয়ে রাতে র‌্যাব-৬-এর সদস্যরা ওই রেস্তোরাঁটিকে ঘিরে ফেলেন। তবে তার আগেই তিনি সেখান থেকে বের হয়ে যান। এদিকে সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেল ও ফেসবুকের মাধ্যমে এ খবর ছড়িয়ে পড়লে রাত থেকেই রেস্তোরাঁটি ঘিরে মানুষের আগ্রহ বাড়তে থাকে। আগতরা সবাই কর্মচারীদের কাছে রাতের ঘটনাটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চান। এ সময় অনেককে রেস্তোরাঁটির সামনে দাঁড়িয়ে ছবিও তুলতে দেখা যায়। রেস্তোরাঁর মালিক আবদুল মান্নান জানান, ফরহাদ মজহার সেখানে ভাত, ডাল ও সবজি খেয়েছেন। রেস্তোরাঁর কর্মচারীরা যখন খাবার আনতে যান, তখন ৬-৭ মিনিট তিনি চোখ বন্ধ করে ছিলেন। এ সময় তাকে ক্লান্ত দেখা যায়। পরে টিভি চ্যানেলের খবর দেখে তিনি ফরহাদ মজহার সম্পর্কে জানতে পেরে র‌্যাবকে জানান।

লেখক ও কলামিস্ট ফরহাদ মজহারকে পুলিশ উদ্ধার করলেও কারা তাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল, সেই রহস্য এখনো উদঘাটন করা যায়নি। এই ঘটনার তদন্তের ভার দেয়া হয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখাকে। উদ্ধারেরর পর কলামিস্ট ফরহাদ মজহার হাসপাতালে চিকিৎসা নেন এবং আদালতে একটি জবানবন্দী দেন। কিন্তু তাতে এখনো এ ঘটনা নিয়ে তিনি মুখ খোলেননি, তার পরিবারের তরফ থেকেও নতুন কিছুই বলা হচ্ছে না। এখন প্রশ্ন হলো, ফরহাদ মাজহারের মতো একজন ব্যক্তিকে কারা লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করতে পারে? কে তুলে নিয়ে গেলো  লেখক মজহারকে? কেনইবা এত পথ পাড়ি দিয়ে তাকে খুলনা নিয়ে গেল? আর সেখানে নিয়ে তাকে ছেড়েই বা দিল কেন?

পত্রিকা মারফত জেনেছি, পুলিশ বলছে, ফরহাদ মজহার নিখোঁজ হওয়ার মামলাটি গোয়েন্দা শাখা বা ডিবিকে তদন্ত করবার জন্য গতকালই নির্দেশ দেয়া হয়েছে।  এ নিয়ে লেখক মজহার পুলিশ ও আদালতকে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা থেকে এখন পর্যন্ত যা জানা যাচ্ছে, তিনি কাউকে চিহ্নিত করতে পারেননি। এ নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলছেন। তবে আমার মনে হয়, অবশ্যই তাকে অপহরণ করা হয়েছিল। তবে তার এমন কোনো ব্যক্তিগত সমস্যা কারো সঙ্গে নেই যে এমন কাজ করবেন। আমাদের জানা নেই, পরিবারও সেটা মনে করে না। আরেকটা হচ্ছে প্রধানত রাজনৈতিক, তিনি লেখালেখি করেন, তার অবস্থান পরিস্কার। আর তিনি সোচ্চার আছেন কোন কোন বিষয়ে, জাতীয় ও আঞ্চলিক রাজনীতিতে কোন জায়গাগুলো নিয়ে তিনি কী কথা বলেন এবং কাদের জন্য তিনি মাথাব্যথার কারণ এটা আমরা সবাই জানি, সবাই বুঝি।

ফরহাদ মজহারের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা নিয়ে নানারকম ষড়যন্ত্র তত্ত্ব শোনা যাচ্ছে। বিরোধী দল বিএনপি শিবির থেকে অভিযোগ হয়েছে যে, সংবিধান সংশোধনীর ইস্যু থেকে মানুষের নজর ফেরাতে রাষ্ট্র এই ঘটনা ঘটিয়েছে। আবার সরকারি দল যারা সমর্থন করেন, যারা ফরহাদ মজহারকে সরকারবিরোধী তকমা দিতে চান, তারা বলছেন, মজহার নিজেই এটা করেছেন আলোচনায় থাকার জন্য। কেউ কেউ মনে করে বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেসব গুমের ঘটনা ঘটায়, এটা সেরকমই একটা ঘটনা। আরো একটা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব রয়েছে, যেটাতে বলা হচ্ছে, ফরহাদ মজহার নিখোঁজ হওয়ার আগের দিন একটি সংবাদ সম্মেলনে ছিলেন, যেখানে ভারতে গোরক্ষার নাম করে মুসলিমদের হত্যার প্রতিবাদ জানানো হয়। সেই সংবাদ সম্মেলনের জের ধরে ফরহাদ মাজহার নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাটিকে একটি আন্তর্জাতিক চক্রান্ত বলে মনে করছেন কেউ কেউ, যে তত্বের একজন সমর্থক মুস্তাইন জহির স্বয়ং। কিন্তু পুলিশ বলছে, তারা তদন্তের একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। এ নিয়ে কথা বলার সময় এখনো আসেনি।

এখন ফরহাদ মজহারের সাথে আসলে কি ঘটেছিল সেটা জানার উপায় হচ্ছে সুস্থ হয়ে তিনি যদি গণমাধ্যমের সাথে কথা বলে ঘটনাপ্রবাহের বিবরণ প্রকাশ করেন। নয়তো এর জন্য অপেক্ষা করতে হবে পুলিশের তদন্ত শেষ হওয়া পর্যন্ত। আমরা সাধারণ যারা, তারা জানতে চাই, কার ফোন পেয়ে ফরহাদ মজহার বাসা থেকে বের হয়েছিলেন? আর তিনি যদি অপহরণ হয়ে থাকেন বা এ নিয়ে নাটক করে থাকেন, সেটা কেন?

হাসান হামিদ. লেখক- গবেষক ও কবি

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn