দুই বন্ধু আজাদ এবং রনজিত সরকারের দ্বন্দ্বে যাচ্ছে একের পর এক প্রাণ
তাঁরা দুইজনই বন্ধু ছিলেন। দুজনের বাড়ি টিলাগড়ে। টিলাগড় কেন্দ্রিক ছাত্রলীগের যে গ্রুপ গড়ে উঠেছে, তাঁর নেতৃত্ব দিয়েছেন তাঁরা দু’জন মিলে। একসাথে তাঁরা ছাত্ররাজনীতিও করেছেন। তবে সাম্প্রতিককালে এই দুই বন্ধর মধ্যে দেখা দিয়েছে দ্বন্দ্ব। আর এই দুই দ্বন্দ্বে প্রাণ হারাচ্ছে একের পর এক সাধারণ ছাত্রলীগ কর্মী। এরা দুজন হলেন মহানগর আওয়ামী লীগের শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক আজাদুর রহমান আজাদ এবং জেলা আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক রনজিত সরকার। জানা গেছে, একসময় হাতে হাত রেখেই টিলাগড়কেন্দ্রিক ছাত্ররাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন আজাদ-রণজিত। তাদের প্রতিপক্ষ ছিল বাবলা চৌধুরী ও যুবলীগ নেতা আসাদুজ্জামান আসাদের গ্রুপ। ক্যাম্পাসের ভেতরে বাবলা চৌধুরী ও আসাদ গ্রুপের নেতৃত্ব দিতেন পঙ্কজ পুরকায়স্থ, হোসাইন, রুহেলসহ কয়েকজন। অন্যদিকে আজাদ-রণজিৎ গ্রুপের নেতৃত্ব দিতেন হিরণ মাহমুদ নিপু ও জাহাঙ্গীর আলম। এর বাইরেও ক্যাম্পাসভিত্তিক একটি গ্রুপ টিলাগড়ের বাইরে আওয়ামী লীগ নেতাদের আশীর্বাদ নিয়ে ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তার করে যাচ্ছিল।
ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একসময় একক আধিপত্য ছিল রণজিত-আজাদ গ্রুপের। কিন্তু টিলাগড় এলাকার আরেক বাসিন্দা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমানের আশীর্বাদ পেয়ে আসাদ-বাবলা গ্রুপও চাঙা হয়ে ওঠে। তবে তারা সে অবস্থা ধরে রাখতে পারেনি। কর্মীদের মধ্যে বিরোধের জেরে একসময় দুর্বল হয়ে আসে বাবলা-আসাদ গ্রুপ। একক নেতৃত্ব পেয়ে আলাদা দুটি বলয় গড়ে ওঠে আজাদ ও রণজিতের। নিজেদের মধ্যেই দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন এ দুগ্রুপের নেতারা। বাইরে এ দুই নেতা আন্তরিকতা দেখালেও মূলত প্রভাব ধরে রাখতেই এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে একের পর এক সংঘর্ষে জড়ায় বিবদমান গ্রুপ দুটি। এর মধ্যে ক্যাম্পাস থেকে জেলা ছাত্রলীগে স্থান পান পঙ্কজ পুরকায়স্থ ও হিরণ মাহমুদ নিপু। কিন্তু নিজেদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য দুজনই জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও ভারপ্রাপ্ত সভাপতির পদ হারান। বহিষ্কারের পরও তারা ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তারে মরিয়া হয়ে ওঠেন।একসময় আজাদের নিয়ন্ত্রণে আসেন পঙ্কজ ও রায়হান চৌধুরী। আর রণজিৎ গ্রুপের নেতৃত্ব দিতে শুরু করে দেবাংশু দাশ মিঠু ও হিরণ মাহমুদ নিপু। রায়হান চৌধুরী জেলা কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর ক্যাম্পাসে প্রভাব বিস্তারে শুরু করে নতুন তৎপরতা।
গ্রুপিং ও ধারাবাহিক খুনের ব্যাপারে মুখ খুলতে রাজি হননি রণজিত সরকার। রনজিতের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আমি সারাদিন সিলেটের বাইরে থাকি। সারাদিন সুনামগঞ্জে থাকি। কেবল রাতে এসে বাসায় ঘুমাই। তাই টিলাগড়ের বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই। আর আজাদুর রহমান আজাদের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। এই দুই নেতার দ্বন্দ্বে গত চার মাসে টিলাগড় এলাকায় খুন হয়েছেন তিন ছাত্রলীগকর্মী। সর্বশেষ রবিবার রাতে খুন হন তানিম খান। নগরীর টিলাগড় এলাকায় তাকে খুন করে ছাত্রলীগের প্রতিপক্ষ গ্রুপ। সতীর্থ ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের অভিযোগ, আজাদুর রহমান আজাদের নির্দেশে তানিম খুন হয়েছে। খুনের ঘটনায় যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদের মধ্যে আজাদুর রহমানের ভাতিজাও আছেন বলে তারা দাবি করেন। তানিম হত্যার পর ছাত্রলীগের একটি পক্ষ আজাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, টিলাগড়কেন্দ্রিক রাজনীতি আর এমসি কলেজে প্রভাব বিস্তার করতেই আজাদুর রহমান আজাদের নির্দেশে এসব খুনের ঘটনা ঘটছে। সাবেক এ দুই ছাত্রনেতার দ্বন্দ্বে বিপর্যস্ত টিলাগড় এলাকায় অবস্থিত দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমসি কলেজ ও সরকারি কলেজ। তাদের মিত্রতা ও শত্রুতা নিয়ন্ত্রণ করে কলেজ ছাত্রলীগের রাজনীতিকে। এলাকায় আধিপত্য ধরে রাখতে এ নেতারা ব্যবহার করছেন ছাত্রলীগকে। গত কয়েক বছরে আজাদ-রণজিত দ্বন্দ্বই পরিচয় হয়ে উঠেছে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমসি (মুরারিচাঁদ) কলেজ ছাত্রলীগের। কলেজ ছাত্রলীগের নাম ভাঙিয়ে চলছে অপরাধচর্চা। নিজ সংগঠনের কর্মীকে খুন ও পঙ্গু করে দেওয়ার মতো অভিযোগ তো আছেই, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কথায় কথায় অস্ত্রের মহড়া দেওয়া- এমনকি শতবছরের পুরনো ছাত্রাবাস পুড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগও আছে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। তাদের কারণে অন্তত দুদফা বাতিল করতে হয়েছে জেলা ছাত্রলীগের কমিটি।
এসব ঘটনায় দুয়েকটি মামলা হলেও আসল হোতারা পার পেয়ে যাচ্ছেন। বিচার প্রলম্বিত করে কৌশলে বাকিদেরও রেহাই দেওয়া হচ্ছে। শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, টিলাগড় এলাকায় ছাত্রলীগের সন্ত্রাসে অস্থির স্থানীয় বাসিন্দারাও। নিজেদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে একের পর এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছেন তারা। গত ৪ জানুয়ারি সংগঠনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতেও অস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে জড়ান তারা। ধারাবাহিক খুন ও বিচারহীনতা : আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালের ১২ জুলাই অভ্যন্তরীণ বিরোধের জের ধরেই টিলাগড়ে খুন হন এমসি কলেজের গণিত বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ও ছাত্রলীগকর্মী উদয়েন্দু সিংহ পলাশ। এ ঘটনায় ছাত্রলীগের আটজনের নাম উল্লেখ করে থানায় মামলা করেন পলাশের বাবা বীরেশ্বর সিংহ। গত বছর ১৩ সেপ্টেম্বর দুপুরে সিলেটের শিবগঞ্জে প্রতিপক্ষ গ্রুপের ছুরিকাঘাতে নিহত হন ছাত্রলীগকর্মী জাকারিয়া মোহাম্মদ মাসুম। এমসি কলেজ ছাত্রলীগ নেতা টিটু চৌধুরীর অনুসারী কয়েকজন ছাত্রলীগকর্মী মাসুমের ছোটভাই খালেদকে শিবগঞ্জ লামাপাড়া এলাকায় জিম্মি করে। এর পর তারা খালেদের মাধ্যমে মাসুমকে খবর দিয়ে এনে ছুরিকাঘাতে খুন করে। এ হত্যাকা-ের ঘটনায় নিহতের মা আতিয়া বেগম বাদী হয়ে শাহপরাণ থানায় এমসি কলেজ ছাত্রলীগ নেতা টিটু চৌধুরীসহ ২২ জনকে আসামি করে মামলা করেন। খুনের পর রণজিৎ গ্রুপ ছেড়ে আজাদ গ্রুপে যোগ দেন টিটু চৌধুরী। এক মাসের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্র করে ১৬ অক্টোবর নগরীর টিলাগড়ে ছাত্রলীগের দুপক্ষের সংঘর্ষ হয়। এতে ছুরিকাঘাতে ওমর আলী মিয়াদ নিহত হন। এ ঘটনায় নিহতের বাবা মো. আবুল মিয়া জেলা ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক এম রায়হান চৌধুরীসহ ১০ নেতাকর্মীর নাম উল্লেখ করে মামলা করেন। এ ঘটনার জেরে বাতিল করা হয় ছাত্রলীগের জেলা কমিটি।
সর্বশেষ গত ৬ জানুয়ারি টিলাগড় পয়েন্টে ছুরিকাঘাতে নিহত হন সরকারি কলেজের ছাত্রলীগকর্মী তানিম খান। তানিম ছাত্রলীগের রঞ্জিত গ্রুপের অনুসারী। গ্রুপের পক্ষ থেকে এ ঘটনার জন্য প্রতিপক্ষ আজাদ গ্রুপকে দায়ী করা হয়েছে। জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি হিরণ মাহমুদ নিপু বলেন, গত বৃহস্পতিবার ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে কলেজে অস্ত্র নিয়ে প্রবেশ করতে না পেরেই আজাদুর রহমান আজাদ ও রায়হান চৌধুরীর অনুসারীরা এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। তাদের সঙ্গে আজাদুর রহমান আজাদের ভাতিজা আজলা ছিলেন বলে দাবি করেন তিনি। তবে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন রায়হান চৌধুরী। তিনি বলেন, আমি এসবের কিছুতে নেই। আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।এদিকে একের পর এক হত্যাকান্ড হলেও বিচার হয়নি একটিরও। ২০১০ সালে পলাশ হত্যাকাণ্ডের বিচার না পেয়ে হতাশ তার পরিবার।এ ব্যাপারে মহানগর পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার এমএ ওয়াহাব বলেন, রাজনৈতিক প্রভাবেই এসব হত্যাকাণ্ড ঘটছে। আমরা দোষিদের গ্রেপ্তারে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে থাকি। বাকিটা আদালতের ব্যাপার। অস্ত্রধারীদের ছবি প্রকাশ হলেও তাদের আটক করা হচ্ছে না কেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে।