দেশপ্রেম যার অনির্বাণ শিখা-হামিদ মোহাম্মদ
বড়দিনে জন্ম তার, বড় মনের মানুষ তিনি। সেই মানুষটির সঙ্গে যতই মিশেছি ততই তার সম্পর্কে জানার এবং লেখার আগ্রহ বেড়েছে। ২৫ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক আবু মুসা হাসানের জন্মদিন। মহান ভাষা আন্দোলনের বছর ১৯৫২ সালে জন্মেছেন তিনি। গত জন্মদিনে এই গুণী মানুষটি নিয়ে লিখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তিনি সুযোগ দেননি। এবার আমি নাছোড়বান্দা। তাকে জন্মদিনের অগ্রিম শুভেচ্ছা জানিয়ে বললাম, আপনার সম্পর্কে অনেক কিছু জানি, আরও কিছু বিশদভাবে জানতে চাই। আবু মুসা হাসানের রয়েছে এক বর্ণাঢ্য জীবন। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানসহ ছাত্র রাজনীতিতে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করার জন্য জীবন বাজি রেখে গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে। কর্মজীবনে ছিলেন প্রথম সারির সক্রিয় রিপোর্টার, মূলত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং জাতীয় সংসদের কার্যক্রমের বিষয়েই অধিকাংশ রিপোর্ট করেছেন।ঢাকার দৈনিক সংবাদ-এর মাধ্যমে সাংবাদিকতার যাত্রা শুরু করে আবু মুসা হাসান বেশ কয়েক বছর বন্দরনগরীর প্রগতিশীল দৈনিক পূর্বকোণ-এর ঢাকা ব্যুরো চিফ হিসেবে কাজ করে ঢাকার ইংরেজি দৈনিক ইনডিপেনডেন্ট-এ যোগদান করেন। পূর্বকোণে থাকাকালে তিনি বাংলাদেশের দুই কিংবদন্তি সাংবাদিক কে জি মুস্তাফা ও ফয়েজ আহমদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পান। কে জি মুস্তাফা ছিলেন পূর্বকোণের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আর ফয়েজ আহমদ ছিলেন ঢাকা অফিসের আবাসিক সম্পাদক। এদিকে পূর্বকোণে কাজ করাকালে আবু মুসা হাসান বিবিসি, রয়টার্স এবং এএফপির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বিবিসির স্বনামধন্য সাংবাদিক আতাউস সামাদের সঙ্গে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। বিবিসির সঙ্গে জড়িত থাকার সুবাদে তিনি অনেক খ্যাতনামা সাংবাদিকের সঙ্গেও কাজ করেছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন আরেক কিংবদন্তি মার্ক টালি। যিনি বিবিসিতে মুক্তিযুদ্ধকালে রিপোর্ট করে বাংলাদেশের জনগণের পরম বন্ধু বলে সুপরিচিত।গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার রাইতলায় হলেও আবু মুসা হাসান ছোটবেলা থেকেই বড় হয়েছেন ঢাকায়। শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত হাসান ভাইয়ের বাবা অবসরে যাওয়ার আগে পর্যন্ত আজিমপুর নতুন পল্টন লাইন হাই স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। এর আগে তিনি ছিলেন সেন্ট গ্রেগরি স্কুলের শিক্ষক। নতুন পল্টন লাইনের বাসিন্দা আবু মুসা হাসান বাবার স্কুলেই পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৬৮ সালে এসএসসি পাস করে তিনি ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। কলেজে ভর্তি হওয়ার পরেই জড়িয়ে পড়েন ছাত্র রাজনীতিতে। হয়ে ওঠেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সক্রিয় কর্মী। তিনি ছিলেন ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে শুরু হওয়া পাকিস্তানি স্বৈরশাসক ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান বিরোধী ১১ দফা ছাত্র আন্দোলনের একনিষ্ঠ কর্মী।
উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের পতনের পর সেনাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া ক্ষমতা দখল করে সামরিক শাসনের অধীনে লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডারের (এলএফও) মাধ্যমে সাধারণ নির্বাচন দেয়। নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে পাকিস্তানের বৃহত্তম দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আবু মুসা হাসান জাতীয় পরিষদে ঢাকার লালবাগ-রমনা আসনে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে প্রচারণা চালান। তবে ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী হিসেবে প্রাদেশিক পরিষদের লালবাগ আসনে মোজাফ্ফর ন্যাপ মনোনীত প্রার্থী সাহিত্যিক খোন্দকার ইলিয়াসের পক্ষেও কাজ করেছিলেন।বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক জনসমুদ্রে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়ে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন এবং ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’। আবু মুসা হাসান ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত থেকে ঐতিহাসিক ভাষণের প্রত্যক্ষ সাক্ষী হয়ে আছেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর উজ্জীবিত বাঙালি জাতি দেশব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে। ওই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র আবু মুসা হাসান বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে ছাত্র ইউনিয়ন আয়োজিত প্রশিক্ষণে অংশ নেন। ডামি রাইফেল দিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা ঢাকা শহরে মার্চপাস্ট করেছিলেন জনগণকে অনুপ্রাণিত করার জন্য। ২৫ মার্চ রাত ৯টা-১০টার দিকে ঢাকা শহরে বিদ্যুৎগতিতে ছড়িয়ে পড়ে যে, রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হামলা চালাতে পারে। তখন বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে দেওয়া নির্দেশ অনুযায়ী জনগণ রাজপথে ব্যারিকেড দেওয়ার জন্য বেরিয়ে এল। পাড়ার বন্ধুদের নিয়ে আবু মুসা হাসানও বেরিয়ে পড়েন এবং নিউ মার্কেট ও ইপিআর (বর্তমানে বিজিবি) হেড কোয়ার্টারের (পিলখানা) মধ্যবর্তী রাস্তায় শত শত মানুষের সঙ্গে হাত লাগিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করেন। ওই সময় রাস্তার দুই পাশে সারি সারি বটগাছ ছিল। বটগাছগুলো কেটে ব্যারিকেড তৈরি করা হয় যাতে ইপিআর হেড কোয়ার্টারের ভেতরে অবস্থান নেওয়া পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বালুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা বের হয়ে ঢাকা শহরের জনগণের ওপর হামলা চালাতে না-পারে। সাথিদের নিয়ে তিনি রাত ১২টার দিকে নিউ মার্কেটের মোড়ে পৌঁছার পর শুরু হয় হায়েনাদের আক্রমণ। বিকট শব্দের মুহুর্মুহু গোলাগুলির মধ্যে তারা কয়েকজন বন্ধু বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। চার বন্ধুসহ হাসান ভাই দেয়াল টপকে নিউ মার্কেটের উল্টোদিকে আজিমপুর কলোনিতে আশ্রয় নেন। রাতভর গোলাগুলির মধ্যে একটি ভবনের সিঁড়ির নিচে অপেক্ষা করেন। একপর্যায়ে আজিমপুর কবরস্থানের দেয়াল টপকে তারা নতুন পল্টন লাইনের একটি বাড়িতে প্রবেশ করেন। তিনি ভোরে বাসায় গিয়ে দেখেন তাদের ঘরে ইপিআরের দুই সিপাহি আশ্রয় নিয়েছে। তাকে ঘরে ঢুকতে দেখে সিপাহিরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লে হাসান ভাইয়ের মা তাদের অভয় দিয়ে বলেন, ভয় নাই, আমার ছেলে। ইপিআরের দুই সিপাহি জানাল যে, ঘুমের মধ্যে পাকিস্তানি সেনারা তাদের ব্যারাকে হামলা চালিয়ে অনেককে হত্যা করেছে।২৭ মার্চ কারফিউ শিথিল হলে সপরিবারে ঢাকা থেকে বের হয়ে হাসান ভাই কিছুদিন গ্রামের বাড়িতে থাকেন। পরে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য ভারতে চলে যান। আসামের তেজপুর ক্যান্টনমেন্টে ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের এক মাসের স্পেশাল গেরিলা ট্রেনিং নিয়ে দেশের ভেতরে আসেন। ডাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহবুব জামানের নেতৃত্বে গেরিলা দলটি মুন্সিগঞ্জ এলাকায় অবস্থান নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অপারেশন করেছে। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করার পর তাদের গেরিলা ইউনিটটি ১৭ ডিসেম্বর ভোরে ঢাকায় পৌঁছায়। তারা বিধ্বস্ত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাদদেশে দাঁড়িয়ে রাইফেল উঁচিয়ে দেশ গড়ার শপথ নিয়েছিলেন। বিজয় দিবসের ৪০তম বার্ষিকীকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ২০১১ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক ৪০ টাকার যে স্মারক নোট এবং ১০ টাকার স্মারক কয়েন প্রকাশ করেছে, সেগুলোর একদিকে রয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি আর অন্যদিকে রয়েছে হাসান ভাই ও তার সহযোদ্ধাদের সেই ঐতিহাসিক দেশ গড়ার শপথ নেওয়ার গ্রুপ ছবিটি। স্বাধীনতার পর আবু মুসা হাসান ছাত্র ইউনিয়ন ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতির সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়েন। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাত্র ১৫ মিনিটের দূরত্বে বাসা হলেও চলে আসেন মহসিন হলে। ১৯৭২ সালে অনুষ্ঠিত ডাকসু (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ) এবং হল সংসদ নির্বাচনে তিনি মহসিন হল ছাত্র সংসদের সহসাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ওই বছরই তিনি নির্বাচিত হন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা শহর শাখার সাধারণ সম্পাদক। ওই সময় সমগ্র ঢাকা নগরী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শাখাগুলো ঢাকা শহর শাখার আওতায় ছিল।দেশ গড়ার আন্দোলনের কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ডাকসু এবং ছাত্র ইউনিয়নের ছাত্র ব্রিগেডের সদস্য হিসেবে আবু মুসা হাসান আদমজী জুট মিলসহ কাঞ্চন শিল্প এলাকার শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করেছেন। তাদের দেশ গড়ার কাজে উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি নৈশ স্কুল পরিচালনা করেন। ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে ডাকসুর উদ্যোগে রুটি বানিয়ে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে দুর্গত মানুষের মাঝে বিতরণ এবং ডায়রিয়া প্রতিরোধে চিনি-লবণ দিয়ে ওরস্যালাইন তৈরি ইত্যাদি কাজে আবু মুসা হাসান ছিলেন সামনের সারিতে। তিনি প্রতিদিন সন্ধ্যায় তৎকালীন ঢাকার জেলা প্রশাসক সৈয়দ রেজাউল হায়াতের্ বাসভবনে সমন্বয় কমিটির বৈঠকে ডাকসুর পক্ষ থেকে ত্রাণ কার্যক্রমের রিপোর্ট পেশ করতেন। ডাকসুর উদ্যোগে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পুকুর পাড়ে বীজতলা তৈরি করে কৃষকদের মধ্যে টোকেন ধানের চারা বিতরণেও আবু মুসা হাসান উৎসাহের সঙ্গে কাজ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তীতে সেশন জটের জন্য ১৯৭৪ সালের বদলে ১৯৭৬ সালে সমাজ বিজ্ঞানে মাস্টার্স সম্পন্ন করেও তিনি আরও কয়েক বছর ছাত্র রাজনীতি করেন। সেসময় তিনি সাংবাদিকতা বিভাগে ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি হন। রাজনৈতিক কারণে কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়ন ছেড়ে আবু মুসা হাসান মোজাফফর ন্যাপের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র সমিতি প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ ছাত্র সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক এবং ন্যাপের জাতীয় কমিটির সদস্য। ছাত্র সমিতির সাধারণ সম্পাদক থাকাকালে তিনি জেনারেল জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসন বিরোধী কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ছাত্র লীগের জালাল-জাহাঙ্গীর ও ফজলু-চুন্নু অংশ, জাসদ ছাত্রলীগ, বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্র সমিতিসহ পাঁচটি ছাত্র সংগঠন ছিল এই সংগ্রাম পরিষদে। তবে ১৯৮১ সালে আবু মুসা হাসান ছাত্র ও জাতীয় রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ বিদায় নিয়ে স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে দৈনিক সংবাদে যোগদান করেন এবং অচিরেই একজন পেশাদার নিরপেক্ষ সাংবাদিক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
২০০০ সালে ডেইলি ইন্ডিপেনডেন্টের বিশেষ প্রতিনিধি থাকাকালে আবু মুসা হাসান তিন বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মাধ্যমে প্রেস মিনিস্টার হিসেবে লন্ডনের বাংলাদেশ হাইকমিশনে যোগদান করেন। বিএনপি জামাত জোট সরকার ২০০১ এক সালে ক্ষমতায় এসে তার নিয়োগ বাতিল করে দেয়। পরবর্তীতে হাসান ভাই তার সাংবাদিক সহধর্মিণী নীলুফা ইয়াসমিনের ওয়ার্ক পারমিটের ভিত্তিতে পুনরায় লন্ডন আসেন এবং লন্ডনের সাপ্তাহিক সিলেটের ডাকের (বর্তমানে বিলুপ্ত) সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ওই সময় তিনি দৈনিক ইত্তেফাকের লন্ডন প্রতিনিধি হিসেবেও কাজ করেছেন। বর্তমানে আবু মুসা হাসান বিলেতের সাপ্তাহিক জনমত-এ নিয়মিত কলাম লিখছেন এবং অনলাইন নিউজ পোর্টাল সত্যবাণীর উপদেষ্টা সম্পাদক। এর আগে তিনি দীর্ঘদিন যুক্তরাজ্যের ইমিগ্রেশন অ্যাডভাইজারি সার্ভিস (আইএএস) নামক চ্যারিটি সংস্থায় ট্রেনিং ও কনফারেন্স কো-অর্ডিনেটর এবং উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন।
এতক্ষণ আবু মুসা হাসানের রাজনৈতিক ও কর্মজীবন নিয়ে আলোকপাত করলাম। তবে সবকিছু ছাপিয়ে বর্তমানে হাসান ভাইকে একজন দাবাড়ু আর ক্রিকেটপ্রেমী হিসেবে দেখি। স্কুল জীবন থেকেই তিনি খেলাধুলার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। জাতীয় প্রেসক্লাবে বাৎসরিক প্রতিযোগিতায় দাবায় চ্যাম্পিয়ন ও টেবিল টেনিসে রানার আপ হয়েছিলেন। লন্ডনে এসেও দাবা খেলা ছাড়েননি। বর্তমানে তিনি ইংলিশ চেস ফেডারেশনের (ইসিঅফ) সদস্য। বাংলাদেশের জাতীয় পর্যায়ের সাবেক দাবাড়ুদের উদ্যোগে পূর্ব লন্ডনে প্রতিষ্ঠিত ব্রিটিশ বাংলা চেস অ্যাসোসিয়েশনের (বিবিসিএ) প্রধান উপদেষ্টা তিনি। এই সংগঠন পরপর দুই বছর দুটি আন্তর্জাতিক মানের টুর্নামেন্ট করেছে, যেখানে বেশ কয়েকজন গ্র্যান্ড মাস্টারসহ বিভিন্ন পর্যায়ের শতাধিক চৌকস দাবাড়ু অংশ নিয়েছেন। তিনি আক্সব্রিজ চেস ক্লাবেরও সদস্য। হাসান ভাই এই দুই দাবা ক্লাবের পক্ষে লন্ডন চেস লীগ ও অন্যান্য লিগে নিয়মিতভাবে খেলছেন। এ ছাড়া তিনি পরপর দুই বছর লন্ডন চেস ক্ল্যাসিক দাবা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন। লন্ডন চেস ক্ল্যাসিক হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এবং মর্যাদাপূর্ণ দাবা উৎসব। এবছর এতে বিভিন্ন দেশের প্রায় ৫০ জন গ্র্যান্ড মাস্টারসহ প্রায় ১২০০ দাবাড়ু অংশ নেন।
বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের খেলা দেখার জন্য তিনি উন্মুখ হয়ে থাকেন। টিভি আর কম্পিউটারে খেলা দেখার পাশাপাশি বাংলাদেশ দল যুক্তরাজ্য সফরে এলে সহধর্মিণী নিলুফা ইয়াসমিনকে সঙ্গে নিয়ে ছুটে যান বিভিন্ন শহরে তার প্রিয় ক্রিকেট দলকে সমর্থন জোগাতে। এমনকি গত বছর যুক্তরাজ্যে অনুষ্ঠিত চ্যাম্পিয়নস ট্রফি শুরুর আগে বাংলাদেশ দল আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্টে খেলতে এলে তারা সেখানেও ছুটে যান। যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ম্যাচগুলোর মধ্যে তার কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে ২০০৫ সালে কার্ডিফের সোফিয়া গার্ডেনে অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর স্মৃতি। ওই দিন আনন্দে আত্মহারা হাসান ভাই গ্যালারি থেকে নেমে এক দৌড়ে মাঠে চলে গিয়েছিলেন।আবু মুসা হাসান প্রকৃতিকেও ভালোবাসেন। ইদানীং তিনি নিজের এলটমেন্টে সবজির বাগান করছেন। গত সামারে বন্ধুদেরকে বাগান পরিদর্শনের আমন্ত্রণ জানান। আমারও সৌভাগ্য হয়েছিল হাসান ভাইয়ের সবজি বাগানে যাওয়ার। আবু মুসা হাসানের সহযোদ্ধা ও ডাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহবুব জামান লন্ডনে এসেই হাসান ভাইয়ের সবজি বাগানে এলেন। ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলাম বলে খবর পেয়ে আমি, সৈয়দ এনাম ও আফতাব হোসেইনও গেলাম। মাহবুব ভাই ও হাসান ভাইয়ের সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা দিলাম। সবাই চলে গেলাম পুরোনো দিনের স্মৃতি রোমন্থনে।
তার সম্পর্কে এসব বলার পরও আরও রয়ে গেছে নানা কথা। গত ৩০ নভেম্বর ছিল পূর্ব লন্ডনের ব্রাডি আর্টস সেন্টারে ‘বিজয় ফুল’ কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। হাসান ভাই শুনলেন সংস্কৃতিকর্মী স্মৃতি আজাদ মুক্তিযোদ্ধা সন্তান তখনই তিনি স্মারক ৪০ টাকার একটি নোট তাকে উপহার দিলেন। একটু পর বাচিক শিল্পী মুনিরা পারভীনের দুই সন্তানকে দুটো নোট উপহার দেন। মুনিরা পারভীনের শ্বশুর তথা তার সন্তান ইলহাম ও নিধির পিতামহও মুক্তিযোদ্ধা। ওরা তৃতীয় প্রজন্ম। আমার মেঝোভাই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। আমাকেও একটি নোট উপহার দেন। ঘটনাটি বললাম এই জন্য যে, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বাংলাদেশের প্রতি তার ভালোবাসার গভীরতা কত অপরিমেয় ও অসীম। দেশের প্রতি ভালোবাসা এই প্রতীকী উপহারটির মাধ্যমে ছড়িয়ে যেন পড়ে, তার চোখেমুখে এমনিই দীপ্তি কথা বলছিল তখন। মুক্তিযোদ্ধা আবু মুসা হাসান, আমাদের হাসানভাই, দেশপ্রেম যার অনির্বাণ শিখা। এই শিখাটির জন্যই তো তারা যুদ্ধ করেছিলেন। হামিদ মোহাম্মদ: লন্ডন, যুক্তরাজ্য।