দেশে ঢুকেই অ্যাম্বুলেন্স হয়ে যাচ্ছে মাইক্রোবাস
বার্তা ডেস্ক:: গাজীপুর-চ-১১-০০২৩ নম্বরের হাইয়েস মাইক্রোবাসটি বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়েছিল অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে। দেশে আসার পর মাইক্রোবাস হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে সেটি। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা ঘুষ-বাণিজ্যের মাধ্যমে অবৈধভাবে অ্যাম্বুলেন্সকে মাইক্রোবাস হিসেবে নিবন্ধন দিয়ে ‘বৈধতা’ দিয়েছেন। শুধু এই একটি গাড়িই নয়, অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে আমদানি করা এমন একাধিক গাড়ি অবৈধভাবে মাইক্রোবাস হিসেবে নিবন্ধন দিয়েছে বিআরটিএ। এতে সরকার হারাচ্ছে মোটা অঙ্কের রাজস্ব আর ঘুষ-বাণিজ্যে পকেট ভারী করছেন বিআরটিএর সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা। শুল্ক্ক ফাঁকি দিতেই অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে গাড়ি এনে বিআরটিএর অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে মাইক্রোবাস হিসেবে বেচাকেনা করছেন অসাধু আমদানিকারকরা। কারণ, মাইক্রোবাস আমদানিতে যে পরিমাণ শুল্ক্ক দিতে হয়, অ্যাম্বুলেন্সের ক্ষেত্রে তার পাঁচ ভাগের এক ভাগ শুল্ক্ক পরিশোধ করতে হয়। অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, বিদেশ থেকে বাণিজ্যিকভাবে আমদানিকৃত মাইক্রোবাস সিসি ভেদে প্রযোজ্য শুল্ক্ক হার গড়ে সর্বনিম্ন ১৩০ থেকে সর্বোচ্চ ১৫৪ শতাংশ। কিন্তু অ্যাম্বুলেন্স আমদানিতে শুল্ক্কের পরিমাণ ৩২ শতাংশের মতো। জানা যায়, বর্তমানে আমদানিকৃত ১৮০০ থেকে ২০০০ সিসি মাইক্রোবাসের ওপর উল্লিখিত হারে শুল্ক্ক আরোপের ফলে মোট মূল্য দাঁড়ায় ২২ থেকে ২৫ লাখ টাকা। অন্যদিকে, একই সিসির অ্যাম্বুলেন্সে প্রযোজ্য হারে শুল্ক্ক আদায় করলে এর মোট মূল্য দাঁড়ায় ১২ লাখ থেকে ১৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ মাইক্রোবাস অপেক্ষা অ্যাম্বুলেন্সের দাম প্রায় অর্ধেক কম। অ্যাম্বুলেন্স যেহেতু মানবসেবায় ব্যবহূত হয়, তাই সরকার তাতে রেয়াতি সুবিধা দিয়ে শুল্ক্ক হ্রাস করেছে। আর এই সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরা অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে গাড়ি আমদানি করে মাইক্রোবাস হিসেবে বিক্রি করছেন।
অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে আমদানির পর মাইক্রোবাস হিসেবে ব্যবহার করার বিষয়টি সম্প্রতি চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের নজরে আসে। এর পরই কাস্টমস থেকে আমদানিকৃত অর্ধশতাধিক অ্যাম্বুলেন্সের চেসিস নম্বরসহ বিআরটিএ চেয়ারম্যানের কাছে চিঠি দেওয়া হয়, যাতে মাইক্রোবাস হিসেবে গাড়িগুলো নিবন্ধন দেওয়া না হয়। তাতে বলা হয়েছে, সম্প্রতি কিছু অসাধু গাড়ি আমদানিকারক কর্তৃক অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে আমদানি করা গাড়ি মাইক্রোবাস হিসেবে নিবন্ধন করে ব্যবহার করা হচ্ছে, এমন অভিযোগ রয়েছে। অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে নিবন্ধন না করে মাইক্রোবাস হিসেবে নিবন্ধন করা হলে সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারানোর সম্ভাবনা রয়েছে। চট্টগ্রামের এসআই অটোমোবাইলস, টারবো অটো, এফবিটি অটোমোবাইলস, জে আর অটোমোবাইলস ও ঢাকার মোহাম্মদপুরের লামিয়া এন্টারপ্রাইজসহ বিভিন্ন আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে যানবাহনগুলো আমদানি করেছে এদেশে।
কাস্টমস থেকে চিঠি পাওয়ার পর গত অক্টোবরে বিআরটিএর সদর কার্যালয়ের সে সময়ের পরিচালক (ইঞ্জি.) মো. নুরুল ইসলাম বিআরটিএর বিভিন্ন বিভাগীয় কার্যালয়ে ওই গাড়িগুলো মাইক্রোবাস হিসেবে নিবন্ধন না দেওয়ার নির্দেশনা দিয়ে চিঠি পাঠান। চিঠিতে ৫৫টি গাড়ির চেসিস নম্বর উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ‘মোটরযানগুলো কাস্টম হাউস চট্টগ্রাম থেকে অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে ছাড় করা হয়েছে। সেগুলো অ্যাম্বুলেন্স ছাড়া অন্য কোনো যান হিসেবে যাতে নিবন্ধন দেওয়া না হয়।’
তবে একাধিক অ্যাম্বুলেন্স অবৈধভাবে মাইক্রোবাস হিসেবে বিআরটিএ থেকে নিবন্ধন দেওয়ার তথ্য অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। এতে মোটা অঙ্কের ঘুষ-বাণিজ্য হয়েছে। এর মধ্যে বিআরটিএর গাজীপুর কার্যালয় থেকে গত বছরের জুলাই ও অক্টোবরে তিনটি অ্যাম্বুলেন্সকে মাইক্রোবাস হিসেবে নিবন্ধন দেওয়া হয়। সেগুলো হলো- গাজীপুর-চ-১১-০০২৩ (চেসিস নম্বর টিআরএইচ২০০-০১৬৯৫১৯), গাজীপুর-চ-১১-০০২৫ (চেসিস নম্বর জেডআরআর ৭০-০৫৫৪৬৯২) এবং গাজীপুর-চ-১১-০০২৬ (চেসিস নম্বর জেডআরআর ৮০-০০৪০৫১৭)। অবৈধভাবে নিবন্ধন দেওয়ার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন গাজীপুর বিআরটিএর সহকারী পরিচালক এনায়েত হোসেন মন্টুসহ সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা। মন্টুর বিরুদ্ধে এর আগেও অনিয়ম-দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। দুর্র্নীতির অভিযোগে সিলেট ও মানিকগঞ্জে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মামলা করেছিল। সিলেটে শুল্ক্ক ফাঁকি দেওয়া গাড়ি নিবন্ধন দেওয়ায় তিনি গ্রেফতারও হয়েছিলেন। এর আগে ২০০৪ সালে ঢাকার ইকুরিয়ায় মোটরযান পরিদর্শক থাকার সময় একাধিক যানবাহনের ফিটনেস-সংক্রান্ত জালিয়াতির ঘটনায় হাতেনাতে ধরা পড়েছিলেন তিনি। সে সময় তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিল। অ্যাম্বুলেন্সকে মাইক্রোবাস হিসেবে নিবন্ধন দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে গাজীপুর বিআরটিএর সহকারী পরিচালক এনায়েত হোসেন মন্টু বলেন, ‘হেড অফিস থেকে (বিআরটিএ) অ্যাম্বুলেন্সের চেসিস নম্বরসহ যে চিঠি আমাদের দেওয়া হয়েছে, তাতে এই গাড়ির চেসিস নম্বর আছে কি-না মিলিয়ে দেখব।’
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, গাজীপুর-চ-১১-০০২৩ নম্বরের গাড়িটি নিবন্ধন করা হয়েছে জসিম উদ্দিন নামে। তার বাড়ি গাজীপুরে। ২৭ জুন তার সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘ব্যাংক ঋণ নিয়ে ২৪ লাখ ৫০ হাজার টাকায় গাজীপুরের মাহবুব আলমের শোরুম থেকে তিনি হাইয়েস মাইক্রোবাসটি কিনেছেন। কেনার ৫-৬ মাস পর শোরুম থেকে গাড়িটির নিবন্ধনের কাগজপত্র তার হাতে বুঝিয়ে দেওয়া হয়।’ মাইক্রোবাসটি অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে আমদানি করা হয়েছে- বিষয়টি জানেন কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, মাইক্রোবাস হিসেবেই তিনি কিনেছেন এবং মাইক্রোবাস হিসেবেই ব্যবহার করছেন। কীভাবে আমদানি হয়েছে, তা তার জানার কথা নয়। শোরুমের মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন তিনি। পরে কথা হয় শোরুমের মালিক মাহবুব আলমের সঙ্গে। তার কাছ থেকেও সদুত্তর পাওয়া যায়নি। বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে বলেন, চট্টগ্রাম থেকে এক ব্যক্তির মাধ্যমে তিনি গাড়িটি নিয়ে বিক্রি করেছেন। তিনি আমদানিকারক নন। চট্টগ্রামের একটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান সেটি আমদানি করেছে। তবে আমদানিকারকের নাম-পরিচয় বলতে রাজি হননি। পরে কথা বলবেন জানিয়ে ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন তিনি।
গাজীপুর-চ-১১-০০২৫ নম্বর গাড়ির মালিক গাজীপুরের আফরিন আক্তার জানান, তিনি গাড়িটি মাইক্রোবাস হিসেবে কিনেছেন গাজীপুরের চৌরাস্তা এলাকার একটি শোরুম থেকে। ২৬ লাখ টাকায় কিনে তিনি ভাড়ায় চালান সেটি। কখনও কখনও ব্যক্তিগতভাবেও ব্যবহার করা হয়। অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে আমদানির বিষয় জানা নেই তার।
বিআরটিএর সদর কার্যালয়ের পরিচালক (ইঞ্জি.) লোকমান হোসেন মোল্লা বলেন, ‘অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে আমদানি গাড়ি মাইক্রোবাস হিসেবে নিবন্ধন দিয়েছে কি-না, তা তার জানা নেই। যদি এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে তাহলে নিবন্ধন বাতিল হবে এবং সংশ্নিষ্ট অফিসের কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অবশ্যই বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিক্যালস ইম্পোর্টার্স অ্যান্ড ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বারভিডা) সভাপতি হাবিব উল্লাহ ডন বলেন, ‘অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে আমদানি করা গাড়ি মাইক্রোবাস হিসেবে ব্যবহার করার কোনো নিয়ম নেই। যে গাড়িগুলো অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে আমদানি এবং অ্যাম্বুলেন্স হিসেবেই শুল্ক্ক দেওয়া হয়েছে, সেসব গাড়ি মাইক্রোবাস হিসেবে বেচাকেনা করা অনৈতিক। এ ধরনের অসাধু আমদানিকারকের বিরুদ্ধে বারভিডা থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ এ ছাড়া নিবন্ধন দেওয়ার ক্ষেত্রে বিআরটিএকেও লক্ষ্য রাখা উচিত মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘বিআরটিএ থেকে নিবন্ধন না দিলে অসাধু ব্যবসায়ীরাও এ ধরনের সুযোগ নিতে পারবেন না।’