পীর হাবিবুর রহমান

বিস্তীর্ণ হাওর অঞ্চলজুড়ে ফসল হারানোর বেদনায় রিক্ত-নিঃস্ব মানুষের আর্তনাদ, ক্রন্দন ও তপ্ত দীর্ঘশ্বাসে বাতাস ভারি করেছে। এবারের মতো আগাম ও অতি বৃষ্টিপাত অতীতে কখনো হয়নি। এবারের মতো হাওরের ফসল রক্ষাবাঁধ নির্মাণে অনিয়ম, দুর্নীতি, অবহেলা, উদাসীনতা অতীতে আর কখনো হয়নি। এবারের মতো অতিবৃষ্টি অকাল বন্যায় বাঁধ ভেঙে সব ফসল  তলিয়ে যাওয়ার মতো বেদনাদায়ক ঘটনা, একদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ অন্যদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড, ঠিকাদার, একদল লোভী দুর্নীতিগ্রস্ত সিন্ডিকেটের কোথাও কাজ না করা, কোথাও বা দায়সারা কাজ করার মধ্য দিয়ে মানবসৃষ্ট বিপর্যয় ডেকে আনার নির্মমতা অতীতে কখনো হয়নি।

এই দুর্যোগ হাওর অঞ্চলের সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে স্তব্ধই করে দেয়নি; কেড়ে নিয়েছে আনন্দ, উৎসব।   বিষাক্ত পানিতে ধান গেছে পচে, বিষাক্ত পানিতে ভেসে উঠেছে মরা মাছ, মরেছে হাঁস। হাওরের এ বিপর্যয় বলতে সবার চোখের সামনে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সুনামগঞ্জ জেলা ভেসে উঠলেও এর সীমানা ও ক্ষতির মহাপ্রলয়ের আগ্রাসনে পতিত হয়েছে হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ।

মানুষের ঘরে খাবার নেই, টাকা নেই। শুধুই দীর্ঘশ্বাস। কৃষকেরা বিক্রি করে দিচ্ছে হালের বলদ। কোথাও কোথাও ছাত্ররা লেখাপড়া ছেড়ে ঢাকায় চলে আসছে কাজের সন্ধানে। গোটা হাওর অঞ্চলের জীবন-জীবিকা নির্বাহের একমাত্র অর্থনৈতিক আয়ের মাধ্যমই হলো এই বোরো ফসল। অতীতে অকাল বন্যা বা পাহাড়ি ঢলে বাঁধ ভেঙে গিয়ে ফসল তলিয়ে যেতে থাকলে কৃষক কাঁচা পাকা ধান কেটে ঘরে তুলত। এক হাওর চলে গেলে অন্যান্য অনেক হাওর থাকত। এবার সব হাওরই চলে গেছে। সর্বশেষ মানুষ টানা ২৪ দিন যুদ্ধ করে শেষ খাদ্যভাণ্ডার শনির হাওরকে রক্ষা করে রাখলেও সেটির ফসলও তলিয়ে যায়।

মহামান্য রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ আবদুল হামিদ  হাওরে জন্ম নিয়ে বেড়ে উঠেছেন। হাওরের মানুষের জীবন-জীবিকা ও মনের ভাষা পড়তে পড়তে দীর্ঘ রাজনৈতিক পথ অতিক্রম করে আজকের বঙ্গভবনে এসেছেন। মাঝে-মধ্যেই তার হাওরের প্রিয় মানুষের কাছে ছুটে যান। এবারের ফসলহানিতে হাওরপাড়ের কৃষকের বুক ভেঙে যাওয়ায় বসে থাকেননি, ছুটে গেছেন। মানুষকে সমবেদনা ও সাহস জুগিয়েছেন। সুনামগঞ্জের সুধী সমাবেশে সবাই দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বললে তিনি মহামূল্যবান মন্তব্য করেছেন। প্রশ্ন রেখে বলেছেন, ‘যেখানে সবাই দুর্নীতির বিরুদ্ধে, সেখানে দুর্নীতি হয় কি করে?’ বিষয়টি যে ইশারায় কাফি, সেটি বুঝতে কারও বাকি থাকে না। ফসলহানি ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে সুনামগঞ্জ সদরের জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ হাজারো জনতার সমাবেশ করে দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবি জানিয়েছিলেন। ত্রাণ সাহায্য ছাড়াও খোলাবাজারে চাল বিক্রি, কৃষিঋণ মওকুফ, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, বাঁধ নির্মাণে অনিয়মের তদন্ত ও নদীর নাব্য বাড়াতে ড্রেজিংয়ের দাবি জানান। জেলা আওয়ামী লীগ নেতা, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নুরুল হুদা মুকুট ও পৌর মেয়র আইয়ুব বখত জগলুলও একই দিনে সংবাদ সম্মেলন করে দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবি জানান। অ্যাডভোকেট বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরুর নেতৃত্বে ‘হাওর বাঁচাও, সুনামগঞ্জ বাঁচাও’ ব্যানারে একদল মানুষ রাজপথে নামে। তারাও প্রায় অভিন্ন দাবি তোলে। এটা কোনো সরকারবিরোধী আন্দোলন নয়; মানুষের টিকে থাকা, বেঁচে থাকার লড়াইয়ে বিবেক নিঃসৃত মানবিক অবস্থান গ্রহণ।

রাষ্ট্রপতি সুনামগঞ্জ যাওয়ার আগে বিপর্যয়ের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, কেউ না খেয়ে থাকবে না। তিনি কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন। রাষ্ট্রপতি ফিরে আসার পর ত্রাণ ও দুর্যোগমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী (বীরবিক্রম) সেখানে সফর করেন। পর্যাপ্ত ত্রাণ ও দুর্যোগ মোকাবিলায় সাহায্যের নিশ্চয়তা দেন। তারপরই যান পানিসম্পদ মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। তিনি প্রাকৃতিক দুর্যোগের চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, ‘অনেকের বিল দেওয়া হবে না। গেলবারও বিলের বরাদ্দের অর্ধেক টাকা আটকে দেওয়া হয়েছিল। ’ পানিসম্পদ মন্ত্রীকে একই সঙ্গে এটাও ভাবতে হবে, দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের বাইরে ক্ষমতার উত্তাপ থেকে দূরে থাকা যেসব পেশাদার, নিরীহ ঠিকাদার কাজ করেছেন তারা যেন ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত না হন। ঠিকাদারদের বক্তব্যও শোনার প্রয়োজন আছে। স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড আগস্ট মাসে টেন্ডার আহ্বান করে ফেব্রুয়ারি মাসে এসে কেন কার্যাদেশ দিল? সেটিও প্রশ্নবিদ্ধ।

সরকারি হিসাবে অনেকে বলছেন, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ চার হাজার কোটি টাকা। বেসরকারি হিসাবে তা ১০ হাজার কোটি টাকার ওপর বলা হচ্ছে। দেড় লাখ মানুষকে ত্রাণ সাহায্যের আওতায় প্রাথমিকভাবে আনা হলেও স্থানীয় প্রশাসন বলছে, ক্ষতিগ্রস্তের পরিমাণ তিন লাখ। মানুষ বলছে, তা পাঁচ লাখ ছাড়িয়ে যাবে। গত কয়েক দিন থেকে বিভিন্ন টকশো ও কলামে বারবার বলার চেষ্টা করেছি, ইউনিয়ন পর্যায় থেকে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ সাহায্য, খোলাবাজারে চাল বিক্রির কর্মসূচি ব্যাপকহারে নিতে এবং তার মনিটর ব্যবস্থা জোরদার করা দরকার। তালিকা প্রণয়নেও স্বচ্ছতা জরুরি। ব্যক্তি ও দলের স্বার্থে ওপরে উঠে মানুষকে সাহায্য করার মানসিকতাই বড়। এ বিপর্যয়ে গণমাধ্যম মানুষের আশার বাতিঘর হিসেবে কাজ করেছে। প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও অনলাইন মিডিয়ার সংবাদকর্মীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে প্রকৃত চিত্র তুলে এনেছেন। সর্বগ্রাসী এই দুর্যোগে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চল হলো সুনামগঞ্জের তাহিরপুর, মধ্যনগর, জামালগঞ্জ, ধর্মপাশা, শাল্লা, দিরাই, সুনামগঞ্জ সদর ও বিশ্বম্ভরপুর এবং জগন্নাথপুর।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাওরের বিস্তীর্ণ কৃষকদের জীবনযাত্রা ও অকাল বন্যায় ফসল তলিয়ে যাওয়ার ঘটনা এবং তার পরিণতি সম্পর্কে ব্যাপক পরিষ্কার ধারণা রয়েছে। আমার মতো অনেকেই প্রধানমন্ত্রীকেই এই দুর্যোগ মোকাবিলায় শেষ ভরসার জায়গা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। ’৯৮ সালের বন্যা সফলভাবে মোকাবিলা করার অনন্য সাধারণ ভূমিকা রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর। ১৯৮৭ সালে নরসিংদী থেকে কৃষক লীগের মাধ্যমে ‘কৃষক বাঁচাও, দেশ বাঁচাও’— ডাক দিয়ে কৃষির উন্নয়নে যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন ক্ষমতায় এসে ’৯৬ সালে তা বাস্তবে রূপ দেন। সেবার বাংলাদেশ খাদ্য ঘাটতি থেকে খাদ্যে উদ্বৃত্ত দেশ হিসেবে নিজেদের পরিচয় করার সাহস অর্জন করে। ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে কৃষক সমাবেশ করে তাদের কৃষি উপকরণ বিনামূল্যে দিয়েছিলেন। সেবার কৃষিতে বাম্পার ফলন হয়েছিল। ‘বালু, পাথর, মাছ, ধান ও গান-সুনামগঞ্জের প্রাণ’ এটা আমাদের ভাটি বা হাওর অঞ্চলের মানুষের গৌরব। বৈশাখে এক ফসল বোরো ধান কাটার মহোৎসবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লোকজন শ্রম দিয়ে জীবিকানির্বাহ করে। রাস্তাঘাট, বাড়ির আঙিনায় ধান মাড়াইয়ের দৃশ্য আর নতুন ধানের মউ মউ ঘ্রাণ উৎসবমুখর মানুষের চিত্তকে প্রফুল্ল করে। হাওরের মানুষ কখনো রিলিফের লাইনে দাঁড়ায় না। যুগের পর যুগ এক ফসল তুলে, বিস্তীর্ণ হাওরের মাছ ধরে বর্ষায় সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ এসব হয়ে উঠে ছোট্ট গ্রামীণ দ্বীপ শহর। চতুর্দিকে সমুদ্রের মতো অবারিত জলরাশি। বড় বড় ঢেউ উঠলে মাঝিমাল্লা আফাল আফাল বলে চিৎকার করে। বর্ষায় হাওরের মানুষ বন্দী-অলস জীবনযাপন করে। তাস খেলে, পাশা খেলে, দাবা খেলে, আড্ডায় কাটায় জীবন। পুঁথিপাঠের আসর বসে, পালা গান, বাউল গান, কবিয়াল লড়াইয়ে রাত কাটে। এই তো হাওরের এক অপূর্ব জীবন। আষাঢ়ে পূর্ণিমা রাতে মেঘের ভিতর থেকে চাঁদ বেরুলেই নবযৌবনা সুন্দরীর আছড়ে পড়া রূপের মতো জলের সঙ্গে যখন খেলা করে, তখন এক রহস্যময়তার সৃষ্টি হয়। তখন মানুষ স্বর্গের সুখ পায়। ঠিক তেমনি জোছনা রাতে যখন অকাল বন্যায় বাঁধ ভেঙে কৃষকের স্বপ্নের ফসল ভেসে যায়, তখন বাঁধ রক্ষার লড়াইয়ে পরিশ্রমী কৃষক একপর্যায়ে তার বুক ঠেলে দেয়। চোখের কোণে জোছনার আলোয় চিক চিক করে ওঠে অশ্রুবিন্দু। বর্ষার অবিরাম বৃষ্টির শব্দে টিনের বাড়িতে সুখনিদ্রা, জোছনালোকিত জলের নৈসর্গিক দৃশ্য হাওরের মানুষকে মুগ্ধই করে না, ফসল হারিয়ে গেলে এই সুখটুকুও শেষ হয়ে যায়।

বিস্তীর্ণ হাওরের বেদনার অশ্রুবিন্দু মুছে দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রবিবার সুনামগঞ্জ সফর করেছেন। দুর্গত এলাকার শাল্লার মানুষের মধ্যে ত্রাণ সহায়তা দিয়েছেন। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে বাংলাদেশকে খাদ্য রপ্তানির দেশ হিসেবে যে গৌরবের জায়গায় নিয়ে এসেছেন, সেখানে অনন্য সাধারণ ভূমিকা রেখেছে বিস্তীর্ণ হাওর অঞ্চলের প্রকৃতির আঁচরের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো পেশিবহুল কৃষকেরা। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি রক্ষায় বিশেষজ্ঞদের মতে,  প্রবাসী শ্রমিকের রেমিট্যান্স ও আমাদের কৃষকের ঘাম ঝরানো শ্রমের ফসল ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছিল। সেই কৃষকের এ দুঃসময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৭টি ঘোষণা দিয়েছেন। ঘোষণাগুলো হচ্ছে— ১. বিনামূল্যে সার বীজ ও কৃষি উপকরণ পাবে হাওরবাসী। ২. সুদের হার ৫০ ভাগ কমিয়ে ঋণ আদায় স্থগিত আপৎকালীন সময়ের জন্য। ৩. দুর্গত এলাকায় বেসরকারি ঋণ আদায়কারীদের তত্পরতা তদারকির নির্দেশ। ৪. ১০ টাকায় চাল বিতরণে প্রত্যেক ইউনিয়নে ডিলার নিয়োগ হবে। ৫. চালের মজুদদারীদের অনিয়ম দমন করারও নিশ্চয়তা। ৬. হাওরের নাব্য বাড়াতে ড্রেজিং ও গভীর খাল খনন এবং সময়মতো বাঁধ নির্মাণে সমন্বয় আনতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের মধ্যে সমন্বয় ও দুরদর্শিতা প্রকাশ ঘটানোর নির্দেশ। ৭. দুর্নীতি অপচয় ও গাফিলতিতে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, হাওর এলাকায় যত খাদ্য ও গোখাদ্য প্রয়োজন সব দেবে সরকার।

প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণা কৃষকদের বুঁকভাঙা আর্তনাদ আর ক্রন্দনই থামাবে না; নতুন করে ঘুরে দাঁড়াতে শক্তি জোগাবে। হাওরের কৃষকদের হাত-পা শুধু কৃষি ব্যাংকের কৃষি ঋণেই বাঁধা থাকে না। গ্রামীণ ব্যাংকসহ ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানকারী সংস্থাগুলো ছাড়াও মহাজনী দাদন ব্যবসায়ীদের চড়া সুদের চক্রবৃদ্ধি হারের সুদে ডুবে থাকে। ফসল হারিয়ে গেলে হালের বলদই যায়, ভিটেমাটিও কেড়ে নেয় ওরা। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা এদেরও মনিটর করতে যে কথা বলেছেন তা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। তিনি বিনামূল্যে কৃষি উপকরণ, গোখাদ্য ও মানুষের খাবারের যে নিশ্চয়তা দিয়েছেন তাতে তাকে অভিনন্দন জানাতেই হয়। প্রধানমন্ত্রীকে এ অনুরোধটুকু, এ আবেদনটুকু হাওরের বিস্তীর্ণ মানুষের হয়ে জানাতেই হয়, জল জোছনায় বেড়ে ওঠা হাওরের সন্তান হিসেবে যে কৃষিঋণ আদায় স্থগিত রাখার পাশে ঋণের সুদের হার ৫০ ভাগ নয়, পুরোটাই মওকুফ করে দিন। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিবেদন, এতটাই যখন করলেন তাহলে আগামীতে সুদমুক্ত কৃষিঋণের সুযোগটিও দিন। একেবারে দুর্বল কৃষকদের জন্য অর্থ সাহায্যেরও ব্যবস্থা নিন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি হাওরের ফসল রক্ষায় নদীর নাব্য বাড়াতে ড্রেজিং এবং দীর্ঘমেয়াদি অথবা আপৎকালীন সময়ের বাঁধ নির্মাণের দায়িত্ব দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর হাতে দিন। কারণ পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রতি মানুষের আস্থা, বিশ্বাস বছরের পর বছর ঘটে যাওয়া ভাগ-বাটোয়ারায়, কৃষকের ভাগ্য নিয়ে খেলায় একদম চলে গেছে। খাবার সাহায্য ও খোলাবাজারে চাল বিক্রির ব্যাপক কার্যক্রম সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় আনতে আপনি নিজেই মনিটর করুন। একই সঙ্গে কোথাও অনিয়ম হলে গণমাধ্যমকর্মী ও মানুষেরা যাতে অভিযোগ দিতে পারে সেজন্য আলাদা একটি তথ্যকেন্দ্র খুলুন। এ দুর্যোগ মোকাবিলায় যে কর্মযজ্ঞ শুরু করেছেন সেখানে জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন, স্থানীয় সরকার, এনজিও এবং সামাজিক শক্তিসমূহকে সমন্বিতভাবে কাজে লাগান।

প্রধানমন্ত্রী ঢাকায় ফিরে আসার পর রাত নামতেই মহাপ্রলয় ঘটে যায় সুনামগঞ্জে। কালবৈশাখীর তাণ্ডবে ৭ থেকে ৮শ’ ঘরবাড়ি পড়ে গেছে। উপড়ে পড়েছে একের পর এক বৃক্ষ। উড়ে গেছে টিনের চাল। এ যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। শুধু খাবার দিলেই হবে না, সরকার ও রাজনৈতিক শক্তি এবং বিত্তবানদের ব্যাপক হারে মানুষের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক করে তুলতে ঘরবাড়ি নির্মাণ ও মেরামতে আর্থিক অনুদানও দিতে হবে।

রাজনীতি যদি হয় মানুষের কল্যাণে তাহলে একটি প্রশ্ন ব্যক্তিগতভাবে থেকেই যায়। দেশের ছোট-বড় সব রাজনৈতিক দলের হাওরবাসীর পাশে এ বিপর্যয়ে দাঁড়ানোর ব্যাপারে উদাসীনতা দেখে বিস্মিত হয়েছি। শুধু তাই নয়; সংসদে প্রশ্নবিদ্ধ বিরোধী দল সেখানে যায়নি। তারচেয়ে মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন— বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াও কেন এ বিপর্যয়ে হাওরের নিঃস্ব কৃষকের কাছে যাননি। তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে থাকলে মানুষের সামনে তার দলকে একথা বলতে হবে। রবিবার রাতে একাত্তর টিভির টকশোতে অংশ নিতে গেলে এ প্রশ্ন তুলতেই বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু তা উড়িয়ে দিয়ে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে বসলেন। বললেন, ‘পীর হাবিবুর ছাত্রলীগের প্রোডাক্ট, এটা তিনি বলবেনই। ’ শামসুজ্জামান দুদুকে আমি পছন্দ করি। কারণ পূর্ববাংলার সর্বহারা রাজনীতির নামে অতি বিপ্লবের অন্ধকার মানুষ হত্যার, কলকারখানায় আগুন দেওয়ার রাজনীতির গর্ত থেকে আলোর রাজনীতিতে উঠে এসেছেন। তিনি আমাকে আওয়ামী লীগার বললেও ভুল বলেছেন। স্কুলজীবন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর আদর্শে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলাম সত্য। পেশাদারিত্বের জীবনে জড়ানোর পর সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলতেই শিখেছি। ছাত্রলীগের রাজনীতি করেছি, এটা গৌরবের। কারণ জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে যে ঐতিহাসিক ভূমিকা ছাত্রলীগ রেখেছিল, কৈশরোত্তীর্ণ তারুণ্যে আমি তার উত্তরাধিকারিত্বই বহন করেছি। দলদাস দলকানাদের এ যুগে সুবিধাবাদীদের উল্লাস নৃৃত্য দেখেছি। তাই বলে, কোনো সরকারের কাছে কখনই দাসত্ববরণ যেমন করিনি, তেমনি কোনো ব্যক্তিগত সুবিধাও নিইনি। যখনই প্রাকৃতিক দুর্যোগ এসেছে, সেটি নদীভাঙন হোক, লঞ্চডুবি হোক, উপকূলীয় ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাস হোক বিরোধী দলের নেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনাকে সবার আগে ছুটে যেতে দেখেছি। বিএনপি মহাসচিব হাওর অঞ্চল ঘুরে এসেছেন, সত্য। কিন্তু আজকের বাংলাদেশে জনপ্রিয়তা, জনমতের কারণে শেখ হাসিনা কোথাও গিয়ে দাঁড়ালে যে প্রভাব পড়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেখানে দাঁড়ালে তা পড়ে না। তেমনি বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া কোথাও গেলে যে ঢেউ ওঠে, তার দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দুদুদের নিয়ে দিন-রাত ঘুরলেও সেই ঢেউ ওঠে না। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া মানুষের ভোট চাইবেন, ক্ষমতায় আসতে চাইবেন; আর জনতার দুঃসময়ে ছুটে যাবেন না, তা হয় না। তিনি গেলে সরকারের এবং শাসক দলের নেতা-কর্মী ও প্রশাসন অনেকটাই চাপে পড়বেন। দায়িত্ব পালনে বেশি সতর্ক হবে। তাই তিনি কেন যাননি এ প্রশ্নের উত্তর জানতে চেয়েছিলাম। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, আজকের বাংলাদেশে, ধর্মের সমালোচনা করা যায়; নেতানেত্রীদের দিকে আঙ্গুল তোলা যায় না। শুধু সরকারের একচোখা সমালোচনা করলেই দলকানা দুদুরা মনে করেন নিরপেক্ষ হওয়া যায়। নিরপেক্ষ হওয়ার জন্য হৃদয়নিঃসৃত, বিবেকতাড়িত কথা ও কাজ করতে হয়। রাষ্ট্রপতি কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জে ছুটে যেতে পারেন। তাকে যেতে হলে অনেক প্রটোকল মেনে যেতে হয়, প্রধানমন্ত্রীকেও তাই।   প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শাল্লায়, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া কেন ঢাকায়?  এ প্রশ্ন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কাছে রাখতেই পারি।

ভারতের চেন্নাইয়ের বন্যায় অভিনেতা নানা পাটেকার একটি গ্রামের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। রজনীকান্ত ১০ লাখ রুপি দিয়েছিলেন। শাহরুখ খান ও অক্ষয় কুমার দিয়েছিলেন ১ কোটি করে ২ কোটি রুপি। আমাদের সুপার স্টাররা না-ই যান, স্থানীয় ও জাতীয়ভাবে বিত্তবানরা এ বিপর্যয়ে মানুষের সেবায় কি এগিয়ে আসতে পারেন না? রাষ্ট্রীয়, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সবাইকেই হাওরের মানুষের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে সাহায্যের  হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসতে পারেন।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn