তসলিমা নাসরিন-
১. যা আফগানিস্তানে আজ ঘটছে, তা বাংলাদেশেও, বলা যায় না, কদিন পর ঘটতে পারে। আফগানিস্তানের কোনও নাটকে সিনেমায় অপেরায় বিনোদনে নারীর উপস্থিতি নিষিদ্ধ করেছে তালিবান। ওরা মনে হয় মেয়েদের শুধু সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্যই চায়, যে সন্তান হবে ভবিষ্যতের তালিবান। মেয়েদের ওরা রাস্তাঘাটে, অফিস-আদালতে, ইস্কুল-কলেজে, সংসদে-মার্কেটে কোথাও দেখতে চায় না। মেয়েদের মানুষ পরিচয়কে ওরা কেটে ছেঁটে শুধু যৌনাঙ্গ আর জরায়ু করেছে। সেজন্যই আপাদমস্তক ঢেকে রাখতে বলা হয় মেয়েদের। মেয়েদের মুখ যেন মুখ নয়, চুল যেন চুল নয়, সব যেন গোপন যৌনাঙ্গ। ধর্মান্ধতার সঙ্গে নারী বিরোধিতার একটি নিবিড় সম্পর্ক আছে। একটি আরেকটি ছাড়া টিকে থাকতে পারে না।
২. বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলায় পরাজিত প্রার্থীর সমর্থক মোশারফ শেখের বাড়িতে গিয়ে জোর করে হাতে চুড়ি পরিয়ে দিয়েছে বিজয়ী প্রার্থীর লোকেরা।
কৃষক লীগের সাবেক সভাপতি মোশারফ শেখের দোষ ২০ নভেম্বর কচুয়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের নির্বাচনে ১, ২ ও ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত নারীপ্রার্থী সেলিনা বেগমের পক্ষে কাজ করেছেন। কিন্তু সেলিনা বেগম নির্বাচনে হেরে যাওয়ায় বিজয়ী প্রার্থী মোহিনি বেগমের পক্ষে কচুয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন সম্পাদক আজাদ বালি ও তার সমর্থকরা তাঁকে হুমকি দেয়। এক পর্যায়ে আজাদ বালির নির্দেশে ১৫-২০ জন লোক তাঁর বাড়িতে গিয়ে পরিবারের সদস্যদের সামনে জোর করে তাঁর হাতে চুড়ি পরিয়ে দেয়। এ ঘটনা জানাজানি হলে গ্রামের মানুষ তাঁর বাড়িতে ভিড় করে। মনে হয় শেখের চুড়ি পরা ‘হাস্যকর’ হাতটি দেখার জন্যই ভিড় করে।
চুড়ি যেহেতু মেয়েরা পরে, তাই চুড়ি পরা পুরুষের জন্য অপমান। মেয়েরা অনায়াসে পুরুষের পোশাক পরে। পুরুষের শার্ট-প্যান্ট, জুতো জ্যাকেট হ্যাট যে মেয়ে পরে, তাকে ‘স্মার্ট মেয়ে’ বলা হয়। আর যে পুরুষ মেয়েদের শাড়ি ব্লাউজ, স্কার্ট, কামিজ, হাইহিল পরে, তাদের অপমান করা হয়, অপদস্থ করা হয়। মনে করা হয় মেয়েদের পোশাক পরলে পুরুষের মানসম্মান নষ্ট হয়ে যায়।
মেয়েদের কতটা ঘৃণা, কতটা অবজ্ঞা অবহেলা অসম্মান করলে তাদের পোশাক আশাককেও অসম্মানের প্রতীক হিসেবে দেখে পুরুষেরা-তা নিশ্চয়ই আমরা অনুমান করতে পারি।
মেয়েরা শিক্ষিত হচ্ছে, সচেতন হচ্ছে, স্বনির্ভর হচ্ছে, তারপরও সমাজে মেয়েদের দুর্বল ভাবার, অসহায় ভাবার, পঙ্গু ভাবার, পরনির্ভর ভাবার মানসিকতা বদলাচ্ছে না। মেয়েদের প্রতি ঘৃণা এতটুকু কোথাও কমছে না।
নারী কোম্পানির মালিক হচ্ছেন, দলের প্রধান হচ্ছেন, বিচারক হচ্ছেন, মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীও হচ্ছেন, তারপরও সমাজে নারীর স্থান যে সবার পিছে সবার নিচে সবহারাদের মাঝে ছিল, আজও তা-ই আছে।
সমাজের নারী বিদ্বেষের জন্য তাই নারী দায়ী নয়, দায়ী পুরুষই।
৩. ‘আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস’ নামে একটা দিবস বানিয়েছে ‘পুরুষ অধিকার আন্দোলন’ MRA (Men’s Rights Activists)-এর সংগে যুক্ত একটি লোক। টমাস ওস্টার নাম। বানানো এই দিবসটি এখন পুরোপুরিই পুরুষ অধিকার আন্দোলনের এক পাল ভয়ংকর নারীবিদ্বেষী কর্মীর নিয়ন্ত্রণে। এই দিবস প্রথম উদযাপিত হয় ভারতে, ২০০৭ সালে। ভারতের কিছু লোক নারীদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে, সংসদ থেকে নারী কোটা বাতিল করার, নারী নির্যাতন আইন বিলুপ্ত করার, পণ প্রথা বহাল রাখার, ধর্ষণের জন্য ধর্ষককে নয়, নারীদের দোষ দেওয়ার দাবি জানিয়ে ‘পুরুষ দিবস’ পালন করে।
পুরুষ নানা কারণে অত্যাচারিত হয়। কিন্তু পুরুষরা পুরুষ হওয়ার কারণে অত্যাচারিত হয় না। নারীরাও নানা কারণে অত্যাচারিত হয়, নারীরা কিন্তু একটি ভিন্ন কারণেও অত্যাচারিত হয়, নারী হওয়ার কারণে। নারীদের অধিকার আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য নারী বলে কাউকে অত্যাচার নির্যাতন করা চলবে না। পুরুষেরা যেহেতু পুরুষ হওয়ার কারণে অত্যাচারিত হয় না, তাই তাদের পুরুষ অধিকার আন্দোলন অর্থহীন একটি আন্দোলন।
৪. সেদিন এক সাংবাদিক জিজ্ঞেস করলো, ‘দিদি আপনার শেষ প্রেম কবে?’ আমি বললাম, ‘প্রেম তো আমি করছি আজো’। সাংবাদিক ঠিক বুঝে পেলো না আমি কী বলতে চাইছি। আসলে ধারণা করেছিল আমি বলবো, শেষ প্রেম ছিল দশ বা কুড়ি বছর আগে। আমাকে আবারো একই প্রশ্ন করলো, ‘আপনার শেষ প্রেম সম্পর্কে বলুন। সেটা আজ থেকে ক’বছর আগে।’ আমি আবারও বললাম, ‘আমি তো প্রেম করছি এখনো! শেষ প্রেমের ব্যাপার নেই’। শুনে একটু অপ্রস্তুত হলো সাংবাদিক।
বাঙালিই তো তৈরি করেছে প্রবাদ বাক্য-মেয়েরা কুড়িতেই বুড়ি। আমাদের পূর্ব নারীরা ওই প্রবাদ সহ্য করেছে। আমাদের সময় পিতৃতান্ত্রিক সমাজ অনেকটাই আধুনিক হয়েছে, কুড়িটাকে বাড়িয়ে তিরিশ বা পঁয়ত্রিশ এরকম কিছু একটা করেছে। তাই ওই বয়সের পরে মেয়েদের যে প্রেম-জীবন আর যৌনজীবন থাকতে পারে, তা বিশ্বাসও করতে পারে না, মেনেও নিতে পারে না।
৫. সেই ছোটবেলা থেকেই বলছি ‘মেয়েরাও মানুষ’। মেয়েদের মানুষের পর্যায়ে উত্তীর্ণ করার জন্য আমি কতকাল মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম। আজকাল মনে হয়, ‘মানুষ’ এমন কী ভালো ব্যাপার! মানুষ জাতটা নিয়ে গৌরব করারই বা কী আছে। জাতটা কত বর্বর, তা এর যুদ্ধবিগ্রহের আর মেয়েদের দাবিয়ে রাখার ইতিহাসই বলে। স্বীকার করি, এই জাতটার মধ্যে কিছু লোক ভালো, যারা জাতটাকে সভ্য করতে চেয়েছে, জ্ঞান বিজ্ঞান শিল্প দর্শনের চর্চা করেছে, সমতা আর সমানাধিকারের কথা বলেছে। কিন্তু জাতটার বেশির ভাগই হিংস্র, কুচুটে, স্বার্থপর, অনুদার। মেয়েদের ‘মানুষ’ বলে গণ্য করা হয় না। একদিক থেকে ভালো। মেয়েদের জন্য সুখবর।
আমাকে মেয়ে বলে ডেকো, মানুষ বলো না। সবচেয়ে খুশি হবো, যদি হরিণ বলে ডাকো।
৬. বাংলাদেশের এক লেখক নাট্যকার সেলিম আল দীনের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধা ভরে লিখেছেন :
“সেলিম আল দীন প্রেমিক পুরুষ ছিলেন। জীবনে একাধিক প্রেম করেছেন। সেসব প্রেমের কথা তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন। তাঁর প্রেমিকাদের সম্পর্কে জানতে আপনারা পড়ে নিতে পারেন তাঁর ‘ভাঙা প্রেম অশেষ বিশেষ’ বইটি। ঢাকার জাগৃতি প্রকাশনী থেকে বইটি প্রকাশিত হয়। ঢাকার দীপনপুরে বইটি পাওয়া যায়। এছাড়াও তাঁর জীবনের নানা কথা তিনি লিখেছেন তাঁর দিনলিপিতে। নারীদের প্রতি তিনি কতটা শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, ছাত্রীদের তিনি কতটা স্নেহ করতেন, পিতার মতো কীভাবে আগলে রাখতেন, তা তাঁর ছাত্রছাত্রী, ভক্ত-শিষ্য সবার জানা।
ঋষিতুল এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে, বাংলা নাটকের এই প্রাণপুরুষের বিরুদ্ধে মুশফিকা লাইজু যে অভিযোগ তুলেছেন, তা সম্পূর্ণ কাল্পনিক এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে করছি। আমরা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। আশা করি মুশফিকা লাউজু সাক্ষ-প্রমাণহীন তাঁর এই কাল্পনিক অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেবেন।’’
বুঝি না আমার সম্পর্কে লিখতে গিয়ে কেউ আজ পর্যন্ত শ্রদ্ধায় গদগদ হয়ে এ রকমভাবে লিখলো না কেন। যেমন :
“তসলিমা নাসরিন প্রেমিকা নারী ছিলেন। জীবনে একাধিক প্রেম করেছেন। সেসব প্রেমের কথা তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন। তাঁর প্রেমিকদের সম্পর্কে জানতে আপনারা পড়ে নিতে পারেন তাঁর ‘উতল হাওয়া’ আর ‘দ্বিখণ্ডিত (ক)’ বই দুটো। কলকাতার পিবিএস থেকে বই দুটো প্রকাশিত হয়। নীলক্ষেতের ফুটপাথে বই দুটোর পাইরেট এডিশন পাওয়া যায়। এছাড়াও তাঁর জীবনের নানা কথা তিনি লিখেছেন তাঁর আত্মজীবনীগুলোয়। পুরুষদের প্রতি তিনি কতটা শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, জুনিয়রদের তিনি কতটা স্নেহ করতেন, মায়ের মতো কীভাবে আগলে রাখতেন, তা তাঁর পাঠক-পাঠিকা, ভক্ত-শিষ্য সবার জানা।
দেবীতুল্য এই লেখিকার বিরুদ্ধে, বাংলা সাহিত্যের এই প্রাণনারীর বিরুদ্ধে সমাজের পুরুষগোষ্ঠী যে অভিযোগ তোলেন, তা সম্পূর্ণ কাল্পনিক এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে করছি। আমরা এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। আশা করি পুরুষগোষ্ঠী সাক্ষ্য-প্রমাণহীন তাঁদের কাল্পনিক অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেবেন।’’
আমি কাউকে এ জীবনে যৌন হেনস্থা করিনি। তারপরও আমার পক্ষে চিৎকার করা দূরে থাক, মিনমিন করেও খুব বেশি কাউকে বলতে শুনি না। বরং যত অশ্রাব্য গালি দুনিয়াতে আছে, সবই আমার ওপর বর্ষিত হয়।
পুরুষ এবং নারীকে ভিন্ন চোখে আর কতকাল দেখবে মানুষ?
৭. বাংলাদেশের মেয়েরা #মিটু #মিটু কম করেনি। যে পুরুষগুলোর কীর্তিকলাপ তুলে ধরেছে, তারা যেমন বহাল তবিয়তে ছিল, তেমন বহাল তবিয়তেই আছে। এখন পর্যন্ত একজনেরও মাথা হেঁট হয়নি, একজনও ক্ষমা চায়নি, একজনেরও চাকরি যায়নি, একজনকেও কোনও কোম্পানি থেকে বহিষ্কার করা হয়নি। আমার মনে হয় এসব #মিটু তাদের জিরো বানাবার বদলে হিরো বানিয়েছে। মেয়েদের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করা, মেয়েদের ওড়না টান দিয়ে নিয়ে যাওয়া, মেয়েদের বুক টিপে দেওয়া, জোর করে চুমু খাওয়া, পেটে কাতুকুতু দেওয়া, নিতম্বে থাবা দেওয়া, অথবা মেয়েদের জোর জবরদস্তি ন্যাংটো করা, বিছানায় ধাক্কা মেরে শোয়ানো চিরকালই ওই সমাজে হিরোদের কাজ। হিরোরা পুরুষালি পুরুষ, ওদের শরীরে বাঘের শক্তি। মেয়েরা কম শক্তির পুরুষদের পছন্দ করে না, যে পুরুষ মেয়েদের সম্মান করে, মেয়েদের কথা শোনে, মেয়েদের ধমকায় না, মারে না, মেয়েদের সঙ্গে নরম স্বরে কথা বলে, লজ্জা পায়, শরম পায়, দুঃখে কষ্টে চোখের জল ফেলে, তারা নাকি মেয়েলি পুরুষ, তাদের নাকি মেয়েদের পছন্দ নয়। মাচো’দের নাকি মেয়েরা পছন্দ করে। এই প্রচারটি কবে শুরু হয়েছিল জানি না, আজ এটি মানুষের মস্তিষ্কে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে।
#মিটু কাজে লাগার জন্য সমাজের মিনিমাম একটা কোয়ালিটি চাই। বাংলাদেশের সমাজের সেই কোয়ালিটি নেই। মানুষের বেসিক সেন্স নেই, যে সেন্স বলবে ‘মেয়েরা যৌনবস্তু নয়, মেয়েদের সঙ্গে যা ইচ্ছে তাই করার অধিকার পুরুষের নেই।’ বাংলাদেশের সমাজের বেশির ভাগ মানুষ বিশ্বাস করে মেয়েরা যৌনবস্তুÍ, মেয়েদের সঙ্গে সব রকম বদমাইশি করার অধিকার পুরুষের আছে। মানুষ এও গভীরভাবে বিশ্বাস করে, পুরুষের যৌন ক্ষিধেটা একটু বেশি, তাদের একটু বেশিই খাই খাই। ঘরে বউ রেখেও বাইরের মেয়েদের সঙ্গে যৌনসম্পর্ক তারা করতে চাইলে করতেই পারে। কামনা বাসনার পরিমাণ একটু বেশি ঢালা হয়েছে তাদের সৃষ্টির সময়, এ তো তাদের দোষ নয়।
আমার তো মনে হয় যে পুরুষেরা মেয়েদের হেনস্থা করেছে, তাদের সুখ্যাতি বেড়েছে। আগে তারা ছোট গণ্ডিতে হিরো ছিল, এখন পুরো দেশেই তারা হিরো। #মিটুর জন্য পুরুষদের নয়, মেয়েদেরই শরমে মুখ লুকোতে হয়েছে।
৮. যৌন উত্তেজনা বেড়েছে তোমার, সে তোমার সমস্যা, আমার নয়। তোমার সেটি বাড়ে বলে আমার নাক চোখ মুখ সব বন্ধ করে দেবে, এ হতে পারে না। আমি তোমার ব্যক্তিগত সম্পত্তি নই যে তুমি আমাকে আদেশ দেবে আমি কী পরবো, কীভাবে পরবো, কোথায় যাবো, কতদূর যাবো।
তোমার সমস্যার সমাধান তুমি করো। আমাকে তার দায় নিতে হবে কেন!
যৌন উত্তেজনা আমারও আছে, সে কারণে তোমার নাক চোখ মুখ ঢেকে রাখার দাবি আমি করিনি।
৯. কত কিছুর দিবস যে পালিত হচ্ছে। শুনলাম ‘কন্যা দিবস’ও আজকাল পালন করা হচ্ছে। জানি না পুত্র দিবস বলে কোনও দিবস আছে কিনা। আসলে পুত্র দিবস তো প্রায় প্রতিদিনই পালিত হয়। কন্যা যেহেতু অনেক সংসারেই অবহেলিত, তাই কন্যাকে মূল্য দেওয়ার জন্য, আমার ধারণা, একটি দিবস তৈরি করা হয়েছে। আমার কন্যাও নেই, পুত্রও নেই। যৌবনে অনেক ভুল সিদ্ধান্ত নিলেও সন্তান না জন্ম দেওয়ার সিদ্ধান্তটি আমার সঠিক ছিল। ৭৮০ কোটি লোকে পৃথিবী উপচে পড়ছে, এই দুঃসময়ে জনসংখ্যা বাড়ানোর কোনও প্রয়োজন নেই। যারা জন্মেছে তারা কি সবাই খেতে পরতে পাচ্ছে, শিক্ষা স্বাস্থ্য পাচ্ছে?
ইতর প্রাণীর মধ্যে বংশ বিস্তারের ইচ্ছেটা কিলবিল করে, এই কিলবিল ব্যাপারটি নিয়ন্ত্রণ করতে তারা পারে না। মানুষের মধ্যেও এই ইচ্ছেটি আছে, তবে এটি আরোপিত। আরোপিত বলেই এটি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। অনেকে সন্তান জন্ম দেওয়ার ইচ্ছে নেই বলে সন্তান জন্ম দেয় না। কিছু মানুষ, আমার অবাক লাগে, মনে করে সন্তান জন্ম না দিলে তাদের জীবনই ব্যর্থ, অর্থহীন। তারা সন্তানের জন্য ইতর প্রাণীদের মতো কিলবিল করা ইচ্ছের আমদানি করে। আমার এক বোন উচ্চশিক্ষিতা, নামি কলেজের অধ্যাপিকা, কিন্তু সন্তান নেই বলে এমনই দুঃখে কষ্টে ডুবে থাকে যে তার জীবনটিই সে উপভোগ করে না। তার এমন অর্থপূর্ণ জীবনটিকে সে যে অর্থহীন মনে করছে, এ দোষ কার বা কাদের? তার কানের কাছে যারা শৈশব থেকে গুনগুন করেছে সন্তান না জন্মালে জীবনের কোনও মানে নেই, দোষ নিশ্চয়ই তাদের অনেকটা, বাকি দোষ তাদেরও যারা যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে নারীবিদ্বেষী রীতিগুলোকে ভাঙার কোনও চেষ্টা করে না।
প্রজাতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যদি প্রজননের প্রয়োজন পড়তো, কথা ছিল। এখন তো দেখা যাচ্ছে মানুষের আধিক্য একটা ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করেছে। লক্ষ কোটি অরণ্য-নির্ভর প্রাণীর আবাসস্থল উড়িয়ে দিয়ে মানুষের জন্য শহর নগর বানাতে হয়েছে। পৃথিবীর কত প্রজাতি যে আমাদের মানুষ-প্রজাতির হিংস্রতা আর বোধবুদ্ধিহীনতার কারণে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এই গ্রহে আমাদের যতটা অধিকার, ততটা অধিকার তো তাদেরও। অস্ত্রের জোরে কী অরাজকতাই না আমরা চালিয়েছি! আমরা পৃথিবীর বন জঙ্গল ধ্বংস করেছি, নদী সমুদ্র আকাশ বাতাস দূষিত করেছি আমাদের স্বার্থান্ধ জীবনযাপন এবং আমাদের অর্থহীন জনসংখ্যা দিয়ে। অনেকে মনে করেন, জ্ঞানীগুণীদের সন্তান জন্ম দেওয়া উচিত। কিন্তু বারবার প্রমাণিত হয়েছে, জ্ঞানীগুণীদের সন্তান জ্ঞানীগুণী হয় না। আর কত প্রমাণ দরকার! মৃত্যুতেই জীবনের চিরকালীন সমাপ্তি। বংশ রয়ে গিয়ে, রক্তের ছিটেফোঁটা রয়ে গিয়ে কারও কোনও লাভ হয় না।
আজ এতকাল পরও নিজেকে আরেকবার ধন্যবাদ দিই, না পুত্র না কন্যা কিছুই জন্ম না দিয়ে আমি একটি স্বাধীন এবং অর্থপূর্ণ জীবনযাপন করেছি বলে। তুমি সন্তান জন্ম দিয়ে জীবনকে অর্থপূর্ণ করার চেষ্টা করো না। তুমি তোমার কাজ দিয়ে জীবনকে অর্থপূর্ণ করো। তুমি কে, তুমি কী সেটাই বড়। সন্তান যে কেউ জন্ম দিতে পারে, যে কোনও গণ্ডমূর্খই, এ কোনও উল্লেখযোগ্য ব্যাপার নয়।
লেখক : নির্বাসিত লেখিকা
সংবাদ টি পড়া হয়েছে :
২৫২ বার