নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন, আইনের শাসন ও বঙ্গবন্ধু
আনিসুল হক-বঙ্গবন্ধু জীবনের শুরু থেকেই একটি বৃহৎ পরিকল্পনা নিয়ে রাজনীতি শুরু করেন। পাকিস্তান আন্দোলনে তিনি শরিক হন ঠিকই কিন্তু পাকিস্তানের জন্মের পরই তিনি বুঝতে পারেন যে, তিনি যে মানুষগুলোকে ভালোবাসেন, যে মানুষগুলোর দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করার স্বপ্ন দেখেন এবং যে মানুষগুলোর মুখে হাসি ফুটাতে চান সেই মানুষগুলোর ও তাদের বাসস্থান অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ববাংলার (বর্তমান বাংলাদেশ) কোনো পরিবর্তন এই স্বাধীনতা এনে দিবে না। ঠিক এর পাশাপাশি তিনি মনে করেন যে, যারা পাকিস্তান আন্দোলন করেছেন তাদের ভাবনা-চিন্তার পরিবর্তনের পাশাপাশি ছাত্রসমাজকে একটি সংগঠনের মাধ্যমে সংঘবদ্ধ করে তার প্রিয় বাঙালিদের, তার ভালোবাসার বাঙালিদের ভাগ্য পরিবর্তনের লড়াইয়ের জন্য তৈরি করতে হবে। তাহলেই, তার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়া সম্ভব হবে। ঠিক সেভাবেই বঙ্গবন্ধু তার রাজনৈতিক জীবনের অবকাঠামো তৈরি করেছিলেন। তিনি এক পাশে ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, অন্য পাশে আওয়ামী মুসলিম লীগের হাল ধরেছিলেন। বঙ্গবন্ধু শুরু থেকেই নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির মাধ্যমে তার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার কর্মপন্থা ও কর্মসূচি জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য নির্বাচনের পথ অবলম্বনে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি সবসময় মনে করতেন, জনগণই শক্তি, তাই জনগণের ক্ষমতায়নের মাধ্যমেই কেবল সোনার বাংলা গড়া সম্ভব। অধিকার প্রতিষ্ঠা, গণতান্ত্রিক পদ্ধতি হিসেবে নির্বাচন আর অধিকার হরণ করার আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করাই ছিল বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক একটি বৈশিষ্ট। সেকারণেই ১৯৪৮ সালে বাংলাকে মাতৃভাষা না করার বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার ভূমিকা রাখেন ও ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে জেলখানা থেকে নির্দেশনা দেন। এর অব্যবহিত পরেই তিনি ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন এবং ১৯৫৪ সালে তিনি প্রথমবারের মতো কৃষি, ঋণ, সমবায় ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান।
১৯৫৬ সালে তিনি আবারও কোয়ালিশন সরকারের বাণিজ্য, শ্রম, শিল্প, সমাজকল্যাণ, সমবায় ও দুর্নীতি দমনবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। নিরঙ্কুশ বিজয়ের পরেও পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করার ষড়যন্ত্র বাংলার জনগণের কাছে উন্মোচিত হয়। বঙ্গবন্ধু পরিষ্কারভাবে বাংলার জনগণকে বোঝানো শুরু করেন যে, পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের ভাগ্য উন্নয়ন করতে দিবে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব যতই বাংলাদেশের জনগণ গ্রহণ করছিল ও বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা যতই বাড়ছিল ততই তিনি পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর চক্ষুশূল হয়ে উঠছিলেন এবং তাকে পাকিস্তানের সব সরকার কর্তৃক বারংবার কারাগারে পাঠানো হচ্ছিল। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু যখন ছয় দফা ঘোষণা করেন তখন আইয়ুব খান বুঝতে পারেন যে, বঙ্গবন্ধু তার সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট পথে এগুচ্ছে। এটা বুঝতে পেরেই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি করে বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়। তবে, বারংবার কারাগারে পাঠানো হলেও বঙ্গবন্ধু কখনোই কারাগার থেকে কারো দয়ায় বেরিয়ে আসেননি। আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে আদালত থেকে মুক্তি নিয়েছেন তিনি। অনেক সময় জনগণের রোষানল থেকে বাঁচার জন্য সরকার তাকে মুক্তি দিয়েছে। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে এমন অসংখ্য মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা দায়ের করেছিল যা পরবর্তীতে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে এবং বিচারকরা মামলার Judgment-এ বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য ও পদক্ষেপকে আইনসঙ্গত বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। এখানে প্রথমেই আমি উল্লেখ করতে চাই বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে একটি মিথ্যা দুর্নীতির মামলার কথা যা করা হয়েছিল ১৯৫৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি। এ মামলায় নিম্ন আদালতে বঙ্গবন্ধুকে সাজা দেওয়ার পরে পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্ট ১৯৬৩ সালের জুলাই মাসে বঙ্গবন্ধুকে বেকসুর খালাস দেন। সেখানে বিচারপতি আসির ও বিচারপতি আলীর দ্বৈত বেঞ্চে এই রায় হয়। উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধুর সেই সময়কার মন্ত্রী হিসেবে একটি নোটের বিষয়ে বিচারপতিগণ ভূয়সী প্রশংসা করেন। বঙ্গবন্ধু সেখানে লিখেছিলেন,
‘My idea is to eliminate import of soft coke not abruptly but gradually so that the proposed industrialist can build up his factory to convert hard coal into soft coke to meet the entire requirement of the Province. To achieve this object the present agency for import of soft coke should be cancelled and the applicant M/S Coal Mining and Trading Co. (Pakistan) Ltd., Should be appointed as the agent on definite condition that he must complete his arrangements to meet the local demand of soft coke by converting imported hard coal within one year failing which Government will review the whole matter.’ ‘To start the industrial unit, they should get permission to import five hundred tons of hard coal,’ ‘Action should be taken within ten days.’
এখান থেকেই পরিষ্কার বুঝা যায় যে, স্বচ্ছ ভাষায় বাংলার অধিকার রক্ষার কথা তিনি সবসময় মন্ত্রী হিসেবে লিপিবদ্ধ করে গেছেন। তারপর ১৯৬৭ সালের আগস্ট মাসের ৯ তারিখে (আরেকটি রায়ে) পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের একটি বিশেষ বেঞ্চ একটি বিভক্ত রায়ে Defense of Pakistan Rules এর আওতায় বঙ্গবন্ধুর আটকাদেশ বৈধ বলে ঘোষণা দেন। এ বিশেষ বেঞ্চে ছিলেন বিচারপতি বাকের, বিচারপতি আব্দুল্লাহ ও বিচারপতি আব্দুল হাকিম। বিচারপতি আব্দুল্লাহ অপর দুই বিচারপতির সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে বঙ্গবন্ধুর আটকাদেশকে অবৈধ বলে রায় দিয়েছিলেন। সে রায়ে তিনি বলেছিলেন:
‘It further appears that Awami League is a political party functioning in the country. It has admittedly adopted the six-point programme as a political platform. The basic idea of the six-point programme seems to be to give complete provincial autonomy to both the wings of Pakistan in accordance with the Lahore resolution of 1940. Admittedly no steps have been taken by the Government to refer either the six-point programme or the activities of the party under section 6 of the Political Parties Act, to the Supreme Court. In these circumstances the detenu who is the President of the party could not be said to have indulged in prejudicial activities in his attempt to project the six-point programme to the people.’
এরপর আমি অত্যন্ত বিনীতভাবে আরেকটি মামলার কথা উল্লেখ করতে চাই, সেখানেও বঙ্গবন্ধুকে Defense of Pakistan Rules এর আওতায় আটক করা হয় এবং বিচারপতি আব্দুল হাকিম ১৯৬৯ সালের ৬ মের রায়ে বঙ্গবন্ধুর আটকাদেশ ও দণ্ডাদেশ অবৈধ বলে রায় দেন। রায়ে তিনি বলেন,
‘He has contended that the speech was made by the accused petitioner in furtherance of his own political theory, namely, the six-point programme of the Awami League for maintaining the integrity of Pakistan and removing the causes of disparity between the two Wings and the speaker was within the bounds of law in criticizing the policies of the Government.’
বঙ্গবন্ধুর আইনজীবী সিরাজুল হক উল্লিখিত বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন যে,
‘One think apparent is that some of the matters introduced in the speech, though appeared to be unpalatable are factually true and pleasant truth.’
এই দৃষ্টান্তগুলো থেকেই বুঝা যায়, বঙ্গবন্ধু আইনী লড়াইয়ের মাধ্যেমে বাংলাদেশের জনগণের দাবিকে বৈধতা এনে দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধার সবচেয়ে বড় নিদর্শন হচ্ছে ১০ মাসের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি সংবিধান উপহার দেওয়া। সেই সংবিধানে স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা ও সদ্য স্বাধীন দেশে ১৯৭৩ সালে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। বলতে লজ্জা হয় যে, ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট এ দেশেই ঘাতকদের বুলেটে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের প্রায় সব সদস্যের প্রাণ হারাতে হয় এবং এই খুনিদের রক্ষা করার জন্য ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫ সালে Indemnity Ordinance নামে একটি কালো আইন জারি করা হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার পেতে জাতিকে ২১ বছর অপেক্ষা করতে হয়। তার কন্যাকে নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করতে হয় ও ১২ নভেম্বর ১৯৯৬ সালে সেই কালো আইনকে বাতিল করতে হয়। সাধারণ আইনে নিয়মিত নিম্ন আদালত থেকে উচ্চতম আদালতে ধাপে ধাপে দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এই বিচারকার্য শেষ করা হয় এবং রায় কার্যকর করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় ৬১ জনের স্বাক্ষ্য গ্রহণের মাধ্যমে দোষ প্রমাণিত হওয়ার পরেই আদালত খুনিদেরকে দণ্ডিত করে। হত্যার বিচার প্রক্রিয়াতেও সাধারণ মানুষের থেকে বঙ্গবন্ধু বিচ্যুত হননি। জাতির পিতা হিসেবে সুবিধা নেননি। তাই, এই মহামানব আজীবন বঙ্গবন্ধু। চিরকাল জাতির পিতা। আনিসুল হক: গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী