পাউবো ঠিকাদারদের দাবী যারা কাজ করেনি তাদেরকে ধরুন,অন্যদের বিল পরিশোধ করুন
সুনামগঞ্জ সংবাদদাতা:: সুনামগঞ্জে বিলের দাবীতে সংবাদ সম্মেলন করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) এর ঠিকাদার ও তাদের ভাগীদাররা। এতে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন মেসার্স মালতী এন্টারপ্রাইজের প্রোপাইটর শহরের নতুনপাড়া নিবাসী বিপ্রেশ তালুকদার বাপ্পী। বৃহস্পতিবার দুপুরে শহীদ জগৎজ্যোতি পাঠাগার মিলনায়তনে ঐ সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যের কপিতে জেলার ঘোড়াডুবা হাওর,কাইল্যানী হাওর,ভান্ডা বিল হাওরের কাজে ৪টি কার্যাদেশ প্রাপ্ত সুনামগঞ্জের আরপিননগরের মেসার্স শোয়েব এন্টারপ্রাইজের ঠিকাদার শোয়েব আহমদ, ৩টি পৃথক পৃথক কার্যাদেশ প্রাপ্ত সিলেটের দাড়িয়াপাড়া এলাকার চিন্ময় কান্তি দাসের নিম্মি এন্ড মুমু কন্সট্রাকশনের ভাগীদার ফয়ছল আহমদ মইনুল,সুনামগঞ্জের স্টেশন রোডের শুভব্রত বসুর মেসার্স বসু নির্মাণ সংস্থার ভাগীদার সোহেল আহমদ, নতুনপাড়ার মিলন কান্তি দের মেসার্স প্রীতি এন্টারপ্রাইজের ভাগীদার সুমন ও সাজু এবং নতুনপাড়ার ঠিকাদার আতিকুর রহমান,অস্থানীয় প্রতিষ্ঠান মেসার্স বোনাস ইন্টারন্যাশনাল এর ভাগীদার মোছাদ্দেক হোসেন,মোঃ তছকীর উদ্দিন, মেসার্স আর আর ট্রেডিং এর ভাগীদার মোঃ তোহিদ হোসেন বাবু,সাতক্ষীরার শেখ আশরাফ উদ্দিনের ফার্মের ভাগীদার সাবিদুল ইসলাম,নিয়াজ ট্রেডার্স এর ভাগীদার ভজন তালুকদার,মেসার্স সোহেল কন্সট্রাকশনের ভাগীদার মোঃ মাইদুল ইসলাম খান মামুন ও জমিরুল ইসলাম, ঠিকাদার ওমর ফারুক হারুন,সাইদ এন্টারপ্রাইজের প্রোপাইটর প্রমুখ স্বাক্ষর করেন।
শহরের ষোলঘর আবাসিক এলাকার বাসিন্দা ঠিকাদার ও বিএনপি নেতা কাজী নাসিম উদ্দিন লালা, বিএনপি নেতা আবুল মনসুর শওকত,সাতক্ষীরার শেখ আশরাফ উদ্দিনের ফার্মের ভাগীদার হাজীপাড়ার ঠিকাদার মফিজুর রহমান কুসুম ও সাংবাদিক এ.কে এম মহিম স্বশরীরে উপস্থিত থাকলেও লিখিত বক্তব্যের কপিতে স্বাক্ষর করেননি।
লিখিত বক্তব্যে উল্লেখ করা হয়,এ বছর প্রথমেই ধর্মপাশার চন্দ্র সোনারতাল হাওরের ফসলহানী ঘটে। একটি পিআইসির বাঁধের কাজের মধ্যে দিয়ে পাহাড়ী ঢলের পানি প্রবেশ করে ফসলহানীর ঘটনাটি ঘটে। এ বছর বেশীরভাগই ফসলহানী পিআইসির বাঁধ ভেঙ্গে ঘটেছে। তবে আমরা এও বলছি ঠিকাদারের দুএকটি বাঁধ ভেঙ্গেছে। জেলার এক একটি হাওরের এরিয়া ৫০ থেকে ১২০ কিলোমিটার হয়ে থাকে। পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রতিবছরই প্রতিটি হাওরে ৫ থেকে ১০ কিলোমিটার বাঁধের কাজ করে। হাওরের বাকী অংশ উন্মুক্ত থাকে। এবছর ফসলহানীর জন্য ওই উন্মুক্ত অংশ অনেকটাই দায়ী। পানি বাঁধের উন্মুক্ত অংশ দিয়ে ওভারফ্লু হয়ে ফসলহানী হয়েছে। বাঁধের কাজ শেষ করার পর অতিবৃষ্টিতে হাওরে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। এ জলাবদ্ধতার কারণে অনেক ধান নষ্ট হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডে যে কাজগুলি আমরা ঠিকাদাররা করেছি সেই বাঁধগুলির উচ্চতা ৬.৫ মিটার কিন্তু পানির উচ্চতা ছিলো ৮.১০ মিটার। ফলে ওভারফ্লু হয়ে প্রতিটি হাওরে পানি প্রবেশ করে। পানির উচ্চতা এত বেশী ছিল যে,এ বিপর্যয় ওঠকানো যায়নি। জেলায় ১৪২টি হাওর রয়েছে। এর মধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ড ৩৮টি হাওরে কাজ করে। কিন্তু আমাদের কাজের বাহিরের হাওরের ফসলডুবির জন্য পিআইসি ও আমাদের দায়ী করা হচ্ছে। এরজন্য আসলেই পানি উন্নয়ন বোর্ড ,ঠিকাদার ও পিআইসি দায়ী নয়।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিপর্যয়ের কারণে ফসলহানীর বিষয়টির দায় শুধুমাত্র ঠিকাদারদের উপর চাপানো হয় উল্লেখ করে বলা হয়,কোনো কোনো গণমাধ্যমে কাজ না করেই টাকা উত্তোলনের বিষয়টি এসেছে। কিন্তু এ বিষয়টি সাংবাদিকদের কাছে তুলে ধরা প্রয়োজন। ২০১৬ সালে হাওরে ৮৪টি গ্রুপে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান কাজ করে। কাজের মূল্য ছিলো ৩২ কোটি ৫ লাখ টাকা। কিন্তু আমাদেরকে বিল দেয়া হয়েছে ১৫ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। এ বছর ১ম টেন্ডারে ২৮টি গ্রুপের কাজের মূল্য ছিলো ৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা। বিল দেয়া হয়েছে ৩ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। এ বছর ২য় টেন্ডারে ৪৮টি গ্রুপে কাজের মূল্য ছিলো ৩৯ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। আমাদেরকে বিল দেয়া হয়েছে ৫ কোটি ৭২ লাখ টাকা। এতেই প্রতীয়মাণ হয় কাজ না করেই আমরা ঠিকাদাররা বিল নিয়ে গেছি বিষয়টি সঠিক নয়। ২০১৬ সালে আমরা ঠিকাদাররা কাজ সম্পন্ন করার পরও ৫০ ভাগ বিল দেয়া হয়। এবং অফিসের নির্দেশে এবছর আমরা আবারও ওই কাজগুলো সম্পন্ন করে ফেব্রুয়ারী মাসে ম্যাজারমেন্ট নেয়ার জন্য লিখিত কাগজ জমা দিলেও অফিস কোন ম্যাজারমেন্ট নেয়নি। ফলে আমরা বিল পাইনি। গুটিকতেক হাওরে কাজ করা হয়নি স্বীকার করে তারা বলেন,আমরা যারা কাজ করেছি তাদের বিল দেয়া হউক। সারা বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তণের কারনে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিপর্যয় ঘটেছে। এ বিপর্যয়ে বোরো ফসলহানীর প্রধান কারণ। হাওরের বোরো ফসল মাছসহ সবকিছু রক্ষার জন্য সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহন এখন সময়ের দাবী।
সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে ঠিকাদার ও বিএনপি নেতা আবুল মনসুর শওকত বলেন,আমরা কে কোন ফার্মের মূল ঠিকাদার ও ভাগীদার তা অবশ্যই সাংবাদিকদেরকে সরবরাহ করতে বাধ্য থাকবো। আমরা হাওরের বাঁধের কাজে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করেছি। ধার কর্জ ছাড়াও ব্যাংক থেকে ঋন এনে কাজের পারিশ্রমিক পরিশোধ করতে হয়েছে। তদন্ত করে প্রকৃত দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নেয়া হউক এটা আমাদেরও দাবী। পাউবো কর্মকর্তা কর্মচারীদেরকে আগাম ঘুষ দিয়েছেন কিনা? জানতে চাইলে আবুল মনসুর শওকত বলেন, দুর্নীতি সব জায়গাতে সকল প্রতিষ্ঠানে কমবেশী হচ্ছে। ইচ্ছে করলেই সব জায়গায় সকল কথা বলা যায়না। পিআইসি কাজ করেছে কিন্তু ঠিকাদাররা আদৌ কাজ করেনি বলে অভিযোগ রয়েছে এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন,পিআইসি আজকে আছে কালকে নাই। চেয়ারম্যান, মেম্বার ও মহিলা মেম্বারদের মধ্যে যারা নির্বাচিত হয় তারাই পিআইসিতে থাকে। এটা একটি সাময়িক প্রক্রিয়া কিন্তু ঠিকাদাররা সব সময় আছে এবং থাকবে। হাওরতো আমাদেরও গেছে আমরাও কৃষকের ছেলে। আমরা যারা কাজ করেছি তাদের বিল চাই এবং দিতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত প্রায় ৪০ জন সাংবাদিকদের মধ্যে ১০০০ টাকা, ৫০০ টাকা ও ৩০০ টাকা করে বিভিন্ন রেটে ঠিকাদারদের পক্ষ থেকে সম্মানী প্রদান করা হয় বলে সাংবাদিক আব্দুল শহীদ স্বীকার করেন।
উল্লেখ্য,জেলার মোট ৪২টি হাওরে সুনামগঞ্জ পাউবোর আওতাভূক্ত বাঁধের আয়তন হচ্ছে ১৫০০ কিলোমিটার। এর মধ্যে হাওর এলাকার আগাম বন্যা প্রতিরোধ ও নিষ্কাশন উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ৩৭টি হাওরে মোট ৪৯৪ কিলোমিটার বাঁধের কাজ করার জন্য ৪৬ কোটি টাকা বরাদ্ধ দেয়া হয়। বরাদ্ধকৃত এ অর্থের ৫০% টাকা ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে আগাম প্রদান করেছে পাউবো কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে টাংগুয়ার হাওর,খাই হাওর,মাটিয়াইন হাওর,ঘোড়াডুবা হাওর,ছায়ার হাওর,নাইন্দা হাওর,দেখার হাওরগুলোতে সর্বাধিক ৯টি করে কার্যাদেশ পায় ফরিদপুরের গোয়াল চামহ্রদ এলাকার মেসার্স খন্দকার শাহীন আহমেদ এবং ছায়ার হাওর,হালির হাওর,নাইন্দা হাওর,সাংহাইর হাওর,গুরমার হাওর,চন্দ্র সোনার তাল,ঘোড়াডুবা হাওরের কাজ ভাগিয়ে নেন সিলেটের বাগবাড়ী নিবাসী ঠিকাদার সজীব রঞ্জন দাস। শনির হাওর,মাটিয়াইন হাওর,ছায়ার হাওরের কাজে ৭টি পৃথক কার্যাদেশ পায় টাঙ্গাইলের আফজাল হোসেন মাহবুবের মেসার্স গুডম্যান এন্টারপ্রাইজ। ৩টি করে পৃথক পৃথক কার্যাদেশ সুনামগঞ্জের হাজীপাড়ার মেসার্স নূর ট্রেডিং, ২টি করে পৃথক কার্যাদেশ পায় মেসার্স ইব্রাহিম ট্রেডার্স, সিলেটের হাউজিং এস্টেট এর আব্দুল হান্নান ওরফে মুরগী হান্নানের মেসার্স হান্নান এন্টারপ্রাইজ, মৌলভীবাজারের মেসার্স আকবর আলী, সিলেটের ঠিকাদার জিল্লুর রহমানের মাহীন কন্সট্রাকশন, নুনা ট্রেডার্স, ষ্টেশন রোডের পার্থসারথী পূরকায়স্থর এলএন কন্সট্রাকশন,সুনামগঞ্জের বড়পাড়ার ঠিকাদার রেনূ মিয়া,ঠিকাদার কামাল হোসেন। ১টি করে হাওরের কাজ পায় মেসার্স ইউনুস এন্ড ব্রাদার্স,টেকবে ইন্টারন্যাশনাল,নিয়াজ ট্রেডার্স,ম্যাম কন্সট্রাকশন,সৈকত কন্সট্রাকশন ও ঠিকাদার শামসুর রহমান বাবুল এর নির্মাণ প্রতিষ্ঠান। উক্ত প্রতিষ্টানগুলোর কোন প্রোপাইটর সংবাদ সম্মেলনে অংশগ্রহন করেননি।
অনুসন্ধানে জানা যায়,এসব নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের প্রোপাইটরদের হাতে হাওর রক্ষা বাঁধের জন্য পর্যাপ্ত কোন লোকবল ছিলনা। ৫০% আগাম টাকা বিল হিসেবে উত্তোলন করে নিলেও যথাসময়ে বাঁধের কাজ তারা শুরু করেনি। তারা মনে করেছিল দায়সারাভাবে কোনরকমে কাজ করে নিলেই হলো। গতবার ফসল ডুবেছে বলে এবার আর ফসল ডুববেনা। এছাড়া নির্বাচিত হলেও কোন কোন ঠিকাদাররা নিজেরা কাজ নাকরে পার্সেন্টিজের বিনিময়ে ভাগীদারদের কাছে বাঁধের কাজ বিক্রি করে দিয়ে হাতপা গুটিয়ে বসে থাকে।
অস্থানীয় ফরিদপুরের গোয়াল চামহ্রদ এলাকার মেসার্স খন্দকার শাহীন আহমেদ এর নামীয় কাজ পরিচালনা করেন সুনামগঞ্জের নতুনপাড়া নিবাসী দীপ্ত তালুকদার টিটু। এই টিটু ঠিকাদার সজীব রঞ্জন দাসের শ্যালক ও তাহিরপুরের সাবেক চেয়ারম্যান দিনেশ রঞ্জন তালুকদারের পুত্র। তিনি ভগ্নিপতি ও মেসার্স খন্দকার শাহীন আহমেদ এর নামীয় কাজ করান বলে কৃষকরা জানান। সিলেটের দাড়িয়াপাড়া এলাকার চিন্ময় কান্তি দাসের নিম্মি এন্ড মুমু কন্সট্রাকশনের কাজ শহরের ষোলঘর আবাসিক এলাকার ঠিকাদার খালেদ হাসান,মেসার্স মাহিন কন্সট্রাকশন ও গুডম্যান এন্টারপ্রাইজের কাজ দিরাইয়ের জগদল ইউনিয়নের কামরিবীচ গ্রামের ঠিকাদার জিল্লুর রহমান, কুমিল্লার আব্দুল মান্নানের ম্যাম কন্সট্রাকশনের কাজ শহরের নতুনপাড়ার সেন্টু তালুকদার, মৌলভীবাজারের মেসার্স আকবর আলীর নামীয় কাজ পুরাতন বাসস্ট্যান্ড এর হানিফ,সিলেটের কামাল হোসেনের নামীয় প্রতিষ্ঠানের কাজ পরিচালনা করেন কুরবাননগর ইউনিয়ন পরিষদের সচিব জিতেন চৌহান শাপলু,শহরের ময়নার পয়েন্টের ঠিকাদার বশির আহমদ,হাছননগর নিবাসী তারেক আহমদ পরিচালনা করেন বলে পাউবোর কর্মকর্তা ও স্থানীয় কৃষকরা জানান। বৃহস্পতিবারের সংবাদ সম্মেলনে উক্ত ভাগীদারদেরকেও দেখা যায়নি। টেন্ডারে প্রাপ্ত কোন হাওরেই কেন বাঁধের কাজ করেননি জানতে চাইলে কোন কোন ভাগীদাররা বলেন,আমরা সব হাওরেই কাজ করেছি। কৃষকরা স্বচক্ষে আমাদের কাজ দেখেছেন। শুধু দেখেন নাই জেলা প্রশাসক শেখ রফিকুল ইসলাম,জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নুরুল হুদা মুকুটসহ জেলার এমপিরা। তারা আসলে দেখেও না দেখার ভান করছেন। সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড পাউবোর সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী মো: আফছার উদ্দিন বলেন,আমরা মোট ৭৬টি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে মাত্র ২৫% টাকা বিল হিসেবে প্রদান করেছি। বাঁধের কাজে অনিয়ম করায় প্রায় ৩০টির মতো ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে শোকজ করেছি। জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক শেখ রফিকুল ইসলাম বলেন,পাউবোর বাঁধের কাজে অংশ নেয়া ঠিকাদার ও তাদের ভাগীদারদের নাম তালিকা আমরা সংগ্রহ করে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনগত ব্যাবস্থা নেবো।