প্রস্তাবিত নাগরিকত্ব আইনে প্রবাসীদের অধিকার নিশ্চিত করার দাবী
নিউইয়র্ক : বাংলাদেশের প্রস্তাবিত নাগরিকত্ব আইন পুন:বিবেচনা করে প্রবাসীদের সকল সাংবিধানিক ও নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করার দাবী জানিয়ে বক্তারা বলেছেন, এ আইন পাস হলে দেশে জন্মগ্রহণকারী বাংলাদেশী প্রবাসীরা দেশের দ্বিতীয় শ্রেনীর নাগরিকে পরিণত হবেন এবং জন্মগত নাগরিক অধিকার হারাবেন। প্রবাসে বসবাসকারী বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত নতুন প্রজন্ম বংশগত অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন। ফলে প্রবাসীদের মধ্যে প্রিয় মাতৃভূমি সম্পর্কে বিরূপ ধারণার সৃষ্টি হবে। সার্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ’। বক্তারা খসড়া আইনটি পুন:বিবেচনা করে প্রবাসীদের স্বার্থ ও অধিকার নিশ্চিত করার দাবী জানান।
নিউইয়র্ক বাংলাদেশ প্রেসক্লাব আয়োজিত ‘বাংলাদেশের প্রস্তাবিত নাগরিকত্ব আইন ও প্রবাসীদের অধিকার’ শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন। গত ২৪ এপ্রিল সোমবার সন্ধ্যায় নিউইয়র্কের বাংলাদেশী অধ্যুষিত জ্যাকসন হাইটসের বেলোজিনো মিলনায়তনে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন প্রেসক্লাবের আহ্বায়ক ও সাপ্তাহিক বাংলাদেশ সম্পাদক ডা. ওয়াজেদ এ খান। তিনি তার প্রারম্ভিক বক্তব্যে মূল বিষয়ের উপর আলোকপাত করেন।
অনুষ্ঠানে মূল আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী ও হিউম্যান রাইটস এন্ড পীস ফর বাংলাদেশ এর সভাপতি অ্যাডভোকেট মনজিল মোর্শেদ। অন্যান্যের মধ্যে আলোচনা করেন প্রেসক্লাবের উপদেষ্টা ও সাপ্তাহিক আজকাল সম্পাদক মনজুর আহমদ, উপদেষ্টা আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু ও মঈনুদ্দীন নাসের, ক্লাবের সাবেক সভাপতি, সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা’র সম্পাদক ও টাইম টিভির সিউও আবু তাহের এবং সাবেক সভাপতি ও সাপ্তাহিক বর্ণমালা সম্পাদক মাহফুজুর রহমান, এটর্নী মঈন চৌধুরী, অ্যাডভোকেট এন মজুমদার ও খান’স টিউটোরিয়াল-এর চেয়ারপার্সন নাঈমা খান।
প্রেসক্লাবের সদস্য সচিব শিবলী চৌধুরী কায়েসের উপস্থাপনায় অনুষ্ঠানের শুরুতে পবিত্র কোরআন থেকে তেলাওয়াত করেন প্রেসক্লাবের সদস্য রশীদ আহমেদ। বৈঠকের মূল বিষয়বস্তুর আলোকে আলোচনায় অংশ নিয়ে বিভিন্ন প্রস্তাবনা রাখেন আমেরিকা-বাংলাদেশ প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও সাপ্তাহিক পরিচয় সম্পাদক নাজমুল আহসান, বিশিষ্ট সাংবাদিক মোহাম্মদ জয়নাল আবেদীন, সাপ্তাহিক জন্মভূমি সম্পাদক রতন তালুকদার, আইঅন বাংলাদেশ টিভি’র পরিচালক রিমন ইসলাম, সাপ্তাহিক প্রবাস সম্পাদক মোহাম্মদ সাঈদ, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মনোয়ারুল ইসলাম, সাংবাদিক ইমরান আনসারী, বৃহত্তর নোয়াখালী সমিতির সভাপতি আব্দুর রব মিয়া, কমিউনিটি অ্যাক্টিভিস্ট আলী ইমাম শিকদার, কাজী আজহারুল হক মিলন, মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার ফরহাদ, অ্যাডভোকেট মজিবুর রহমান, বাংলাদেশ সোসাইটির সহ-সভাপতি আব্দুর রহীম হাওলাদার, ট্রাষ্টিবোর্ড সদস্য অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন, নর্থ বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হাসানুজ্জামান হাসান, কমিউনিটি অ্যাক্টিভিস্ট কাজী নয়ন, জসীমউদ্দিন ভূঁইয়া, সাংবাদিক সাখাওয়াত হোসেন সেলিম ও মঞ্জুরুল ইসলাম।
তারা বলেন, প্রবাসী বাংলাদেশীরা শিক্ষা, অর্থনীতি, উন্নয়নের লক্ষ্যে বিদেশে পাড়ি জমালেও তাদের মন পড়ে থাকে স্বদেশে। শিকড়ের টানে দেশে ফিরে বিনিয়োগ করতে চান, প্রবাসের অর্জিত অভিজ্ঞতা দেশকে ফিরিয়ে দিতে চান, বসবাস ও নিয়মিত যাতায়াত করতে চান। খসড়া আইনে আরোপিত নাগরিকত্বের সীমাবদ্ধতার কারণে প্রবাসী ও তাঁদের সন্তান-সন্ততিদের বাংলাদেশবিমুখ হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে বাংলাদেশে প্রবাসীদের বিনিয়োগ, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং মেধা আমদানির সম্ভাবনা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর এর এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পরে।
তারা আরো বলেন, বিশ্বজুড়ে ইমিগ্রেশন ইস্যু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। পৃথিবীর এক প্রান্তের মানুষ অন্য প্রান্তের দেশে গিয়ে অভিবাসী হচ্ছে এবং এক সময়ে ইমিগ্রান্টরা সেসব দেশের নাগরিকত্ব লাভ করছে। সেজন্য যুক্তরাষ্ট্রসহ আরো অনেক দেশের নাগরিকত্ব আইনে ন্যাচারালাইজেন পদ্ধতিতে নাগরিকত্ব লাভের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। উন্নত দেশগুলোতে ইমিগ্রেশন বড় একটি ইস্যু হলেও বাংলাদেশে এটি তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ স্থায়ী হওয়া বা নাগরিকত্ব লাভের জন্য বাংলাদেশে বিদেশি ইমিগ্রান্ট প্রবাহ প্রায় শূণ্যের কোটায়। বরং এর উল্টোটাই প্রাধান্য পেয়েছে। বাংলাদেশ থেকে প্রতিনিয়ত মানুষ যাচ্ছে বিদেশে, বিশেষ করে উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ, অষ্ট্রেলিয়া ইত্যাদি দেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের উদ্দেশ্যে। অস্থায়ীভাবে চাকরি নিয়ে প্রবাসী হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে। তাই প্রবাসী বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে যেখানে এ সত্য প্রতিষ্ঠিত যে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভিত্তির অন্যতম প্রধান দিক হল প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। বর্তমানে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশের বাইরে বসবাস করছে। এ সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। চাকরি সূত্রে হোক অথবা স্থায়ীভাবেই বসবাস করুক, এই ১ কোটি ৩০ লাখ বাংলাদেশীর সবাই প্রবাসী। দেশের ১৬ কোটি মানুষের প্রায় দেড় কোটি প্রবাসী। সংখ্যার হিসাবেও বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বক্তারা বলেন, প্রস্তাবিত নাগরিকত্ব আইনের খসড়া প্রকাশের পর প্রবাসীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। এ আইন যেভাবে খসড়া করা হয়েছে তা পাস হলে প্রবাসীদের স্বার্থ বিপন্ন হবে। সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রনোদিত হয়ে পাস করতে চেষ্টা করছে। তারা সময় থাকতে আইনটির খসড়া বিশ্লেষণ করে দেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি প্রবাসীদের স্বার্থ যাতে ক্ষুন্ন না হয় সেদিকগুলো বিবেচনা ও আইনে সংযোজন করার জোর দাবী জানান। বৈঠকে বাংলাদেশের প্রস্তাবিত নাগরিকত্ব আইন সম্পর্কে প্রবাসীদের সচেতন করার লক্ষ্যে ওয়েবসাইট তৈরীর মাধ্যমে প্রস্তাবটির ভালো-মন্দ তুলে ধরা এবং একটি কমিটি গঠন করে প্রস্তাবটি নিয়ে কাজ করার জন্য প্রস্তাব করা হয়। তারা প্রবাসীদের বাংলাদেশে সম্পত্তির পূর্ণাঙ্গ সমমর্যাদায় মালিকানা নিশ্চিত করা, তাদের সন্তানদের সম নাগরিক অধিকার, স্বদেশে তাদের জানমাল, সম্পত্তি ও বিনিয়োগের নিরাপত্তা, জাতীয় পরিচয়পত্র ও ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগসহ সব ধরণের সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করারও দাবী জানান।