ফেসবুক ইনবক্স- এক দুরারোগ্য ব্যাধির নাম
জেসমিন চৌধুরী।।
প্রশ্নঃ ‘কেমন আছেন আপু?’
উত্তরঃ ‘টাকা পয়সার কষ্টে আছি। কিছু ধার কর্জ দিবেন?’
‘মাসিক ঋতুশ্রাব চলছে, প্রচন্ড ব্যথায় কাতর আছি।‘
প্রশ্নঃ কী করছেন আপু?
উত্তরঃ ‘এই মুহুর্তে টয়লেটে আছি। কাল রাতে খাওয়াটা একটু বেশি হয়ে গেছে’।
‘আপনার দুলাভাই আজ খুব রোমান্টিক মুডে আছেন, তার সাথে ভাব-ভালবাসা করছি’।
কী, খুব অশালীন মনে হচ্ছে এই কথোপকথনকে? হবারই কথা। জীবনের এইসব অভিযোগ, প্রতিদিনের ব্যক্তিগত ভাল থাকা/ না থাকা পত্রিকার পাতায় ছাপানো যতটা অশালীন,ফেসবুকের ইনবক্সে অপরিচিত মানুষদের কাছ থেকে ‘কেমন আছেন? কী করছেন’ প্রশ্নও আমার কাছে ঠিক ততটুকুই অশালীন। এই দু’টোই অত্যন্ত ব্যক্তিগত প্রশ্ন এবং শুধুমাত্র তেমন মানুষরাই এসব প্রশ্ন করার অধিকার রাখেন যাদের সাথে মানসিক আদান প্রদানের একটা ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। সেই ক্ষেত্রটা ফেসবুকেও তৈরি হওয়া সম্ভব, কিন্তু তার চাষাবাদ হোমপেজে লেখালেখি এবং স্ট্যাটাসে লেনদেনের মাধ্যমেই শুরু এবং বিকশিত হতে হবে, ইনবক্সে গুতাগুতির মাধ্যমে নয়।
ইনবক্স নামক দুরারোগ্য ব্যাধি নিয়ে গত কিছুদিনে অনেক পোস্ট দিয়েছি। এই লেখার মাধ্যমে নতুন করে কারো বিরক্তির উদ্রেক করলে ক্ষমা চাই। নতুন নতুন উপদ্রব দেখা দিচ্ছে ইনবক্সে, যা আলোচনা না করলেই নয়। আমার মতো আরো যারা এই ব্যাধির দ্বারা আক্রান্ত মানুষদের অশোভন আচরণের শিকার, তাদের সবার পক্ষ থেকে আজকের সকালের অনেকগুলো জরুরি কাজ ফেলে আবারও এই বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করতে বসেছি।
আমি ফেসবুকের একজন বনেদি ইউজার, সেই শুরুর দিক থেকেই আছি। ফেসবুক নিয়ে অনেকের মধ্যে নানান নেতিবাচক অনুভূতি ও অভিমত রয়েছে। আমি সবসময় এর প্রতিবাদ করে এসেছি,তথ্যপ্রযুক্তিকে নিজের কাজের ক্ষেত্রে ব্যবহার করার সুফলে বিশ্বাস করে এসেছি। পৃথিবীকে আরো ছোট এবং গোল করে আনতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের, বিশেষ করে ফেসবুকের, বিপ্লবী ভূমিকার প্রতিটি ধাপের সাক্ষী যারা আমি তাদের মধ্যে একজন। এসব যোগাযোগ মাধ্যমে প্রাইভেসির অভাব নিয়ে যারা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগেন, তাদেরকে আমি প্রায়ই বলি, ‘ফেসবুকের পৃথিবী এতোটা খারাপ নয়। বাস্তব জীবনে আপনি কিছু মানুষের জন্য নিজের ঘরের দরজা খোলেন, কিছু মানুষকে দরজার ভেতরে ঢুকতে দেন, কিছু মানুষ আপনার ড্রইংরুমে বসে আপনার সাথে গল্প করার অধিকার পায়, আবার খুব আপন কিছু মানুষ আপনার শোবার ঘরেও বিনা বাধায় প্রবেশ করতে পারে। ফেসবুকেও ঠিক তেমনি আপনি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন কাকে কতটুকু ভেতরে ঢোকাবেন। কাজেই এতো ভয় পাবার কিছু নেই’।
কিন্তু কিছুদিন যাবত আমার নিজের এই কথাগুলোই নিজের কাছে তেমন বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হচ্ছে না। ফেসবুক কর্তৃপক্ষ যেদিন থেকে মেসেঞ্জারকে একটি ডিফল্ট এপ হিসেবে যুক্ত করেছে সেদিন থেকেই শুরু হয়েছে এই দুর্ভোগ। এখন মোবাইলে ফেসবুক থাকলে মেসেঞ্জার খোলা রাখতেই হয়। আমার মত ব্যস্ত মানুষেরা, যারা সারাদিনের কাজের ফাঁকে মোবাইল থেকে ফেসবুক ব্যবহার করেন, বেশ বেকায়দায় পড়ে গেছেন। ফেসবুক নামক জগতের দরজার ভেতরে ঢোকা মাত্রই বেডরুমের দরজায় নক করতে শুরু করে দিয়েছেন একশ্রেণীর অকর্মন্য সময়ক্ষেপণকারী লোকজন যাদের উপদ্রবে অনেকের জীবন অতীষ্ঠ হয়ে উঠেছে।
আমার এই আপত্তির প্রতিবাদ করে অনেকে বলেন, ‘মানুষ আপনাকে ভালবাসে তাই কুশল জানতে চায়। বিরক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে তাদেরকে অপমান করা ঠিক নয়।’ এইসব সস্তা ভালবাসার ততোধিক সস্তা আদান-প্রদানের বিষম দায় থেকে মুক্তি চাই আমি এবং আরো অনেকে যাদের জীবনে সত্যিকারের ভালবাসার অভাব নেই। জীবন আছে, প্রকৃতি আছে, সংসার আছে, পরিবার আছে, কাজকর্ম আছে। আর তাও যদি না থাকে, নিছক ভাবনা আছে। এইসব নিয়ে খোলাখুলিভাবে হোমপেজে লেনদেনের মাধ্যমে এমন বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে পারে, যা একসময় ইনবক্সেও স্বস্তিদায়ক হয়ে উঠবে। শতশত হাজার হাজার মানুষের মিলনমেলা এই ফেসবুক, এতো আমাদের ড্রয়িং রুম নয় যে সবকাজ ফেলে বসে গল্প করা যাবে? তারচেয়ে বড় কথা হলো যারা এসব প্রশ্ন করেন তারা কি আসলে জানতে চান আমি কেমন আছি, না’কি কথা বলে সময় ক্ষেপণ করার ভূমিকা হিসেবে এই প্রশ্ন করেন? ‘আমি কী করছি’, তা আমার স্বামীও আমার কাছে জানতে চান না, কারণ তিনি আমার ব্যক্তিগত জীবনকে শ্রদ্ধা করেন। দয়া করে আপনিও জানতে না চাইলে কৃতজ্ঞ থাকব।
ইদানিং সুশীলরাও ইনবক্সে আরেক সুশীল মাত্রার উপদ্রব শুরু করেছেন। নিজেদের কর্মজীবন এবং লেখালেখি বিষয়ক পোস্টে আগে অযাচিত ভাবে ট্যাগ করে জ্বালাতেন যারা, তারা এখন ইনবক্সে লিংক পাঠাতেও শুরু করেছেন। শুধু তাই নয়, প্রতিক্রিয়া না জানালে জবাবদিহিতা আশা করছেন- ‘আপনাকে আমার লেখার লিংক পাঠালাম, কিছু তো জানালেন না?’ অদ্ভুত কান্ড! লিখেছেন ভাল কথা, হোমপেজে শেয়ার করুন। চোখে পড়লে পড়ে দেখব, ভাল বা খারাপ লাগলে প্রতিক্রিয়া জানাব।
নিজের কাজকর্ম/লেখালেখি নিয়ে এভাবে অন্যের ঘাড়ে ঝাপিয়ে পড়া কোন দেশি সুশীল আচরণ? নিজের পোস্টে কাউকে ট্যাগ করা, বা ইনবক্সে পোস্টের লিংক পাঠানো অন্যায় নয়, যদি তার সাথে আপনার তেমন সম্পর্ক সৃষ্টি হয়ে থাকে। একজন মানুষের পাশে দুই মিনিট দাঁড়ানোর আগেই যদি তার উপর নিজের পুরো দেহটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন, তাহলে সে যে আপনাকে দ্রুত দূরে ছুঁড়ে দেবে, এটুকু বুঝতে কতটুকু বুদ্ধির প্রয়োজন? যারা ফেসবুকে একাউণ্ট খোলার বুদ্ধি রাখেন, লেখালেখি করেন তাদের কাছ থেকে এতোটুকু বুদ্ধিমত্তা তো আমরা আশা করতে পারি, তাই না?
আমাকে যতটা ইনবক্স-বিরোধী মনে হয়, ততটা আমি নই। আমার অনেক সহযোদ্ধাদের ডাকে অনেক ব্যস্ততার মধ্যেও আমি সাড়া দেই, কথা বলি। সাহস যোগাই, সাহস অর্জন করি। গতকাল বাংলাদেশ থেকে এক বোন জানিয়েছেন তার চাকরি হয়েছে। তার কঠিন সময়টাতে ইনবক্সে সাহস যোগানোর জন্য ধন্যবাদ দিয়েছেন, আমাকে একটা শাড়ি উপহার দিতে চান জানিয়েছেন। চোখে পানি এসেছে, শাড়ি পাবার আনন্দে নয়, একজন মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারার খুশিতে।
আমি এবং আমার মত আরো অনেকে ফেসবুকে জরুরী কাজে নিয়োজিত আছেন। দয়া করে তাদেরকে কাজ করতে দিন, এই সামান্য অনুরোধ জানাই ইনবক্স ব্যাধিগ্রস্থদের। সেইসাথে তাদের দ্রুত আরোগ্যও কামনা করি। সকল ফেসবুক-বিচরণকারী সুখী হোক।
লেখক: অভিবাসী, শিক্ষক, ও অনুবাদক