বহুমুখী প্রতিভার মূর্তপ্রতীক আব্দুল হাই-হোসেন তওফিক চৌধুরী
হোসেন তওফিক চৌধুরী :: সুগন্ধিযুক্ত একটি ফুলের নাম গোলাপ। গোলাপের সৌরভে চারিদিক মোহিত হয়। গোলাপ ফুল এজন্য সকলের আদরনীয়। এই সৌরভযুক্ত ফুলের সাথে সঙ্গতি রেখেই ছেলের নাম রাখা হল ‘গোলাপ’। বাপ-মায়ের প্রত্যাশা ছিল ছেলের সৌরভ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়বে এবং ছেলেটি জীবনে পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে। সুনামগঞ্জের এক প্রখ্যাত সাংবাদিক রাজনৈতিক নেতা, নাট্যকার, অভিনেতা, মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও ভাষা সৈনিক আব্দুল হাই-এর কথা আমি বলছি। আব্দুল হাই-এর পারিবারিক নাম ছিল ‘গোলাপ’। এ নামেই তিনি সমধিক পরিচিত ছিলেন। তিনি একজন নিবেদিত শিক্ষাবিদ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি এক অনন্য মেধাবি ও প্রতিভাশালী ছিলেন। তিনি কোন একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাননি। সকল দিকেই ব্যাপৃত হয়েছেন। তার যে কার্যক্ষমতা ও প্রতিভা ছিল যদি তিনি একটি লক্ষ নিয়ে এগিয়ে যেতেন তাহলে অবশ্যই তিনি এর শীর্ষে পৌঁছতে পারতেন। তিনি একজন সাহিত্য সংগঠক ও সাহিত্যিক ছিলেন।
আব্দুল হাই প্রাথমিক পর্যায়েই তার মেধার স্ফুরণ ঘটে। তিনি ১৯৪০ সালে সুনামগঞ্জ শহরের আরপিন নগরের কেবি মিয়া মক্তব থেকে বৃত্তি পরীক্ষা দেন। তখন আমরা আসাম বিভাগের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম। সমগ্র আসামে তিনি ১ম স্থান অধিকার করেন। ১৯৪৮ সালে তিনি সুনামগঞ্জ সরকারি জুবিলী হাইস্কুল থেকে ১ম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। পরে সুনামগঞ্জ কলেজ থেকে আইএ পাস করে সিলেটের এমসি কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে তাকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হলে তিনি সিলেট মদন মোহন কলেজ থেকে বিএ পরীক্ষার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। এই সময়ে দেশে ১৯২ (ক) ধারা জারি হলে তাকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৫৫ সালে তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বিএ পরীক্ষা দেন। ডিস্ট্রিংশনসহ তিনি বিএ ডিগ্রি লাভ করেন।
মহান ভাষা আন্দোলনে আব্দুল হাই-এর ভূমিকা প্রবাদতুল্য এবং অতুলনীয়। সম্মুখ সারিতে থেকে ভাষা আন্দোলনে ছাত্র নেতৃত্ব দিয়েছেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন কিন্তু তার আর আইন পড়া হয়নি। ১৯৫৪ সালে তিনি যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে স্মরণীয় ভূমিকা পালন করেন।
তিনি ১৯২৯ সালে সুনামগঞ্জ শহরের আরপিননগরের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আব্দুল ছামাদ। মাতার নাম মোর্শেদা বেগম চৌধুরী। তার নানা তাহিরপুরের বিন্নাকুলী গ্রামের আছিম চৌধুরী। মোর্শেদা বেগমের এক ভাই ছিল। নাম শামছু মিয়া চৌধুরী। আছিম চৌধুরী ও তার পুত্র শামছু মিয়া প্রায় একই সাথে মারা গেলে তিনি একবারে অনাথ হয়ে যান। তখন আমার দাদা আবুল হোসেন চৌধুরী মোর্শেদা বেগমের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। আছিম চৌধুরী ছিল আমার দাদার ভাতিজা। মোর্শেদা বেগমের বিয়ে হয় আরপিননগরের তালুকদার বাড়ির আব্দুস ছামাদের সাথে। তাদের সুখি সুন্দর দাম্পত্য জীবনে ৩ ছেলে ও ৩ মেয়ের জন্ম হয়।
আব্দুল হাই’র মা মোর্শেদা বেগম অত্যন্ত মায়াপীর মানুষ ছিলেন। সারাটা তালুকদার বাড়ি তিনি অল্প সময়ে নিজ গুণে বশ করে নিয়েছিলেন। সবাই তাকে ভালবাসতো এবং তিনিও সবাইকে সম্মান ও স্নেহ করতেন। তিনি আমার বাবা মকবুল হোসেন চৌধুরীকে বাবা এবং আমার মাকে মাই বলে ডাকতেন। আমরা তাকে ‘বুবাই’ ডাকতাম। তিনি আমাদেরকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। তার মৃত্যুর পর দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেছে কিন্তু তার আদর স্নেহের কথা আমরা ভুলিনি। তিনি বছরে ২/৩ বার আমাদের বাসায় এসে নাইওরি করতেন। আমি তার মাগফেরাত কামনা করে তাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দানের জন্য দোয়া করি।
আব্দুল হাই সুনামগঞ্জের কামারগাঁয়ে বিয়ে করেন। সুনামগঞ্জ বারের আইনজীবী সাহারুল ইসলাম এবং তার প্রবাসী ভাই বাহারুল ইসলাম তার শ্যালক। আব্দুল হাইয়ের ছোটভাই আব্দুল ওয়াহেদ লাট মিয়া কলেজে পড়ার সময়েই অকালে মৃত্যুবরণ করেন। লাট মিয়া অত্যন্ত তেজস্বী ছিল। সেও ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ও অগ্রণী ছিলো। তার বড়ভাই আব্দুল আহাদ চৌধুরী তারা মিয়ার ছেলে ও মেয়েরা বর্তমানে লন্ডন-আমেরিকায় বসবাস করছে। তারা সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। আব্দুল হাই-এর ভাগ্নেদের মধ্যে অ্যাডভোকেট শামছুজ্জামান সুফী, কামরুজ্জামান সাফি ও ইমানুজ্জামান মহী প্রমুখের সাংবাদিকতায় অবদান রয়েছে। সিলেটের প্রখ্যাত সাংবাদিক আল-আজাদ আব্দুল হাইয়ের জামাতা।
আব্দুল হাই শিক্ষাবিদ হিসাবে যথেষ্ট অবদান রেখেছেন। তিনি জয়কলস রাসিদিয়া হাই স্কুল ও সুনামগঞ্জ শহরের হাজী মকবুল পুরকায়স্থ (এইচএমপি) হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তিনি তার দক্ষতা ও কর্মনৈপুণ্যে উভয় স্কুলের শক্ত ভিত রচনা করেছেন। সুনামগঞ্জ কলেজে একবার বাংলা ভাষার অধ্যাপক না থাকায় আব্দুল হাইকে বাংলা পড়াবার জন্য খণ্ডকালীন অধ্যাপক নিয়োগ করা হয়। তিনি এ ক্ষেত্রেও তার প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি সাংবাদিকতায় অপরিসীম অবদান রেখেছেন। তিনি সুনামগঞ্জ থেকে ‘দেশের দাবি’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। ‘সুরমা’ পত্রিকাও তিনি সম্পাদনা করেন। আমার ভাই হাসান শাহরিয়ার সুরমা পত্রিকায় তার সাথে ছোটদের পৃষ্ঠার সাথী ভাই ছিলো। তিনি সিলেট থেকে প্রকাশিত ‘নওবেলাল’ পত্রিকার সম্পাদনা পরিষদেও কাজ করেছেন। ১৯৭১ সালের পর সুনামগঞ্জ থেকে অর্ধসাপ্তাহিক ‘দেশের কথা’ এবং ‘সূর্যের দেশ’ পত্রিকা সম্পাদনা করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে জনমত গঠনের উদ্দেশ্যে তিনি ‘জনমত’ নামে একটি বুলেটিন প্রকাশ করতেন।
আব্দুল হাই একজন উচ্চ মাপের সাহিত্য সংগঠক ছিলেন। তার নেতৃত্বেই ১৯৬৪ সালে সুনামগঞ্জে সপ্তাহব্যাপী কৃষ্টি ও সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে দেশের প্রথিতযশা কবি-সাহিত্যিক ও শিল্পীরা যোগদান করেন। তিনি সুনামগঞ্জ আর্টস কাউন্সিলের প্রাণপুরুষ ছিলেন। তারই হাতে গড়া আর্টস কাউন্সিল সম্প্রতি সুনামগঞ্জ শিল্পকলা একাডেমি আর্টস কাউন্সিলের পুরাতন ভবনকে ‘আব্দুল হাই মিলনায়তন’ নামে নামকরণ করে একটি অভিনন্দনযোগ্য কার্য্য সম্পাদন করেছেন। আব্দুল হাই-এর স্মৃতি রক্ষার্থেই এই নামকরণ করা হয়েছে।
আব্দুল হাই আমাদের ভাগ্নে। তাকে আমরা মামা ডাকতাম। তার সাথে আমার অনেক স্মৃতি রয়েছে। ১৯৫৬ সালে সুনামগঞ্জে লঙ্গরখানা পরিচালনা করার সময়ে আমি তার সাথে স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে কাজ করেছি। সাহিত্য সম্মেলনে তার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলাম। আব্দুল হাই নিজেও একজন লেখক ছিলেন। তিনি হাছন রাজা ভক্ত ও প্রেমিক ছিলেন। তিনি নিজেই ‘হাছন পছন্দ’ নাম গ্রহণ করেন। তিনি ‘উতলা বাতাসে’ হাছন রাজার গান কি ছিলো, কি হয়েছে, কি হওয়া উচিত; ‘গান সংগীত’, ‘ভাইবে রাধারমণ বলে’ প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করে সুনাম অর্জন করেছেন।
আব্দুল হাই ছিলেন এক অনন্য বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। যখন যে কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন সেখানেই সাফল্যমণ্ডিত হয়েছেন। সর্বত্রই তার কর্মদক্ষতার স্বাক্ষর প্রতিভাত। দুঃখের বিষয় এহেন আব্দুল হাই প্রতিভার যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি। একটি অতৃপ্তি ও হতাশা নিয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। ১৯৮৩ সালের ২৫ শে এপ্রিল তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুতে সুনামগঞ্জের এক অনন্য প্রতিভা না ফেরার দেশে চলে গেল এবং সুনামগঞ্জের অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হলো। আব্দুল হাই কখনও বিত্ত-বৈভবের দিকে ধাবিত হন নাই। সরল-সহজভাবেই দুঃখ-কষ্টে সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করেছেন। কোন কালিমা তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। তিনি মানুষের জন্য কাজ করেছেন। এ জন্য মানুষ তাকে ভালোবাসতো, শ্রদ্ধা করতো। তার কর্মই তাকে মানুষের অন্তরে বাঁচিয়ে রাখবে। তিনি মানুষের অন্তরলোকে বেঁচে থাকবেন। তিনি শোক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় অনাগতকালেও নন্দিত হবেন। স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। আমি তার রুহের মাগফেরাত কামনা করে তাকে নাজাত নসিব করার জন্য দোয়া করি।
[লেখক হোসেন তওফিক চৌধুরী, সিনিয়র আইনজীবী ও কলামিস্ট]