বাংলাদেশে সৌদি সংস্কৃতির অনুকরনে ইসলাম পালন ও বোরকা বিপ্লব
হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ মনে করেন, মুসলিম প্রধান দেশে বোরকার এই বিপ্লব খুবই স্বাভাবিক। নিজের মেয়ে-সন্তানের নিরাপত্তার বিষয়ে বোরকাকে শক্ত হাতিয়ার ভাবেন অনেক অভিভাবক। আসলেই কি বোরকার কারণে নিরাপদ থাকতে পারছেন নারীরা? আশা ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের শিক্ষার্থী আফসানা ইমি বলেন, বাস থেকে নামার সময় অভিনয় করে হেলপাররা প্রায়শই মেয়েদের শরীরে হাত দিয়ে থাকে। অভিনয় বলছি, এই কারণে- ওরা বয়স্ক মহিলার শরীরে প্রয়োজন ছাড়া হাত দেয় না। আবার অকারণে যুবতীদের শরীরে হাত দিয়ে থাকে। লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্সের অধ্যাপক নায়লা কবিরের মতে বাংলাদেশে এখন সৌদি আরবের সংস্কৃতিতে ইসলাম ধর্ম পালন করা হচ্ছে। মহিলার গায়ে বোরকা, মাথায় হিজাব, হাতে-পায়ে মোজা, চোখে সানগ্লাস- এটা সৌদি আরবের সংস্কৃতি। নিজস্ব সংস্কৃতির ওপর ভর করেই বাংলাদেশে ইসলাম ধর্ম এসেছিল। কিন্তু সেই ইসলাম এখন আর নেই।
পহেলা ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী হিজাব দিবসও পালিত হচ্ছে। নিউ ইয়র্কে বসবাসরত বাংলাদেশি নারী নাজমা খানের উদ্যোগে এ দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রথম তিনি এ দিবস পালনের আহ্বান জানান। বাংলাদেশসহ ১৯০টি দেশে গত বছর এ দিবসটি পালিত হয়। বোরকা, নেকাব কিংবা হিজাব সংক্রান্ত পরিবর্তনের একটি বৈশ্বিক মাত্রাও রয়েছে। গত সেপ্টেম্বরে জার্মান সংসদে নেকাব পরে গাড়ি চালনা এবং পুরো মুখঢাকা সিভিল সার্ভেন্টদের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়। সেখানকার একটি ধর্মীয় সংগঠন একে বোরকা ও হিজাবের ওপর রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছে। ২০১১ সালে ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে প্রথম ফ্রান্স মুখঢাকা নিষিদ্ধ করে। এরপর বেলজিয়াম, বুলগেরিয়া, সুইজারল্যান্ড তা অনুসরণ করে। নেদারল্যান্ডস সরকারি অফিস-আদালতে বোরকা নিষিদ্ধ করেছে। ডাচ্ সংসদে ১৫০ সদস্যের মধ্যে ১৩২ জন বোরকাবিরোধী বিলের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। ডাচ্ প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সরকারি কাজকর্ম করতে গিয়ে এমন অনেক সময় আসে যখন মুখোমুখি তাকিয়ে কথা বলতে হয়, তখন সেটা ভিন্ন কিন্তু যখন তারা কর্মক্ষেত্রের বাইরে বা কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দেবে, তখন তারা তাদের দরকার পড়লে অবশ্যই পুরো মুখাবয়ব ঢেকে নেবেন।
ডেনমার্কে দেখা গেছে, বোরকা ও নেকাব বন্ধ করা নিয়ে বিরোধী দল সরকারি দলের পাশে দাঁড়িয়েছে। গত জুলাইয়ে ইউরোপীয় মানবাধিকার সংক্রান্ত শীর্ষ আদালত বোরকা নিষিদ্ধের পক্ষে ভোট দিয়েছে। দুজন মুসলিম নারী আদালতে আর্জি পেশ করেছিলেন যে, বেলজিয়াম সরকার প্রকাশ্যে পুরোপুরি মুখ ঢেকে চলাচলের স্বাধীনতা খর্ব করেছে। এটা ধর্মীয় স্বাধীনতায় আঘাত। কিন্তু আদালতে তাদের আর্জি খারিজ হয়েছে। অনেকের মতে কাকতালীয়ভাবে হোক বা না হোক, পশ্চিমা বিশ্বের দেশে দেশে যতই বোরকা ও হিজাববিরোধী খবরাখবর মিডিয়া ও সামাজিক মিডিয়ায় ঝড় তৈরি করেছে, ততই বাংলাদেশে বোরকা ও হিজাবের ব্যবহার বেড়েছে। মনে হয়, অনেক বিশেষজ্ঞ এর মধ্যে কোনো যোগসূত্র থাকার সম্ভাবনা একেবারে নাকচ করে দিচ্ছেন না। ইউরোপীয় দেশগুলোতে দেখা যাচ্ছে, একটি পোশাক হিসেবে বোরকা নিয়ে তাদের কোনো সমস্যা নেই। তাদের যুক্তি হলো, মুখাবয়ব পুরোপুরি ঢেকে চলাচলকারী নিরাপত্তার দিক থেকে কখনো ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় ঘটেছে মজার কাণ্ড। সেখানে আইন পাসের পরে পুলিশ খবর পেলো যে, এমন একটি পুতুলকে দোকানে শোপিস হিসেবে রাখা হয়েছে, তার পুরোপুরি মুখ ঢাকা। ব্যস, তাতেই পুলিশ হানা দিয়েছিল।
মার্কেল ১০ লাখের বেশি সিরীয় উদ্বাস্তু গ্রহণ করে ইতিহাস তৈরি করেছেন। জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেলই একমাত্র কণ্ঠস্বর, যিনি বোরকা বিতর্কে সংযম দেখানোর পরামর্শ দিয়েছেন। যদিও তিনি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করেন যে, সম্পূর্ণরূপে আবৃত কোনো পোশাক মেলবন্ধন বা সামাজিক ইন্টেগ্রেশনের জন্য একটি অন্তরায়। তবে তিনি মনে করেন, বোরকা আবার এমনো কোনো পোশাক নয়, যা কোনো অবস্থাতেই পরা যাবে না। তিনি একটা মধ্যপন্থা নিয়েছেন। অ্যাঙ্গেলা মার্কেল বলেন, জায়গাগুলো নির্দিষ্ট করা যেতে পারে। যেমন- কোনো আদালত বা পাবলিক সেক্টরের কোথাও এটা গ্রহণযোগ্য নয়, অন্যত্র গ্রহণযোগ্য। তাঁর কথায়, যদিও কিছু ধর্মীয় বৈষম্যমূলক আচরণ খুব অদ্ভুত মনে হতে পারে। কিন্তু আমাদেরকে অবশ্যই সর্বদা ধর্মীয় স্বাধীনতার উচ্চ মূল্যবোধ মনে রাখতে হবে। বার্লিনে আন্তর্জাতিক পার্লামেন্টারিয়ানদের এক সভায় সম্প্রতি তিনি একথা বলেন। মার্কেল আরো বলেন, ‘স্বাধীনতার অধিকার তেমন স্বাধীনতাকেও সুরক্ষা দেয়, যেটা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যেমনটা ভাবে বা কল্পনা করে তার থেকে তা ভিন্ন হতে পারে। ১৯শে আগস্ট জার্মান বেতার ডয়েচে ভেলের মার্টিন মুলো মন্তব্য করেছেন, জার্মানির বোরকা নিষিদ্ধের কোনো দরকার নেই। তাঁর কথায় বোরকা পরিহিত কাউকে দেখা যায় না জার্মানির শহরগুলোতে। তবে ভুল বোঝাবুঝি যাতে না হয়, সেজন্য আমি বলবো, বোরকা, নেকাব ও চাদর, যা দিয়ে নারীর শরীরকে পুরোপুরি ঢেকে দেয়া হয়, তখন সেটা একটা প্রতিক্রিয়াশীল ও নিপীড়নমূলক ধারণায় পরিণত হয়, নারীর শরীরের ওপর পুরুষের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ২০১৬ সালের আগস্টে ফ্রান্স মেয়েদের সাঁতার কাটার পোশাক হিসেবে বুরকিনি নিষিদ্ধ করেছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন স্টাডিজ সেন্টার সব থেকে প্রিয় পোশাক কী তা জানতে একটি সমীক্ষা করে। ২০১১ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত পরিচালিত সমীক্ষায় ৩২ শতাংশ পাকিস্তানি নারী-পুরুষ বলেছেন, তাদের প্রিয় পোশাক নেকাব। সমীক্ষায় থাকা দেশগুলো ছিল- তিউনিশিয়া, পাকিস্তান, মিশর, ইরাক, লেবানন, সৌদি আরব এবং তুরস্ক। প্রশ্ন রাখা হয়েছিল, প্রকাশ্যে একজন নারীর কেমন পোশাক পরিধান করা উচিত? এতে ৩,৫২৩ পাকিস্তানি অংশ নেন। ৩১ শতাংশ বলেছে, তাদের পছন্দ ‘আবায়া’, শাটল কক বোরকা মাত্র ৩ ভাগ মানুষের পছন্দ। উত্তরদাতাদের ৫১ শতাংশ ছিলেন পাকিস্তানি পুরুষ। তিউনিশিয়ায় আরব বসন্তের পরে আরেকটি বড় সমীক্ষা চলে। এতে দেখা যায়, আফগানিস্তানের নারীরা এমন বোরকা পরে, যাতে পুরো শরীর তো বটেই, চোখ দুটোও ঢাকা থাকে। পাতলা নেট দিয়ে তারা কোনোমতে দেখেন। এতে পরিষ্কার যে, আফগান নারীরা সব থেকে রক্ষণশীল পোশাক পরেন। রক্ষণশীলতায় দ্বিতীয় অবস্থানে আছেন সৌদি আরব ও অন্য কয়েকটি পারস্য উপসাগরীয় দেশের নারীরা। তারা পুরো শরীর ঢেকে কেবল চোখ দুটি খোলা রাখেন। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে শিয়া তরিকার বোরকা।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের বোরকা বিপ্লবে সৌদি ভাবধারার প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অনেকের মতে সৌদি আরবে কর্মরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা এই বোরকা বিপ্লবে বড় অবদান রাখতে পারেন। যুগ যুগ ধরে বোরকা চলছে, কিন্তু তাতে যুক্ত হয়েছে পা ও হাতে মোজা এবং শুধু চোখ খোলা রাখার মতো করে বোরকায় পরিবর্তন আনা। এটা অধিকতর রক্ষণশীলতার নির্দেশক। ওই সমীক্ষা রিপোর্টে বলা হয়, ইরান, ইরাক ও লেবাননে এই পোশাকের চল রয়েছে। এতে হাত ও মুখের কিছু অংশ খোলা থাকে। তবে জনপ্রিয়তার শীর্ষে যে পোশাকটি রয়েছে, সেখানে মাথায় স্কার্ফ ধরনের এবং লম্বা পোশাকের সঙ্গে পুরো মুখাবয়ব খোলা থাকে। মিশরের নারীদের ৫২ শতাংশ এটি পরেন। রিপোর্ট বলেছে, বর্তমান মুসলিম বিশ্বের নারীরা সব থেকে আধুনিক হিসেবে এই পোশাকটিকেই বেছে নিয়েছেন। বিশেষ করে ইরান ও তুরস্কের আধুনিক নারীরা এই পোশাক পছন্দ করছেন। এর সঙ্গে আরো একটি স্টা�-মানব্জমিন