আবদুস শহীদ-
মেঘালয়ের পাদদেশে হাওর বাওর নদী আর জল জোসনায় স্নাত সুনামগন্জ জেলা।ভাটি অঞ্চল নামে খ্যাত এই জেলায় জন্ম নিয়েছেন অনেক কালজয়ী ব্যক্তিত্ব।দেশ বরেণ্য রাজনীতিবীদ,আউল বাউল পীর আউলিয়া।এখানে জন্মেছেন মরমী কবি দেওয়ান হাসনরাজা,বাউল সাধক রাধারমন দত্ত,বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম,বাউল কামাল পাশা,কারি আমির উদ্দিন এবং মরমী বাউল সাধক দুর্বিন শাহ।সিলেট বিভাগের সুনামগন্জ জেলার একটি উপজেলা ছাতক।দেশের প্রাচীনতম শিল্প নগরী হলেও এ অঞ্চলের লোকজ সংষ্কৃতির ঐতিহ্য সুপ্রাচীন ও সর্বজনবিদিত। লোকজ সংষ্কৃতির ধারায় এ অঞ্চলে যারা যোগযোগ ধরে অবদান রেখেছেন,তাদের মধ্যে ছিলেন মরমী সাধক কবি দুর্বিন শাহ অন্যতম।প্রতিভা দিয়ে তিনি ছাতক উপজেলাকে অনেক ক্ষেত্রে উজ্জ্বল করে তুলে ধরেছেন। ছাতকের সুরমা নদীর উত্তর পারে নোয়ারাই গ্রামের তারামনি টিলাতে জন্ম গ্রহন করেন বাংলার লোকগীতির এই মরমী সাধক দুর্বিন শাহ।কালান্তরে এই টিলাটি দুর্বিন টিলা নামে পরিচিত। ১৯২০ সালের ২ নবেম্বর তিনি জন্ম গ্রহন করেন।তার পিতা সাফাত আলি শাহ ছিলেন একজন সুফি সাধক।মা হাসিনা বানু ছিলেন একজন পিরানী।বলতে গেলে সঙ্গীত চর্চার ক্ষেত্রে পারিবারিক ঐতিহ্যে তিনি বেড়ে উঠেছিলেন।মাত্র সাত বছর বয়েসে তিনি বাবাকে হারান।মা হাসিনা ভানুর সান্নিধ্যে তিনি বেড়ে উঠেন।মায়ের অনুপ্রেরণায় তাঁর সঙ্গীত চর্চায় হাতেখড়ি।যৌবনে তিনি বাউল বেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে।মা হাসিনা োবানু সংসার সামলিয়েছেন।মায়ের আধ্যাত্মিক সাধনার ছায়াতলে তাঁর বাউল গানের পরিধি বহুগুনে বৃদ্ধি পেয়েছে।তাই জ্ঞানের সাগর দুর্বিন শাহ জীবদ্বশায় কোন মালজোরা গানের আসরে হেরেছেন বলে কোন নজির নেই।তাঁর অধিকাংশ গানে সুফিবাদ ও মরমীবাদের প্রকাশ থাকলেও এর বাইরে ভিন্ন মেজাজে তিনি অসংখ্য গান লিখেছেন। শ্রেনী ভেদে এ সব গান গুলোকে বাউল,বিচ্ছেদ,আঞ্চলিক,গনসঙ্গীত,জারি,সারি, ভাটিয়ালী, মালজোরা, হামদ, নাত, মুর্শেদী, ভক্তিগীতি দেহাতত্ব, সুফিতত্ব, দেশের গান সহ বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায়।
মহান মুক্তিযোদ্ধের সময় তিনি অসংখ্য গনজাগরণ মোলক গান রচনা ও পরিবেশন করে তিনি বাঙ্গালী জাতীকে উজ্জীবিত করেছেন। ১৯৭৪ সালে কলকাতার বিশিষ্ট চলচিত্রকার ঋত্বিক ঘটক তাঁর যুক্তিতক্ক,আর গপ্পো চলচ্চিত্রে ব্যবহার করেছিলেন বাউল সাধক দুর্বিন শাহের লেখা গান “ নামাজ আমার হইলনা আদায়”শীর্ষক গানটি। দারুণ অভাব অনটনে থেকেও বাস্তব সত্যকে তাঁর গানে ধারণ করেছেন।অভাবের তারনায় কাজের চাপে মুসলমানদের ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া সম্ভব হচ্ছিলনা বিধায় তাঁর গানে গভীর অপরাধ বোধ প্রকাশ পেয়েছে।এ রকম বস্তুনিষ্ট উচ্চারণ তাঁর অসংখ্য গানে প্রকাশ পেয়েছে। ১৯৬৮ সালে বৃটেন প্রবাসী বাঙ্গালীদের আমন্ত্রনে বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম ও জ্ঞানের সাগর দুর্বিন শাহ লন্ডনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করেন।দুর্বিন শাহের গানের কথায় বিমোহিত হয়ে সেখানকার বাঙ্গালীরা শাহ আব্দুল করিমকে ‘রসের সাগর’ ও দুর্বিন শাহকে “ জ্ঞানের সাগর” উপাধিতে সম্মানিত করেন।কেউ কেউ দুর্বিন শাহের পদাবলীর সঙ্গে ফকির লালন শাহের পদাবলীর সাদৃশ্য খুঁজে পান।প্রকৃত বাউলরা তাদের তত্বসমৃদ্ধ গান গুলি কেবল নিজেদের মধ্যেই আলোচনায় সিমাবদ্ধ রাখতেন।কিন্তু বর্তমানে সিলেট তথা দেশের বাউলরা দর্শকদের মনোরঞ্জনের জন্যে মঞ্চে ও বাউল গান পরিবেশন করে থাকেন।দুর্বিন শাহ ছিলেন এই বাউলদেরই উত্তরসূরি।বাউলকবিদের গানের ধরন একই রকম।বস্তুত রচনাশৈলীর কিছু ভিন্নতা ছাড়া সব বাউল গানের অর্থ একই।এর বাইরে নন দুর্বিন শাহ ও।
লালন শাহের মাধ্যমে বাউল গানের ভিন্ন মাত্রা প্রকাশ পেয়েছে,এবং নতুন উচ্চতায় আসিন হয়েছে এটা প্রায় সকল গবেষকদের ধারণা।তবে লালনের জন্মের আগে থেকে সিলেট অঞ্চলে বাউল ফকিরদের একটি গুরুত্ব পূর্ন ধারা যেভাবে এগিয়ে ছিল,তা কোন কারনে গবেষকদের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে।সিলেটের দীন ভবানন্দ ও সৈয়দ শাহনূর সহ অন্যরা সেই চর্চা অব্যাহত রেখেছিলেন।পরবর্তি সময়ে মৌলবীবাজারের সৈয়দ ইয়াসিন শাহ, সিলেটের শিতালং শাহ হয়ে বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে ফকিরি ও বাউল গানের একটি সতন্ত্র ধারা তৈরি হয়েছিল।এদের মধ্যে শিতালং শাহ,ইয়াসিন শাহ,হাসন রাজা,বাউল রসিদ উদ্দিন,উকিল মুন্সি,শাহ আব্দুল করিম এবং দুর্বিন শাহ উল্লেখযোগ্য। দুর্বিন শাহের গানে দেহতত্ব এবং বাউল দর্শনের নিগূঢ় বিষয়াধি ফুটে উঠেছে।তাঁর গানের ভাষা পূর্বসুরি বাউলদের চেয়ে কিছুটা ব্যতিক্রম এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ। বাউল অনুরাগী কবিগুরু রবীন্দ্র নাথের মতামত ও ছিল অভিন্ন।
তিনি লিখেছেন,’ বাউল সাহিত্যের যে ধারা তা হিন্দু মুসলমানকে সমান ভাবে আকৃষ্ট করেছে।তারা একত্র হয়েছে অথচ কেউ কাউকে আঘাত করেনি।লালন শাহ তাঁর গানে যেমনটি বলেছেন,’ মানবতত্ব যার সত্য হয় মনে/ সে কি অন্য তত্ব মানে।একই সাম্যবাদীর কথা প্রকাশিত হয়েছে দুর্বিন শাহের গানে।’ গরীব দুঃখী চাষী মজুর সবার সমান অধিকার।সাম্যবাদ,বাউল তত্ব,দেহতত্ব যেমন দুর্বিন শাহের গানে লক্ষনীয় তেমনি অসংখ্য বিচ্ছেদ গানের রচয়িতা ও তিনি।বিচ্ছেদে আকৃষ্ট হয়ে দুর্বিন শাহের গানের উক্তি,’ আমার অন্তরায় আমার কলিজায়/ প্রেমসেল বিঁধিল বুকে মরি হায় হায়।। ‘ মারিয়া ভূজঙ্গ তীর,কলিজা হইল চৌচির, কেমন শিকারী তীর মারিল গো।।দেহ থইয়া প্রানটি লইয়া যায়।। যুগে যুগে কালে কালে অবলা নারীরা পুরুষের প্রেমের ফান্দে পরে ধুকে ধুকে মরছে।তারই বেদনা গাঁথা সুরে দুর্বিন শাহের উক্তি, ‘ নির্জন যমুনা কুলে, বসিয়া কদম্বতলে/ বাজায় বাশী বন্ধু শ্যাম রায়।। বাঁশিতে কি মধু ভরা আমারে করিল সাড়া/ আমি নারী গৃহে থাকা দায়।। বন্ধুর প্রতি হৃদয়ের এতই টান যে,বন্ধুকে সর্বদা কাছে পেতে চায়।তাই দুর্বিন শাহের গানের উক্তি,’ বন্ধু যদি হইত নদীর জল/ পিপাসাতে পান করিয়া পোড়াপ্রান করতাম শীতল।।অথবা, ছাড়িয়া যাইওনা বন্ধুরে, দুর্বিন শাহ অন্যান্য বাউলের মত দেহতত্ব ও সাধনতত্ব নিয়ে অনেক গান রচনা করেছেন।সাধনায় পথ চলতে হলে পঞ্চতত্বের ভেদ জানা আবশ্যক।তাই দুর্বিন শাহ তাঁর গানে বলেছেন,পঞ্চ-তত্বের ভেদ বুঝিয়া করোরে মন সাধনা/ দেহে আছে পঞ্চতত্ব তারে আগে চিনো না।।বাউল মতবাদের অনুসারিদের দেহের কাম ভাব ও শ্বাস প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ না করতে পারাটাই মস্তবড় ব্যর্থতা।তাই মায়াসাগরে পরিভ্রমণ করার ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতার আশ্রয় নিতে বলেছেন দুর্বিন শাহ।’না জানিয়া ডুব দিওনা এ ভব সাগরে’/ কত মাঝির ভরা খাইল মারা পড়িয়া নদীর চক্করে। দুর্বিন শাহ র গায়কি ঢংগে এসেছে গনচেতনার বিষয় তাঁর রচিত পাক বঙ্গ ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ গীতি ( ১৯৭০) পুস্তিকার ছয়টি গান দেশাত্ববোধক গনসঙ্গীত পর্যায় ভূক্ত।
এ ছাড়া সোনার বাংলা সংগ্রাম গীতিকা শীর্ষক পুস্তকে ১০/ ১২ টি দেশাত্ববোধক গান স্থান পেয়েছে,কিন্তু গান গুলো সংরক্ষনের অভাবে প্রচারের মুখ দেখেনি। দুর্বিন শাহের প্রকাশিত গ্রন্থ সমুহ , প্রেমসাগর পল্লীগীতি ১ম খন্ড ( ১৯৫০ ) প্রেম সাগর পল্লীগীতি ২য় খন্ড (১৯৫০) প্রেম সাগর পল্লীগীতি ৩য় খন্ড( ১৯৬৫)প্রেম সাগর পল্লীগীতি ৪র্থ খন্ড ( ১৯৬৫) পাক বঙ্গ ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ গীতি ( ১৯৭০) প্রেমসাগর পল্লীগীতি ( ১৯৭৩ )দুর্বিন শাহ সমগ্র ( ২০১০ )। সিলেট সহ সাড়া দেশে একসময় দুর্বিন শাহ গান পরিবেশন করে দর্শক শ্রুতাদের মাতিয়েছিলেন। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে কন্ঠ যুদ্ধা হয়ে অনেক অবদান রেখেছেন।১৯৭৭ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারী নিজ বাসভবনে এই শিল্পী মৃত্যুবরণ করেন।কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় তাঁর মৃত্যুর দীর্ঘ কাল অতিবাহিত হলেও জাতী তাঁর অবদানকে যথাযত মর্যাদা দিতে পারেনি।এমন কি এই গুনি বাউল শিল্পী এখন পর্যন্ত কোন রাষ্ট্রীয় পুরষ্কার না পাওয়াটা দুঃখজনক।
সংবাদ টি পড়া হয়েছে :
৫২৮ বার