বাজারে রুটি-পানি-লেবু বিক্রি করতেন এরদোগান
রেজেপ তায়্যিপ এরদোয়ান। একটি নাম। একটি আন্দোলন। একটি সংগ্রাম। তিনি আপাদমস্তক একজন ক্যারিশম্যাটিক রাজনীতিবিদ এবং একজন চেঞ্জ মেকার। তার বাবা আহমদ এরদোয়ান ১৩ বছর বয়সে বিয়ে করেছিলেন কিন্তু ১৯৫২ সালে সেই সংসার ভেঙ্গে যায়। ১৯৫৩ সালে বিয়ে করেন তানযিলে হানিম নামে এক মহিয়সী নারীকে। এই দম্পতির কোল আলোকিত করে ১৯৫৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি রবিবার জন্ম নেন রেজেপ তায়্যিপ এরদোয়ান। আরবি মাস রজব থেকে রেজেপ, দাদার নাম থেকে তায়্যিপ এবং বংশীয় উপাধি এরদোয়ান। আগের সংসারে দুই ভাই আর এই সংসারে দুই ভাই, একবোন মিলে এরদোগানরা ৫ ভাই-বোন। ইমাম হাতিব স্কুলে এরদোগানের শিল্প-সংস্কৃতির ইতিহাস বিষয়ে শিক্ষক সেমরা আজার জানান, এরদোগান নেতা হয়েই জন্মেছিল। সে ক্লাসের সভাপতি (শ্রেণি প্রতিনিধি) ছিল। খেলাধুলা করত এবং খেলাধুলায় সফল হতো। বন্ধুদের সাথে তার খুবই ভালো সম্পর্ক ছিল, বড়দেরকে সে অনেক সম্মান করত। স্কুলে কুরআন তেলায়াত, আযান প্রতিযোগিতা এবং কবিতা আবৃত্তিতে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বি। ১৯৭৩ সালে কবিতা আবৃত্তিতে পুরো তুরস্কে প্রথম হয়েছিলেন, ১৯৭৪ সালে কলেজ লেভেলের প্রতিযোগিতায় সারাদেশে কবিতা আবৃত্তিতে প্রথম হন। এরদোগানের পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুব বেশি ভালো ছিল না। ছুটির দিনগুলোতে তিনি বাজারে বেরিয়ে পড়তেন। সিমিট (রুটি), পানি, লেবু বিক্রি করতেন। এখান থেকে যে অর্থ আসত, তা দিয়ে পরিবারকে সহায়তার পাশাপাশি স্কুলের বেতন পরিশোধ করতেন। ব্যক্তিগত পাঠাগারের জন্য বই পড়তেন। কলেজ জীবনে পা রাখার আগেই তৈরি করে পেলেন মোটামুটি বড়সড় একটি ব্যক্তিগত পাঠাগার। সূত্র: হাফিজুর রহমানের লেখা এরদোয়ান দ্যা চেঞ্জ মেকার
যে কারণে জনপ্রিয়তার শীর্ষে এরদোগান
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের জনপ্রিয়তা দেশের সীমানা ছাড়িয়েছে। দিনদিন জনপ্রিয়তা বেড়েই চলছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে তার দল একেপি, তার সামাজিকতা, মানুষকে আপন করে নেয়ার ক্ষমতা। তার সবচেয়ে বড় গুণ হচ্ছে তিনি মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করতে পারেন। এগুলো আসে তার অন্তর থেকে। তিনি হলেন নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রতিনিধি, এর আগের শাসকরা যাদেরকে উপেক্ষা করেছেন। এরদোগান সংকীর্ণতা ও গোঁড়ামির ঊর্ধ্বে উঠে তুরস্ককেই শুধু নেতৃত্ব দিচ্ছেন না, মুসলিম বিশ্বের জন্যও একটা ‘ইমেজ’ সৃষ্টি করেছেন। এরদোগান নিজেকে ‘জনগণের একজন’ বলে মনে করেন এবং তার কাজেকর্মেও এর প্রতিফলন দেখা যায়। সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষমতা কুক্ষিগত করা উঁচু শ্রেণির মানুষের কাছ থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়েছে একে পার্টি। আগে রাষ্ট্রযন্ত্রের সবগুলো অঙ্গের কার্যক্রমই ছিল জনগণবিমুখ। কিন্তু এখনকার প্রশাসন জনগণের প্রশাসন।’ গাজায় মুসলমানরা যখন ইসরাইলি হামলায় মারা যাচ্ছিল, তখন তিনি সেখানে ওষুধ ও শিশুখাদ্য পাঠিয়েছিলেন। তিনি দেশটিতে স্থিতিশীলতা উপহার দিয়েছেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে দিন দিন দেশটি উন্নতি করছে, যা বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি উঠতি শক্তি। তুরস্কের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দেশটিকে মধ্য এশিয়াসহ মুসলিম বিশ্বে বিনিয়োগ বাড়াতে সাহায্য করছে।
জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির সুযোগ্য নেতৃত্বে দলটির জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছেই। এর মূল কারণ হচ্ছে, এর নেতৃত্বের গাড়িতে যারা আছেন তারা কেউই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নন। দলটি যথেষ্ট আধুনিকমনস্ক। দলটির বড় সাফল্য সেনাবাহিনীকে গণতন্ত্রমুখী করা। সেনাবাহিনী এখন গণতন্ত্রের প্রতি ‘কমিটেড’। সেনাবাহিনীর সঙ্গে বৈরিতায় না গিয়ে, তাকে গণতন্ত্রের মূল ধারায় ফিরিয়ে এনেছেন এরদোগান। ইসলাম ও গণতন্ত্র যে একে অপরের পরিপূরক এবং ইসলাম গণতন্ত্রের শত্রু নয় কিংবা গণতন্ত্র ইসলামের বিরোধী নয় এরদোগানের দল এটা প্রমাণ করেছে। তার সরকার সীমিত পরিসরে মাদরাসা চালু করেছে। মেয়েদের মাথায় ওড়না বা হিজাব ফিরেয়েেএনেছে। এক সময় এ ওড়না ক্যাম্পাসে নিষিদ্ধ ছিল। সিরিয়া সঙ্কটে সিরিয়ার নাগরিকদের জন্য ‘মানবিক কারণে’ সীমান্ত খুলে দিয়েছিল তুরস্ক। সিরিয়া সঙ্কটে ‘পশ্চিমা হস্তক্ষেপ’ তুরস্ক সমর্থন করে না। সোমালিয়ার মতো মুসলমান প্রধান দেশের সঙ্কট নিরসনে তুরস্কের ভূমিকা প্রশংসিত হয়েছে। যুদ্ধপীড়িত সোমালিয়া থেকে শত শত শিশুকে তুরস্কের বিভিন্ন স্কুলে উচ্চশিক্ষার সুযোগ করে দিয়েছে তুরস্ক সরকার। তুরস্কের সীমান্তঘেঁষা মুসলিম প্রধান মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করার উদ্যোগ নিচ্ছে তুরস্ক। এক সময় ওই অঞ্চলগুলোর ওপর দিয়েই প্রাচীন ‘সিল্ক রোড’ চলে গিয়েছিল। তুরস্ক এখন সেই ‘সিল্ক রোড’ পুনরুজ্জীবিত করছে। মধ্য এশিয়ার জ্বালানি সম্পদের পূর্ণ ব্যবহার করতে চাইছে তুরস্ক। আর এ লক্ষ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাকু-তিবিলিসি-সাইনহান গ্যাস পাইপলাইন। অনেক মুসলিম অধ্যুষিত দেশে সন্ত্রাসবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠলেও শতকরা ৯৯ ভাগ মুসলমানের দেশ তুরস্কে সন্ত্রাসবাদের উত্থান ঘটেনি। তুরস্কে দুর্নীতির অভিযোগ মুক্ত ইসলামমনস্ক নেতৃত্ব প্রমাণ করেছেন তারাও পারেন দেশটিকে পশ্চিমা বিশ্বের সমমানে দাঁড় করাতে। ২০০৩ সালে ক্ষমতায় আসার পর এরদোগানের সরকার দেশের অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নতি সাধন করেছে। এর মধ্যে অনেকগুলো বৃহৎ সেতু নির্মাণ, সড়ক সংস্কার, সমুদ্রতলদেশীয় টানেল, বিমানবন্দর ও নির্মাণ এবং মেট্রোরেল উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া স্বাস্থ্যসেবা খাতেও উন্নতি সাধন করেছে এই সরকার।
১৯৯৭ সালে সেনা অভ্যুত্থানের পর একটি কবিতা আবৃত্তি করায় এরদোগানকে ৪ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল। তাকে ১০ মাস কারাভোগও করতে হয়েছিল। কবিতাটি ছিল- ‘মসজিদ আমাদের ক্যান্টনমেন্ট, গম্বুজ আমাদের হেলমেট, মিনার আমাদের বেয়োনেট এবং বিশ্বাসীরা আমাদের সৈনিক।’ এরদোগানের ডাকে লাখ লাখ দেশপ্রেমিক জনতা রাস্তায় নেমে আসে। এমনকি ট্যাঙ্কের সামনে সেনা অভ্যুত্থান রুখতে জীবন বিলিয়ে দিতেও দ্বিধা করেনি অনেকে। এভাবে জনগণের স্বতঃফূর্তভাবে রাতে রাস্তায় নামার ফলে ব্যর্থ হতে বাধ্য হয় কতিপয় বিদ্রোহী সেনার অভ্যুত্থান। তিনিই পার্লামেন্ট মসজিদে মাঝে মাঝেই নামাজের ইমামতি করেন। তুরস্কের অনেক মসজিদে নামাজের ইমামতি করেছেন তিনি। তার উদ্যোগে প্রতি বছর তুরস্কে বিশ্ব কোরআন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয় এবং এতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের হাফেজরা অংশগ্রহণ করে থাকেন। রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ইসলাম, অর্থনীতি ও গণতন্ত্রকে সমন্বিত করে মধ্যপ্রাচ্যের জন্য একটি রোল মডেল সৃষ্টি করেছেন তিনি। ইসলামী ঐতিহ্য, তাহজীব-তামাদ্দুন ও চেতনা ফিরিয়ে এনেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তুরস্ক সফরে গিয়ে বলেছিলেন, একজন নেতা কীভাবে একইসঙ্গে ইসলামিক, গণতান্ত্রিক ও সহিষ্ণু হতে পারেন তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ এরদোগান।