বিএনপি’র নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করলেন খালেদা জিয়া
শেখ হারুন অর রশিদ-
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে ঘোষণা করেছেন আগাম নির্বাচনী ইশতেহার। কর্মসংস্থান, কৃষি, শিক্ষা, উন্নয়ন নিয়ে স্পষ্ট ভিশন ঘোষণা করেছেন তিনি। রোববার বিকেলে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে বিএনপি আয়োজিত সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে উঠে এসেছে এ ঘোষণা। আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে জনগণ যেসকল সুযোগ সুবিধা পাবে সে প্রসঙ্গে খালেদা জিয়া বলেন- আমরা ক্ষমতায় গেলে সারাদেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হবে। ঘরে ঘরে চাকরি দেয়া হবে।বেকার ভাতার ব্যাবস্হা করা হবে, কেউ এক বছর বেকার থাকলে তাকে বেকার ভাতা দেয়া হবে। দেশে শিক্ষিত বেকার থাকবে না,শিক্ষিত যুবকদের চাকরির নিশ্চয়তা দেয়া হবে। নারী কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। সকল শিক্ষা অবৈতনিক করা হবে, নারিদের উপবৃত্তি বৃদ্ধি করা হবে। সরকারি চাকুরিজীবিদের দক্ষতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রমোশন দেওয়া হবে,বেতন বৃদ্ধি করা হবে।স্বাস্থ্যবিমা চালু করা হবে।সকল নাগরিকের জন্য বিনামূল্যে স্বাস্হসেবা নিশ্চিত করা হবে।কৃষকদের জন্য সার-ওষুধ সুলভ করা হবে। ন্যায্য দরে কৃষিপণ্য কিনে নেয়া হবে। দরিদ্র ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের কৃষি ঋণ মওকুফ করা হবে। গ্রামে কর্মসংস্থান করা হবে, যাতে গ্রামের মানুষকে শহরে আসতে না হয়। গ্রামের মানুষ গ্রামে থেকেই গ্রামের উন্নয়ন করবে। কৃষি উৎপাদন বাড়ানো হবে।
উল্যেখ্য, এ বছরের প্রথমার্ধেই এমন একটি ‘ভিশন ২০৩০’ ঘোষণা করেছিলেন খালেদা জিয়া। সমাবেশে দীর্ঘ ১ঘন্টা ২মিনিট বক্তব্য দেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বলেন, তারা (আওয়ামী লীগ সরকার) কথায় কথায় উন্নয়নের কথা বলে। কিন্তু তারা উন্নয়নের নামে লুটপাট করছে। ইউরোপ-আমেরিকায় রাস্তা নির্মাণে যে খরচের তিন চারগুণ বেশি খরচ করে রাস্তা নির্মাণ করা হচ্ছে। তাও সেগুলো ঠিকভাবে হচ্ছে না, ভেঙে ফেলতে হচ্ছে। তিনি বলেন,বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলেও মানুষ বিদ্যুৎ পাচ্ছে না। প্রতি পদে পদে ধোঁকাবাজি।কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্লানকে দায় মুক্তি দেয়া হয়েছে। সব পুরনো জিনিস বিদেশ থেকে আনা হয়েছে। এগুলো একবার চলে, আবার বন্ধ হয়ে যায়। বিএনপি চেয়ারপারসন অভিযোগ করে বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলেই শেয়ার বাজার লুট হয়। এর আগে কখনো শুনিনি সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের মানুষের টাকা আছে। এই সরকারের এমপি-মন্ত্রীরা জনগণের রক্ত চুষে টাকা চুরি করে বিদেশে পাচার করেছেন। ২০১৫ সালে শুধু এক বছরে এই সংখ্যা বেড়েছে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া গত ১০ বছরে (২০০৮ – ২০১৭) আওয়ামী লীগ সাড়ে চার লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে। এটা আমাদের হিসাব নয়, আমেরিকা-ভিত্তিক একটি কোম্পানির হিসাব। আওয়ামী লীগের পদে পদে দুর্নীতি। পাচার করা বিপুল অংকের টাকার খবর পানামা পেপারসে এসেছে। দুদক কিন্তু এই কেলেংকারি নিয়ে কোনো মামলা বা তদন্ত করেনি। অথচ দুদক পড়ে আছে আমাদের পেছনে।
একটি বেসরকারি সংস্থার তথ্য দিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, গত সাত বছরে চুরি হয়েছে ৬০ হাজার কোটি টাকা। বুঝতেই পারছেন ব্যাংকগুলোর কি অবস্থা! এ খাতের দুর্নীতির সঙ্গে কারা জড়িত মানুষ তা জানে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮০০ কোটি টাকা কারসাজি করে পাচার করা হয়েছে। কিন্তু এগুলো নিয়ে কোনো তদন্ত হয় না। কাউকে ধরা হয়নি। জনগণের টাকা এভাবে পাচার হচ্ছে, অথচ এর কারণে কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি, বিচার হয়নি। এগুলো তো আওয়ামী লীগের টাকা নয়, জনগণের টাকা। এদেশের মানুষ বাঁচলো কি মরলো তা নিয়ে তাদের কোনো মাথা ব্যথা নেই। তিনি বলেন,আওয়ামী লীগ জনগণকে ভয় পায়। আমরা ভয় পাই না। মানুষই আমাদের ভরসা। আমি তাদের (আওয়ামী লীগ) ক্ষমা করে দিয়েছি। কিন্তু জনগণ জানে তারা কত অবিচার করেছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেন, যারা চুরি করে জিতবে, জনগণকে পাশ কাটিয়ে জিতবে তাঁরা জনগণকে ভয় পাবেই। জনগণের সামনে যেতে ভয় পাবেই। কিন্তু জনগণকে নিয়েই আমাদের রাজনীতি। এ জনগণের জন্যই আমাদের রাজনীতি। জনগণের জন্যই আমাদের ভালোবাসা। তাই আমরা বলেছি জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করতে চাই। যাতে আমার দেশের প্রতিটি মা, বোন, ভাই, ছেলে যারা ভোটার, তারাও যেন ভোটকেন্দ্রে গিয়ে নিজের ভোট নিজে দিতে পারে সে পরিবেশ, সে ব্যবস্থার সৃষ্টি করতে হবে।
নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে তিনি বলেন, নিরপেক্ষ নির্বাচন দিয়ে দেশের মানুষ কী চায় সেইটা যাচাই করুন। ২০১৪ সালে কোনো নির্বাচন হয় নাই। ৫ শতাংশ ভোটও তারা পায় নাই। এ সংসদ অবৈধ, এ সরকার অবৈধ। কীভাবে বলবে জনগণের সরকার?’-মন্তব্য করেন তিনি। বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, নির্বাচন কমিশনকে বলব, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা আপনাদের দায়িত্ব। আপনারা নিরপেক্ষ সরকারের কথা বলেন। শেখ হাসিনার অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে না। যদি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হয় তাহলে সেনা মোতায়েন করতে হবে। সেনাবাহিনীকে মেজিস্ট্রেসি পাওয়ার দিতে হবে। নির্বাচনে ইভিএম চলবে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া নেই উল্লেখ করে খালেদা বলেন, ছাত্রলীগ-যুবলীগ সব নিয়ন্ত্রণ করছে। শিক্ষকদের গায়ে হাত তুলছে। নারীদের নির্যাতন করছে। আগে গণ অত্যাচার দেখিনি। নতুন নতুন জিনিস আমদানি করছে তারা।
খালেদা জিয়া বলেন, গুম, খুন ও হত্যার রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। যাদের গুম করা হয়েছে, তাদের অপরাধ তারা বিএনপি করে। বিদেশিরা এ বিষয়ে ঠিক জানে। বিচার বিভাগ নিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, বিচার বিভাগের কী অবস্থা করেছে, আপনারা দেখেছেন। প্রধান বিচারপতিকে জোর করে অসুস্থ বানিয়ে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছে। দেশের বাইরে এজেন্সির লোক পাঠিয়ে তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে। তিনি দেশে ফিরতে চেয়েছিলেন। চাপ সৃষ্টি করে তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ বলে থাকে বিএনপি ক্ষমতায় আসলে আপনাদের চাকরি চলে যাবে। আমরা হিংসার রাজনীতি করি না। কে কত যোগ্য, দক্ষ এসব বিবেচনা করে প্রমোশন দেয়া হবে। আপনারা নির্ভয়ে কাজ করতে পারেন। তারা আপনাদের ভয় দেখায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, তত্ত্বাবধায়কের দাবি এ আওয়ামী লীগের, জামায়াতের। টানা ১৭৩ দিন হরতাল করেছিল তারা। রাস্তায় অরাজকতা সৃষ্টি করেছিল। তত্ত্বাবধায়ক দাবির জন্য চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর দিনের পর দিন বন্ধ রেখেছিল। দেশ এখন অচল উল্লেখ করে তিনি বলেন, রূপনগরে সরকারি অফিস মাত্র দুই ঘণ্টা চলে বলে পত্রিকায় খবর এসেছে। নির্বাচন হলে সব সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বিএনপি গাড়িতে আগুন দেয়না, আওয়ামী লীগ গাড়িতে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যা করে এ দাবি করে তিনি বলেন, তারা বাসে বাসে আগুন দিয়ে মিথ্যা মামলা দায়ের করে। আমরা মানুষ হত্যা করব না। আমরা আপনাদের শুদ্ধ হওয়ার সুযোগ দিতে চাই। শুদ্ধ করতে চাই। রোহিঙ্গা সমস্যা জাতীয় সমস্যা উল্যেখ করে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এটা শুধু অবৈধ ভোটারবিহীন সরকারের সমস্যা না। এটা জাতীয় সমস্যা। তাদের শুধু ফিরিয়ে নিলে হবে না, নাগরিকত্ব দিয়ে নিরাপদে বসবাসের ব্যবস্থা করতে হবে। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক সংস্থা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, চীন, রাশিয়া, ভারতসহ বড় বড় দেশগুলোকে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান খালেদা জিয়া। এর আগে নেতাকর্মীদের ভিড় ঠেলে বিকেল ৩টা ১৫ মিনিটে মঞ্চে উঠেন খালেদা জিয়া। মুহুর্মুহু স্লোগান আর করতালিতে তাকে স্বাগত জানান নেতাকর্মীরা। দু’হাত নেড়ে নেতাকর্মীদের অভিবাদন গ্রহণ করেন তিনি।
সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। পরিচালনা করেন প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি ও সহ-প্রচার সম্পাদক আমিরুল ইসলাম খান আলীম। এতে বক্তব্য রাখেন- বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, বিএনপি নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান, ব্যারিস্টার শাজাহান ওমর, বরকতউল্লাহ বুলু, মো. শাজাহান, শামসুজ্জামান দুদু, অ্যাডভোকেট আহমেদ আজম খান, অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদিন, শওকত মাহমুদ, আমান উল্লাহ আমান, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, খায়রুল কবির খোকন, হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, হারুনুর রশিদ, আবুল খায়ের ভূঁইয়া, মুন্সী বজলুল বাছিত আনজু এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা শফিউল বারী বাবু, সুলতানা আহমেদ, আনোয়ার হোসাইন ও রাজীব আহসান প্রমুখ।