মারুফ হাসান ::

স্কচটেপ ও তার দিয়ে মোড়ানো একটি কৌটা। দূরে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে পুলিশ। কৌটাটি একটি বোমা বলে সকলের ধারণা। নাড়াচাড়া করলেই বিস্ফোরিত হবে; নাকি এমনিতেই ফাটবে তা নিয়ে আতঙ্কের শেষ নেই। এটি বোমা নাকি ভুয়া বোমা, তা পরীক্ষানিরীক্ষা করতে বিশেষজ্ঞদের অপেক্ষা চলছে। এভাবেই কেটে গেল দিন দুএক। বিশেষজ্ঞ দল এল। পরীক্ষা করল। জানা গেল, এটি বোমা নয়।
কথাগুলো নিছক গল্প নয়; বাস্তবে ঘটছে। সিলেটে কয়েকদিনের মধ্যে ঘটেছে এ রকম দুটি ঘটনা। অথচ সিলেট একটি বিভাগীয় ও গুরুত্বপূর্ণ মহানগর। কিন্তু এখানে বোমা পরীক্ষানিরীক্ষাকারী পূর্ণাঙ্গ টিম এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নেই। বিষয়টি বিস্ময়কর হলেও সত্য। সিলেটে বোমা শনাক্তকারী না থাকায় বোমার মতো কিছু দেখা মাত্রই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। যোগাযোগ করা হয় ঢাকায়। সেখান থেকে বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল এসে জিনিসটি কী, তা শনাক্ত করে। কিন্তু তাদের আসা পর্যন্ত থাকতে হয় আতঙ্ক নিয়ে।
সাম্প্রতিক সময়ে জঙ্গি তৎপরতা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জঙ্গিবিরোধী অভিযান নিয়ে সারা দেশে আলোচনায় রয়েছে সিলেট। বোমা সাদৃশ্যের বস্তু শনাক্তকরণে ঢাকা থেকে বিশেষজ্ঞ দল আনার বিষয় সুধী মহলে নানা কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে।
২৪ মার্চ দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ির আতিয়া মহলে পরিচালিত হয় ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’। জঙ্গি নির্মূলের জন্য টানা ১১১ ঘণ্টা চলে সেই অভিযান। সমাপ্তা ঘোষণার পর ভবনটি দেয়া হয় পুলিশের তত্ত্বাবধানে। তখন আতিয়া মহলে মারা যায় ৪ জঙ্গি। তাদের মধ্যে দু জনের লাশ বের করা সম্ভব হলেও অপর দুটি লাশ পড়ে থাকে। কেননা তাদের গায়ে শক্তিশালী বিস্ফোরক বাধা ছিল। সতর্কতার কারণে এবং ঢাকা থেকে বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল আসার অপেক্ষায় কেটে যায় পাঁচ দিন। ততক্ষণে লাশ দুটি পচে দুর্গন্ধ ছড়াতে থাকে শিববাড়ি এলাকায়।
৩০ মার্চ মৌলভীবাজারের দুটো বাড়িকে ঘিরে জঙ্গি অভিযান পরিচালনা করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অভিযানের নাম দেয়া হয় ‘অপারেশন হিটব্যাক’। সেখানেও বোমা ডিসপোজাল ইউনিট আসে ঢাকা থেকে।
এদিকে ৩০ মার্চ সিলেট নগরীর শাহি ঈদগাহে একটি দোকানের সামনে কালো রঙের বোমা সদৃশ বস্তুটি দেখতে পান দোকানি এনামুল হক। পুলিশ-র‌্যাব সদ্যরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। জননিরাপত্তার কারণে সেই এলাকা বেশ কিছু সময় ধরে ঘিরে রাখা হয়। পরে সেনাবাহিনীর বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল এসে পরীক্ষানিরীক্ষা করে জানায়, এটি বোমা নয়।
গত ২৫ এপ্রিল স্কলার্সহোম স্কুল অ্যান্ড কলেজের শাহি ঈদগাহ ক্যাম্পাসের মিলনায়তনের সিঁড়ির নিচে একটি শক্তিশালী বোমা থাকার খবরে নগরীর সর্বত্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ এবং র‌্যাব সদস্যরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। প্রায় ২৪ ঘন্টা পর ঢাকা থেকে র‌্যাবের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দল এসে পরীক্ষানিরীক্ষা করে জানায়, এটি কোনো বোমা নয়। ঐ প্রতিষ্ঠানের দশম শ্রেণির তিন ছাত্র নিছক তামাশা করার জন্য বোমার মতো পুঁটলি বেঁধে রাখে।
দেখা যাচ্ছে, সিলেটের যে-কোনো স্থানে বোমার মতো কিছু দেখা গেলে ঢাকা থেকে বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল আসতে হয়। এতে মনে হয় সিলেটে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে কি বোমা শনাক্তকরণ যন্ত্রপাতি নেই। নেই এ ব্যাপারে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কোনো দল।
সিলেট একটি বিভাগীয় ও গুরুত্বপূর্ণ মহানগর। বর্তমান পরিস্থিতিতে এখানে র‌্যাবের বোমা নিষ্ক্রিয়কারী এবং পুলিশের বিশেষায়িত বাহিনী সোয়াটের দলও থাকা একান্ত প্রয়োজন। কিন্তু তাদের না থাকা অত্যন্ত দুঃখজনক। এ সম্পর্কে সুধীসমাজের মতামত নেওয়া হয়।

বদর উদ্দিন আহমদ কামরান : আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও সিলেট সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র বদর উদ্দিন আহমদ কামরান বলেন, সারা দেশে ঘটনাগুলো ঘটছে। সত্যিকার অর্থে প্রত্যেক জায়গায় বোমা বিশেষজ্ঞ দল নেই। তাই সবাইকে ঢাকার দিকে তাকাতে হয়। তবে আমরা মনে করি, বিভাগীয় পর্যায়ে বোমা বিশেষজ্ঞ দল থাকা প্রয়োজন।
কামরান আরো বলেন, বড় আকারের না হলেও এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নিয়ে ছোট আকারের টিম থাকলে তাঁরাই প্রাথমিকভাবে বোমা সদৃশ্য বস্তু বোমা কি না তা যাচাই-বাছাই করতে পারবেন। পরে প্রয়োজন হলে ঢাকা থেকে টিম আসবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়টি সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করবেন বলে আশা করেন তিনি।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) জুবায়ের সিদ্দিকী : সিলেটে বোমা ডিসপোজাল ইউনিট থাকা উচিত কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে স্কলার্স হোমস স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) জুবায়ের সিদ্দিকী বলেন, অবশ্যই থাকা উচিত। কেননা যদি একটি সময় তিনটি স্থানে বোমা নিষ্ক্রিয় করার প্রয়োজন দেখা দেয়, তাহলে তাঁরা কী করবেন? এই কাজে ব্যবহৃত যে যন্ত্রপাতি আছে, তা সহজে বহনযোগ্য নয়। তাই স্থানীয় পর্যায়ে এই ব্যবস্থা থাকা খুবই প্রয়োজন। তিনি বলেন, আমার প্রতিষ্ঠানের এটি বোমা ছিল না। কিন্তু যদি এটি সত্যিকারের বোমা হতো এবং সময় দিয়ে নির্ধারণ করা থাকত, তাহলে ঢাকা থেকে টিম আসার আগেই একটি অঘটন ঘটে যেতে পারত।

র‌্যাব-৯ অধিনায়ক : বোমা নিষ্ক্রিয় কিংবা শনাক্ত করতে ঢাকা থেকে বিশেষ টিম আনতে হচ্ছে কেন? সিলেটে কি এই ব্যবস্থা নেই? এমন প্রশ্নের জবাবে র‌্যাব-৯ এর কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল আলী হায়দার আজাদ আহমদ বলেন, আমাদের কাছে একটি ব্যবস্থা আছে। কিন্তু আমাদের কাছে সব যন্ত্রপাতি নেই। তবে যেগুলো নিশ্চিত বোমা, সেগুলো শনাক্ত করতে আমাদের সমস্যা হয় না। আমরা অন্তত বোমাটা শনাক্ত করতে পারি এবং আমাদের সেই প্রশিক্ষিত দলও আছে। তাহলে স্কলার্স হোম স্কুল অ্যান্ড কলেজের ক্ষেত্রে কেন ঢাকা থেকে বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল আনতে হলো? এ প্রশ্নের জবাবে কর্নেল আজাদ বলেন, যেহেতু ঘটনাস্থল একটি স্কুল এবং স্পর্শকাতর এলাকা। তাই র‌্যাব সদর দপ্তর থেকে আমাদের ঝুঁকি নিতে বারণ করা হয়। সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত হওয়ার জন্যই ঢাকা থেকে টিম আসে।
র‌্যাবের কমান্ডিং অফিসার আরো জানান, র‌্যাব সদর দপ্তরে এ বিষয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা চলছে এবং কমান্ড লেভেলে একটি সিদ্ধান্তও হয়ে গেছে। কোথায় কোথায় লাগবে ও কি কি যন্ত্রপাতি লাগবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হলে খুব শীঘ্রই একটা ব্যবস্থা হবে।

এসএমপি কমিশনার : সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার গোলাম কিবরিয়া বলেন, এসএমপির বোমা নিষ্ক্রিয়কারী বিশেষজ্ঞ ছিলেন। আতিয়া মহলের পাশে বোমা বিস্ফোরণে তাঁরা মারা গেছেন। তবে এ বিষয়ে এসএমপিকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

লে. কর্নেল (অব.) সৈয়দ আলী আহমদ : বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ লে. কর্নেল (অব.) সৈয়দ আলী আহমদ বলেন, বোমা বিশেষজ্ঞ দল দেশে বিদেশে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একটি দল। সব স্থানে এটি দেওয়া সম্ভব নয়। এর সংখ্যা তুলনামূলক কম। কেন্দ্রীয়ভাবে এটি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। তবে সময়ের চাহিদা অনুযায়ী সেনানিবাসগুলোতে বোমা বিশেষজ্ঞদল রাখা যেতে পারে।

এমাদ উল্লাহ শহীদুল ইসলাম শাহীন : সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট এমাদ উল্লাহ শহীদুল ইসলাম শাহীন বলেন, বোমা নয় এমন একটি বস্তু পরীক্ষার জন্য ঢাকা থেকে বিশেষজ্ঞ দল নিয়ে আসা আমার কাছে সঠিক মনে হয়নি। আমার জানা মতে সিলেটে আইনশৃঙ্খলা রাক্ষাকারী বাহিনীর সদ্যদের মধ্যে বোমা শনাক্ত কিংবা নিষ্ক্রিয়কারী প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদল আছে। কিন্তু শাহি ঈদগাহে কেন ঢাকা থেকে টিম এল, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। যদি না থাকে, সেই ক্ষেত্রে সিলেটে এরকম টিম থাকা উচিত। সিলেটের আইনশৃঙ্খলা রাক্ষাকারী বাহিনীর যোগ্যতা এবং সামর্থ্য বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। শুধু বিভাগীয় পর্যায়ে নয়; প্রতিটি জেলায় বোমা শনাক্তকরণ প্রযুক্তি এবং প্রশিক্ষিত বোমা নিষ্ক্রিয়দল থাকা প্রয়োজন। তিনি আরো বলেন, সিলেটে দুটি সেনানিবাস রয়েছে। সেখানে বোমা নিষ্ক্রিয়করণে প্রশিক্ষিত দল আছে। প্রয়োজনে তাদের সহযোগিতা চাওয়া উচিত।

ইকরামুল কবীর : সিলেট প্রেসক্লাবের সভাপতি ইকরামুল কবীর এ সম্পর্কে বলেন, ঢাকা থেকে বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল সিলেটে আসতে অনেক সময় লাগে। এই সময় ক্ষেপণের মধ্যে দিয়ে যে কোনো বড় ধরণের দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। তাই স্থানীয় পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত প্রতিটি সংস্থার কাছে প্রশিক্ষিত দল এবং বোমা শনাক্তে উন্নত প্রযুক্তি থাকা উচিত।

ফারুক মাহমুদ চৌধুরী : সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল ঢাকায় থাকলেও সমস্যা নাই। তাদেরকে অত্যাধুনিক প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষিত হতে হবে এবং যে-কোনো স্থানে দ্রুত যাবার ব্যবস্থা থাকতে হবে। এই ক্ষেত্রে সরকার একটি কমান্ডো বাহিনীকে সব ধরনের প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রস্তুত রাখতে পারে। যাদের কাছে হেলিকপ্টারসহ সব ধরনের ব্যবস্থা থাকবে। হেলিকপ্টর হলে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছানো সম্ভব।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn