বৃটেনে তালিকাভুক্ত জঙ্গির সংখ্যা এক বছরে বেড়েছে ৩০ শতাংশ
বৃটিশ সরকারের টেরর ইউনিটে তালিকাভুক্ত সন্দেহভাজন কট্টর ডানপন্থি জঙ্গিদের সংখ্যা গত এক বছরে বেড়েছে ৩০ শতাংশ। বৃটিশ অনলাইন ইন্ডিপেন্ডেন্টের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। বৃটেনে কট্টরপন্থি ভাবাদর্শ উত্থানের পেছনে সরকারকে দায়ী করেছেন বিরোধী লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি। দলের নেতা টিম ফ্যারন বলেছেন, কনজারভেটিভ শাসকগোষ্ঠী মনোযোগ দিয়েছে ‘ইসলামিক মৌলবাদ’ নিয়ে। উপেক্ষা করে গেছে শ্বেতাঙ্গ জঙ্গিদের, যারা কিনা অন্য যে কোনো সন্ত্রাসীদের মতো একই রকম বিপজ্জনক ও বিকৃত মানসিকতার।
ইন্ডিপেন্ডেন্টের রিপোর্টে বলা হয়, উত্তর লন্ডনের এক মসজিদে সোমবার ভোরে ভ্যান চালিয়ে হামলা চালায় এক ব্যক্তি। এতে এক বাংলাদেশি মুসলিম নিহত হয়। মসজিদে চালানো এ হামলাকে সন্ত্রাসী কাজ হিসেবে বর্ণনা করেছে পুলিশ। হামলার পরই জানা যাচ্ছে বৃটিশ টেরর ইউনিটে সন্দেহভাজন কট্টরপন্থি হিসেবে তালিকাভুক্ত হওয়াদের সংখ্যা বেড়েছে নাটকীয়ভাবে। সোমবারের হামলায় সন্দেহভাজন ব্যক্তির পরিচয় প্রকাশ করেছে কর্তৃপক্ষ। ড্যারেন অসবর্ন (৪৭) নামের ওই ব্যক্তি কার্ডিফ নিবাসী। সন্ত্রাসী অপরাধ সংঘটন করার সন্দেহে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার বিরুদ্ধে হত্যা ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগ আনা হয়েছে। বর্তমানে সে পুলিশি হেফাজতে আছে। হামলায় ঘটনাস্থলেই মারা যান বাংলাদেশি মুসলিম মাকরাম আলী। আহত হন আরো ১১ জন। হামলাকারী নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে পরিচিত ছিল না। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনামতে হামলার সময় সে চিৎকার করে বলছিল, ‘আমি সকল মুসলিমকে হত্যা করবো।’ এর আগে অপমানসূচক আচরণ করছিল সে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারের সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ স্কিম সমালোচনার শিকার হয়েছে। অভিযোগ উঠছে, এতে একচেটিয়া ‘ইসলামিক টেররিজম’-এর ওপর মনোযোগ দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালীন এই স্কিম চালু করেছিলেন।
এই স্কিমের অধীনে ২০১৬/১৭ বছরে যাদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে তাদের এক-তৃতীয়াংশের কিছু কম কট্টর ডানপন্থি ভাবাদর্শে বিশ্বাসী। তারা উগ্রপন্থায় দীক্ষিত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অপ্রকাশিত পরিসংখ্যানে তেমনটাই বলা হয়েছে। ২০১৫-১৬ সময়ের তুলনায় এ সংখ্যা বেড়েছে ২৫ শতাংশ।
গেল বছর সন্ত্রাসবাদে সন্দেহভাজন হিসেবে রেকর্ডসংখ্যক শ্বেতাঙ্গ গ্রেপ্তার হওয়ার পর সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ স্কিমের আওতায় আসা কট্টরপন্থা সংক্রান্ত ঘটনার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। আনুষ্ঠানিক পরিসংখ্যান থেকে দেখা গেছে, সন্ত্রাসবাদে সন্দেহভাজন হিসেবে আটক হওয়া ২৬০ জনের মধ্যে ৯১ জন শ্বেতাঙ্গ। ২০১৫ সাল থেকে এ সংখ্যা ২০ বেশি। আর ২০০৩ সাল থেকে সর্বোচ্চ।
২০১৬ সালে সন্ত্রাস সম্পর্কিত সকল গ্রেপ্তারের মধ্যে শ্বেতাঙ্গ সন্দেহভাজন ৩৫ শতাংশ বা প্রতি তিনজনে একজন। ২০১৫ সালে ছিল ২৫ শতাংশ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যানে আরো দেখা গেছে, ২০০৯ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অধীনে পথরোধ করে তল্লাশি করা ব্যক্তিদের মধ্যে ৪১ ভাগ ছিল শ্বেতাঙ্গ।
এক বছর আগেই কট্টর ডানপন্থি সন্ত্রাসী থমাস মেয়ারের হাতে খুন হন বৃটিশ এমপি জো কক্স। এই সময়ের ব্যবধানে বৃটেনে কৃষ্ণাঙ্গ ও সংখ্যালঘু জাতিগত গ্রুপ ও ধর্মের বিরুদ্ধে ঘৃণাপ্রসূত অপরাধের সংখ্যা বেড়েছে নাটকীয়ভাবে।
লিব-ডেম নেতা টিম ফ্যারন বলেন, কট্টর ডানপন্থিদের উত্থান মোকাবিলায় সরকারের পদক্ষেপে ঘাটতিই সন্ত্রাসী হামলার ‘অনুকূল পরিবেশ’ তৈরি করেছে। তিনি আরো বলেন, ‘কনজারভেটিভ সরকারের কাছ থেকে যেসব বাগাড়ম্বর এসেছে তা ইসলামিক ফান্ডামেন্টালিজম নিয়ে। তারা শ্বেতাঙ্গ জঙ্গিদের ক্রমবর্ধমান হুমকিকে বহুলাংশে উপেক্ষা করেছে, যারা কিনা যে কোনো সন্ত্রাসীদের মতো একইরকম বিপজ্জনক এবং বিকৃত মানসিকতার।’ টিম ফ্যারন বলেন, ‘আমাদের বিভক্ত সম্প্রদায়গুলোকে একতাবদ্ধ করতে কিভাবে কাজ শুরু করা উচিত, তেরেসা মে আদৌ সেটা জানেন বলে আমার মনে হয় না। উন্মুক্ত, সহিষ্ণু ও একতাবদ্ধ হওয়ার পরিবর্তে তিনি বিভক্তি সৃষ্টি করে শাসনের রাজনীতি চর্চা করছেন। স্পষ্টত, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের দায় সন্ত্রাসীদের। কিন্তু এর অর্থ এটা নয় সরকার উন্নততর পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারবে না।’
মুসলিমবিরোধী বিদ্বেষ প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করা ‘টেল মামা’ নামক গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ফিয়াজ মুঘল বলেন, বৃটেনে কট্টর ডানপন্থিদের হুমকি শনাক্ত করতে ‘নিয়মতান্ত্রিকভাবে ব্যর্থতা’ রয়েছে। তিনি আরো বলেন, ‘এ ইস্যুকে সত্যিকার অর্থে মোকাবিলা করতে বিচারক, সরকার এবং পুলিশের পদক্ষেপ নেয়ার সময় এসেছে। মেনে নেয়ার সময় এসেছে যে এটা শুধু বাকস্বাধীনতা নয়। আমরা জানতাম এই পরিবেশ আসন্ন ছিল। আমি আপনাকে দু’বছর আগেই বলতে পারতাম একসময় হামলার শিকার হবে একটি মসজিদ। হামলার সময় বেছে নেয়া হবে রমজান। আমরা এটা জানতাম। আর আমরা এই হুমকিকে আরো গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নেয়ার জন্য লবিং করেছি, চাপ দিয়েছি।’
ছায়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ডায়ান অ্যাবট বলেন, প্রতিরোধ স্কিমকে এখন পুরোপুরি ঢেলে সাজাতে হবে। তিনি বলেন, ‘সন্ত্রাসবাদ আমাদের প্রত্যেকের ওপর প্রভাব ফেলে। সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ কার্যকর হতে হলে আমাদের প্রত্যেকের সমর্থন প্রয়োজন। এর অর্থ হলো কার্যকর গোয়েন্দা তৎপরতা। এর অর্থ এটাও যে, আমাদের অভিন্ন শত্রু, সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সকল সম্প্রদায়কে একতাবদ্ধ করা।’