ব্রিটিশ নির্বাচনে এবার হচ্ছে ব্যক্তিত্বের লড়াই, টেরেজা মে বনাম জেরেমি করবিন
ব্রিটিশ নির্বাচনের কয়েকটি বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে, যেমন অভিবাসন, সমাজ কল্যাণ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাবার বিষয় বা ব্রেক্সিট। কিন্তু সব কিছুর মূলেই হচ্ছে অর্থনীতি। লন্ডনে রাজনৈতিক বিশ্লেষক দিয়া চক্রবর্তীর মতে, মানুষ যখন ব্রিটিশ নির্বাচনে ভোট দিতে যাবেন তখন তারা যাচাই করবেন কোন্ দলের নীতি তাদের আয় অর্থাৎ তাদের পকেটের ওপর কী ধরণের প্রভাব ফেলবে। ”অনেক নীতিই শুনতে ভাল লাগে এবং মনে হয় হ্যাঁ, এটাই দরকার। কিন্তু সেই নীতি বাস্তবায়ন করতে গেলে যে অর্থ লাগবে সেটা কোথা থেকে আসবে, কর বাড়বে কি না, এ’সব কথা লোকজন ভোট দেয়ার সময় ভাবেন,” বলছেন লন্ডনে দ্য ট্যাক্স পেয়ার্স অ্যালায়েন্স-এর রাজনৈতিক পরিচালক দিয়া চক্রবর্তী। কিন্তু তারপরও, এবারের নির্বাচনে একটি ভিন্ন মাত্রা লক্ষ করছেন মিজ চক্রবর্তী। আমেরিকা বা ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতির নির্বাচনে ব্যক্তির ভাবমূর্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ব্রিটেনে সাধারণত নেতার চেয়ে দলের গুরুত্ব বেশি থাকে।
কিন্তু এবারে ব্যতিক্রম। প্রচারণা হচ্ছে দুই প্রধান দলের নেতাদের ঘিরে – ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ দলের টেরেজা মে আর লেবার পার্টির জেরেমি করবিন। ”এবারে প্রথম থেকেই আমরা দেখেছি নির্বাচনটা অনেকটা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মত হয়ে গিয়েছে। হয় টেরেজা মে না হয় জেরেমি করবিন। সেক্ষেত্রে আমরা নতুন ধারা দেখতে পারছি, যেখানে চরিত্রটা দলের চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে,” বলেন দিয়া চক্রবর্তী।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক দিয়া চক্রবর্তীর মতে, ব্রিটিশ নির্বাচনে মানুষ অর্থনীতির ওপর জোর দেয় ব্রিটেনের ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন বা ইইউ থেকে বের হয়ে যাবার সিদ্ধান্ত ‘ব্রেক্সিট’ নামে পরিচিত এবং সেই ব্রেক্সিটের কারণে অভিবাসন ব্রিটিশ নির্বাচনে বড় ইস্যু হয়ে উঠেছে। ব্রিটেনের সাধারণ মানুষদের অনেকে মনে করেন, দেশের সীমান্তের নিয়ন্ত্রণ লন্ডনের হাতে আর নেই, সেটা চলে গেছে ব্রাসেলসে ইইউ সদর দপ্তরে। দিয়া চক্রবর্তী বলছেন, অভিবাসন ইস্যু হয়েছে, যেহেতু এখানে দেশের সার্বভৌমত্বের বিষয় জড়িত। ”যেটা দেখা গেছে, কিছু কিছু এলাকায় ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে অবাধ অভিবাসন হবার কারণে হয়তো অভিবাসন-বিরোধী একটি মনোভাব তৈরি হয়েছে এবং কিছু কিছু রাজনীতিক সেই সেন্টিমেন্টকে ব্যবহারও করেছে, যেটা আমরা দেখেছি,” মিজ চক্রবর্তী বিবিসি বাংলাকে বলেন। দিয়া চক্রবর্তী মনে করেন যে, ব্রেক্সিট চুক্তিতে যদি ব্রিটেন সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করার পুরো ক্ষমতা ফিরে না পায়, তাহলে সেই ব্রেক্সিট চুক্তি জনগণ গ্রহণ করবে না। ব্রেক্সিট গণভোটে দক্ষিণপন্থী, অভিবাসন-বিরোধী দল ইউনাইটেড কিংডম ইন্ডিপেন্ডেন্স পার্টি বা ইউকিপ জোরালো ভূমিকা পালন করে। কিন্তু এই সাধারণ নির্বাচনে তাদের সমর্থন অনেকটা কমে গেছে বলেই মনে হচ্ছে। প্রধান দুই দল – কনজারভেটিভ এবং লেবার পার্টির বহু সমর্থক ব্রেক্সিট প্রশ্নে ইউকিপের দিকে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু দিয়া চক্রবর্তীর মতে, এসব সমর্থক আবার নিজ নিজ দলে ফিরে আসছেন। কিন্তু তারপরও, অভিবাসন ইস্যুটা ঘুরে-ফিরে নির্বাচনে আসছে কারণ সীমান্ত কে নিয়ন্ত্রণ করবে, সেটা ভোটারদের কাছে বড় বিষয়।
ব্রেক্সিট কেমন হবে তা নিয়ে বড় দুটো দল ভিন্ন অবস্থান নিয়েছে। ”কনজারভেটিভরা বলছে, খারাপ চুক্তির চেয়ে কোন চুক্তি না করাই ভাল। কিন্তু লেবার বলছে, কোন চুক্তি না করাই হবে সব চেয়ে খারাপ চুক্তি,” মিজ চক্রবর্তী বলেন। ”লেবার নেতা জেরেমি করবিন ইইউ-র সাথে একটি চুক্তি সম্পন্ন করার আশা রাখছেন। তিনি অবাধ যাতায়াতের কথা বলছেন না, কিন্তু কাস্টমস ইউনিয়নের কথা রয়ে যাচ্ছে,” মিজ চক্রবর্তী বলেন। লেবার পার্টি ব্রেক্সিট মেনে নিলেও তারা চাইছে ইইউ-র সাথে আলোচনার মাধ্যমে ইউরোপের অভিন্ন বাজারে রয়ে যেতে, যাতে ব্রিটিশ পণ্য শুল্ক ছাড়াই ইউরোপে রফতানি করা যায়। তবে নির্বাচন প্রচারণায় লেবার পার্টি ব্রেক্সিট নিয়ে খুব বেশি কথা বলছেনা। তারা জোর দিচ্ছে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বিষয়ে তাদের কর্মসূচি এবং, তাদের দৃষ্টিতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী টেরেজা মে’র ব্যর্থতার ওপর। কিন্তু তারপরও, জনমত জরিপে দেখা যাচ্ছে যত দিন যাচ্ছে লেবার ততই ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভদের কাছে চলে আসছে। এটা কী করে হচ্ছে? দিয়া চক্রবর্তী বলছেন, কনজারভেটিভদের এবারকার স্লোগান হচ্ছে ‘শক্তিশালী এবং স্থিতিশীল সরকার’। জনমত জরিপ থেকে তারা ধারণা করছে, দলের চেয়ে প্রধানমন্ত্রী টেরেজা মে বেশি জনপ্রিয়। অন্যদিকে, লেবারের চিত্র ভিন্ন। সেখানে দল যত জনপ্রিয়, দলের নেতা মি: করবিন তত জনপ্রিয় নন।
ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে তরুণদের ক্ষেত্রে। তরুণদের মাঝে মি: করবিনের ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। তবে সেটা কাজে নাও লাগতে পারে বলে দিয়া চক্রবর্তী সমনে করেন। ”জেরেমি করবিন তরুণদের মাঝে বরাবরই জনপ্রিয়, কিন্তু দেখার বিষয় হচ্ছে তরুণদের কতজন ভোট দিতে আসবে,” বলছেন মিজ চক্রবর্তী। ”অতীতের সকল নির্বাচনে আমরা দেখেছি তরুণদের চাইতে অবসরপ্রাপ্ত মানুষরা অনেক বেশি সংখ্যায় ভোট দিতে আসেন,” তিনি বলেন। মিসেস মে যখন নির্বাচন ডাকেন তখন জনমত জরিপে কনজারভেটিভরা লেবার থেকে প্রায় ২০ পয়েন্ট এগিয়ে ছিল। কিন্তু এখন সেটা কমে মাত্র ৫-৬ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। দিয়া চক্রবর্তীর মতে, সেটার কয়েকটি কারণ আছে।
প্রথমত, ভোটাররা সমাজ কল্যাণ খাতে কনজারভেটিভদের নীতি ভাল ভাবে নিতে পারেনি, বিশেষ করে অবসরপ্রাপ্ত পেনসনভোগীরা। তাদের নির্বাচন ম্যানিফেস্টোতে প্রবীণ লোকজনকে দেখাশোনার খরচ তাদেরকেই বহন করার প্রস্তাব ছিল, যদি তাদের নির্দিষ্ট অঙ্কের সম্পত্তি থাকে। লেবার এটাকে ‘ডেমেনশিয়া কর’ বলে অভিহিত করেছে। কিন্তু মিজ চক্রবর্তীর মতে, তার চেয়েও বেশি ক্ষতি করেছে মিসেস মে’র ‘ডিগবাজী’। ”বিতর্ক ওটার পরের দিনই তিনি ডিগবাজি দিয়ে ঘোষণা করলেন এটার ক্যাপ বা সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে দেয়া হবে। এই ডিগবাজির ফলে অনেকেই প্রশ্ন করছেন, তার কাছ থেকে কি আদৌ শক্তিশালী এবং স্থিতিশীল নেতৃত্ব পাওয়া যাবে, যেটা তিনি জোর গলায় বলছেন,” বলেন মিজ চক্রবর্তী।