পুরুষের জন্য অল্প-বয়সী নারী, আর নারীর জন্য বেশি-বয়সী পুরুষ, বৈষম্যটা উৎকট
তসলিমা নাসরিন- মনে আছে ‘যব হ্যারি মেট সিজাল’ ছবিটির কথা? অভিনয় করেছেন শাহরুখ খান আর আনুশকা শর্মা। শাহরুখ খান আনুশকা শর্মার বাবা বা কাকার ভূমিকায় অভিনয় করেননি। করেছেন প্রেমিকের ভূমিকায়। ভাবছিলাম, পঞ্চাশোর্ধ্ব পুরুষেরা এখনও সিনেমায় নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করতে পারছেন! নায়কদের বয়স বেশি হলে ক্ষতি নেই, কিন্তু নায়িকাদের বয়স কম হতে হবে। শাহরুখের বয়স ৫৩। আর আনুশকা শর্মার বয়স ২৯। আচ্ছা, এরকম কি হতে পারতো নায়িকার বয়স ৫৩, নায়কের বয়স ২৯?
আমরা আরও বয়স্ক লোকের সঙ্গে অল্প বয়সী মেয়েদের নায়িকা হতে দেখেছি। ‘চিনি কম’ চলচ্চিত্রে অমিতাভ বচ্চনের প্রেমিকা টাবু, আর ‘নিঃশব্দ’-এ জিয়া খান। ২০০৭ সালে তৈরি নিঃশব্দে নায়কের বয়স ছিল ৬৫, আর নায়িকার বয়স ছিল ১৯। দক্ষিণ ভারতের চলচ্চিত্রে নায়ক নায়িকার বয়সের পার্থক্য প্রচুর। লিঙ্গ ছবিতে রজনীকান্ত’র বয়স ৬৩, আর সোনাক্ষি সিনহার ২৭। শ্রীদেবীর বয়স ১৬/১৭/১৮ ছিল যখন তিনি প্রায় ষাট বছর বয়সী নায়কদের বিপরীতে নায়িকা হতেন। অসম বয়সীদের জোট বাঁধা সে কি আজ থেকে! বলিউডে আমির খান, সালমান খান, শাহরুখ খান সবার বয়সই পঞ্চাশের ওপর। কিন্তু তাদের জনপ্রিয়তা এখনও লোপ পায়নি। মাধুরীকে চলে যেতে হয়, রেখাকে বসে যেতে হয়। প্রীতি জিনতা, জুহি চাওলা, কাজল, রানী সবাইকেই হারিয়ে যেতে হয়, যদিও তাদের বয়স শাহরুখদের বয়সের চেয়ে অনেক কম।
বাংলা ছবিতে প্রসেনজিৎ এখনও নায়ক। নায়িকার ভূমিকায় যাঁরা তাঁর সঙ্গে অভিনয় করতেন, তাঁরা এখন মা মাসির চরিত্রে অভিনয় করেন। প্রসেনজিৎ এখনও কচি কচি মেয়েদের প্রেমিক হচ্ছেন। ভারতীয় উপমহাদেশের সমাজেও এই ব্যাপারটি ঘটতে দেখি। বেশি-বয়সের পুরুষ অল্প-বয়সী মেয়ের সঙ্গে প্রেম করতে চায়, ওদের বিয়ে করতে চায়, কিশোরীদের সঙ্গে শুতে চায়। সমাজ থেকে সিনেমা শেখে, নাকি সিনেমা থেকে সমাজ শেখে! সম্ভবত দুটোই পরস্পরের কাছ থেকে শেখে। পুরুষ বয়স্ক হলেও তুলনায় কম-বয়সী মেয়েদের কামনা করে। শিশুপর্নে ছেয়ে গেছে ইন্টারনেট। পুরুষদের মধ্যে অনেকেই শিশুদের সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক করতে চায়। যদি একান্তই না সম্ভব হয়, তাহলে ইন্টারনেটের পর্ন তাদের ভরসা। শিশুপর্ন দেখে তারা আহ্লাদ মেটায়। শিশুকামী পুরুষের কারণে শিশুপর্ন বাড়ছে, নাকি শিশুপর্ন বাড়ার কারণে শিশুকামী বাড়ছে!
সমাজে যদি বেশি বয়সের কোনও মেয়ের সঙ্গে কম-বয়সী ছেলের সম্পর্ক গড়ে ওঠে, পাড়ায় ঢি ঢি পড়ে যায়। মেয়েটির চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে সক্কলে। কোনও সিনেমায় বেশি বয়সী নায়িকা আর কম বয়সী নায়ক থাকলে সেই সিনেমার সম্ভবত ব্যবসা লাটে ওঠে। একটা জরিপে দেখা গেছে, পুরুষরা, তাদের বয়স যাই হোক না কেন, ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী মেয়েদের পছন্দ করে। আর মেয়েদের পছন্দ কী? ৩০-এর আগ অবধি মেয়েরা সমবয়সী অথবা সামান্য বড় পুরুষ-সঙ্গী চায়। কিন্তু চল্লিশে এসে বয়সে দু-তিন বছরের ছোট পুরুষ-সঙ্গী কামনা করে। কিন্তু মেয়েদের পছন্দের তোয়াক্কা কে কবে করেছে!
সমাজের চিত্র দেখে দেখে আমরা ধারণা করেই নিয়েছি যে বয়স্ক পুরুষদের অল্প-বয়সী মেয়েদের ভালো লাগতেই পারে, তাদের তারা কামনা করতেই পারে, তাদের বিয়েও করতে পারে। কিন্তু মেয়েদের সব সময় বেশি-বয়সের পুরুষদের প্রেমে পড়া উচিত, বিয়ে করলে তাদেরই বিয়ে করা উচিত। দু-বছরের বড় হোক বা কুড়ি বছরের বড় হোক, কিন্তু পুরুষকে বড় হতেই হবে। ছোট হলে চলবে না। কিন্তু বয়সে ছোট পুরুষদের সঙ্গে যে মেয়েদের সম্পর্ক একেবারে হচ্ছে না, তা নয়। তবে সংখ্যায় অতি সামান্য। থিয়েটার জগতের সুবর্ণা সৌদ বিয়ে করেছে বয়সের বিস্তর ব্যবধান নিয়ে। কিন্তু এই অঞ্চলে এরকম ঘটনা সম্ভবত কোটিতে একটি। মানুষ নানা রকম যুক্তি বের করেছে বেশি-বয়সের পুরুষ আর কম-বয়সী মেয়েদের সম্পর্কের ইতিবাচক দিক নিয়ে। বিবর্তনবাদের প্রসঙ্গ টেনে এনে ওসব দুর্বল এবং অর্থহীন যুক্তি হাওয়ায় উড়ে যাবে যদি সত্যি কথা স্পষ্ট করে বলো। বয়স বাড়লে মেয়েদের রজোনিবৃত্তি ঘটে, রজোনিবৃত্তি যৌন অক্ষমতা নয়, রজোনিবৃত্তিতে গর্ভবতী হওয়া যায় না, এটুকুই। আজকাল এক সন্তান, বড়জোর দু’সন্তান অথবা সন্তানহীন দাম্পত্যের যুগে, বেশি-বয়সে, সে পুরুষ হোক নারী হোকÑ সন্তান জন্ম দিতে কেউ রাজি নয়। সুতরাং রজোনিবৃত্তি কোনও সমস্যা নয়। রজোনিবৃত্তি যৌনতা উপভোগে কোনও বাধা সৃষ্টি করে না। উপভোগের জন্য নানা রকম কায়দাও আজকাল বেরিয়েছে। যত আধুনিক হচ্ছে মানুষ, যত সভ্য হচ্ছে, তত মেয়েদের পৃথক অস্তিত্ব স্বীকার করছে, তত মেয়েদের ব্যক্তিত্বকে সম্মান জানাচ্ছে, তত তাদের শরীরের স্বাধীনতাকে মূল্য দিচ্ছে। ওদিকে পুরুষের শুক্রাণু সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। বয়স বাড়লে পুরুষেরা যৌন অক্ষমতায় ভোগে। আজকাল পুরুষের যৌন অক্ষমতা সাময়িকভাবে রোধ করার জন্য ওষুধপত্র বাজারে এসেছে, সুতরাং নারীর জন্য যেমন উপভোগ করা সম্ভব, পুরুষের জন্যও তেমন।
পুরুষেরা সব বয়সে ফিট, মেয়েরা শুধু কুড়ির ঘরে এলেই ফিট- এই তথ্যটি সম্পূর্ণ ভুল তথ্য। পুরুষেরা সব বয়সে ফিট নয়। সত্যি কথা হলো, মেয়েদের চেয়ে অনেক কম বয়সে আনফিট হয়ে যায় পুরুষ। তারপরও পুরুষ নিজের কন্যার বয়সী মেয়ের দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকায়। ৬০ বছর বয়সী পুরুষ যদি ২০ বছর বয়সী মেয়ের জন্য আকর্ষণ অনুভব করতে পারে, ৬০ বছর বয়সী নারীও কিন্তু ২০ বছর বয়সী পুরুষের জন্য আকর্ষণ অনুভব করতে পারে। পুরুষের আকর্ষণের কথা প্রচার হয়, নারীর আকর্ষণের কথা প্রচার হয় না। নারী কিন্তু নিজের পুত্রের বয়সী ছেলের দিকে লোলুপ দৃষ্টি দেয় না, দিলেও কন্যার বয়সী মেয়েদের দিকে পুরুষ যা দেয়, তার তুলনায় অনেক কম। এটি মনের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, এটি সমাজের সঙ্গে সম্পর্কিত। যত সহজে হুমায়ূন আহমেদ নিজের কন্যার বয়সী মেয়েকে বিয়ে করে সমাজে মানসম্মান এবং জনপ্রিয়তা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারেন, তত সহজে জনপ্রিয় কোনও নারী তাঁর পুত্রের বয়সী কোনও ছেলেকে বিয়ে করে একই রকম মানসম্মান এবং জনপ্রিয়তা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারেন না। পুরুষ যেহেতু সমাজের উঁচু স্থানে বসে আছে, যেহেতু পুরুষতান্ত্রিক সমাজটা এখনও তারা চালাচ্ছে এবং এর বিরুদ্ধে কোথাও কোনও আন্দোলন নেই কিছু নেই, পুরুষ যা ইচ্ছে হচ্ছে তাই করছে। নারীর যা ইচ্ছে করে, তা করার নিয়ম পুরুষের দুনিয়ায় নেই। নারী ততটুকু করতে পারে, ততটুকু চলতে পারে, ততটুকু বলতে পারে, ততটুকু ভাবতে পারে- যতটুকু পুরুষ তাকে অ্যালাউ করে।
শিশুদের শৈশব এবং কিশোর-কিশোরীদের তাদের কৈশোর উপভোগ করতে দেওয়া উচিত। তাদের দিকে যৌনতার হাত বাড়ানো নারী পুরুষ কারও উচিত নয়। প্রাপ্তবয়স্ক নারী পুরুষ তাদের পছন্দমতো সঙ্গী বাছাই করবেন, বয়সের পার্থক্য তাতে থাকতেই পারে, তবে পুরুষের জন্য অল্প-বয়সী নারী চাই, আর নারীর জন্য বেশি-বয়সী পুরুষ চাই, এই বৈষম্য খুব উৎকট। এটি ঘোচাতে হবে। ঘোচাতে হলে শিল্পে সাহিত্যে সিনেমা থিয়েটারেও বৈষম্য ঘোচাতে হবে। মানুষ যা দেখে, তা শেখে। বৈষম্যহীন সমাজ তো আকাশ থেকে পড়বে না, ধীরে ধীরে একে নির্মাণ করতে হবে। নারী পুরুষ উভয়ের দায়িত্ব এই সমাজটি তৈরি করা। বয়স খুব বড় ব্যাপার নয়, আবার বড় ব্যাপারও। নারী পুরুষের মধ্যে হাজারো বৈষম্য, বয়স একটি। লেখক : নির্বাসিত লেখিকা-(বাংলাদেশ প্রতিদিন এর সৌজন্যে)