ভোট ছাড়াই ঢাবি সিনেটে ভিসি প্যানেল চূড়ান্ত
এই নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে আদালতেও গিয়েছিলেন বেশ কয়েকজন শিক্ষক, তাতে হাই কোর্ট সিনেটের এই অধিবেশন স্থগিত করে আদেশ দিয়েছিল। কিন্তু হাই কোর্টের আদেশ আপিল বিভাগ স্থগিত করার পর এই নির্বাচনের বাধা কেটে যায়। এখন সিনেটে মনোনীত তিনজনের নাম যাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছে। তার মধ্য থেকে একজনকে উপাচার্য পদে নিয়োগ দেবেন তিনি। ভোটাভুটি হলে সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া তিনজনের নামের প্রস্তাব যেত রাষ্ট্রপতির কাছে। অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিকের বর্তমান মেয়াদ শেষের (২৪ অাগস্ট) আগে সিনেটে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু রেজিস্ট্রার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি নির্ধারণ না করে সিনেটে উপাচার্য প্যানেল মনোনয়নের এই উদ্যোগ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্য থেকেই।
কয়েকজন শিক্ষকসহ ১৫ জন রেজিস্ট্রার্ড গ্র্যাজুয়েট এই সভা আটকাতে হাই কোর্টে রিট আবেদন করে স্থগিতাদেশও পেয়েছিলেন। কিন্তু আপিল বিভাগের আদেশে সভার পথ খুলে যায়। ১০৫ সদস্যের সিনেটের অর্ধেকের মতো সদস্য শনিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী ভবনে সভায় বসেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, দুজন উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ, সরকার মনোনীত পাঁচজন সরকারি কর্মকর্তা, স্পিকার মনোনীত পাঁচজন সংসদ সদস্য, আচার্য মনোনীত পাঁচজন শিক্ষাবিদ, সিন্ডিকেট মনোনীত গবেষণা সংস্থার পাঁচজন প্রতিনিধি, অধিভুক্ত কলেজগুলোর পাঁচজন অধ্যক্ষ, ১০ জন শিক্ষক প্রতিনিধি, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান, ৩৫ জন শিক্ষক প্রতিনিধি, ২৫ জন রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি ও পাঁচজন শিক্ষার্থী প্রতিনিধি থাকেন সিনেটে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান জানান, বর্তমানে ৫০ জন সিনেট সদস্য নেই। সিন্ডিকেট মনোনীত গবেষণা সংস্থার পাঁচজন প্রতিনিধি, অধিভুক্ত কলেজগুলোর পাঁচজন অধ্যক্ষ ও ১০ জন শিক্ষক প্রতিনিধি, ২৫ জন রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি ও পাঁচজন ছাত্র প্রতিনিধি বর্তমান সিনেটে নেই। একে ‘খণ্ডিত সিনেট’ আখ্যায়িত করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নীল দলের সাদেকা হালিম, যিনি রেজিস্ট্রার্ড গ্র্যাজুয়েট হিসেবে হাই কোর্টে রিট আবেদন করেছিলেন। সাদেকা হালিম বলেন, এতে গণতান্ত্রিক চর্চার ব্যত্যয় ঘটেছে। এই উপাচার্য তড়িঘড়ি করে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করলেন। সিনেটের শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচনের পর রেজিস্ট্রার গ্র্যাজুয়েট নির্বাচন দিতে পারতেন? তিনি দেননি, কারণ তিনি আবার উপাচার্য পদে বহাল থাকতে চাচ্ছেন।
নীল দলের সাবেক আহ্বায়ক মুহাম্মদ সামাদ বলেন, অসম্পূর্ণ সিনেটের মধ্য দিয়ে উপাচার্য প্যানেল মনোনয়ন করা হলে সেটি কখনোই বৈধ হবে না। এ নির্বাচন জাতির পিতার দেওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশের লঙ্ঘন। এজন্য আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার কথাও বলেন আওয়ামী লীগ সমর্থক শিক্ষকদের নেতা সামাদ, যিনিও রিট আবেদনকারীদের মধ্যে রয়েছেন। নীল দলের শিক্ষকদের মধ্যে বিরোধে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করে সাদেকা হালিম বলেন, এই মতবিরোধ হয়ত থাকবে কেটে যাবে। আমরা নিজের ঘরের মধ্যে নিজের পরিষ্কার করতে চাচ্ছি যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ নিজের সুবিধার জন্য ব্যবহার করতে পারি না।
২৫ জন নির্বাচিত গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধিসহ ৫০ জন প্রতিনিধি না থাকায় উপাচার্য প্যানেল মনোনয়নে সিনেট অধিবেশন বর্জনের ঘোষণা দিয়ে শুক্রবার সংবাদ সম্মেলন করেন বিএনপি-জামায়াত সমর্থক শিক্ষকদের সাদা দল। সাদা দলের আহ্বায়ক অধ্যাপক মো. আখতার হোসেন খান বলেন, যথাসময়ে রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি নির্বাচন না করে এবং অন্যান্য সদস্য পদ খালি রেখে সিনেটকে অনেকাংশেই অকার্যকর করে ফেলা হয়েছে। ফলে এ অকার্যকর সিনেট দিয়ে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন সম্পন্ন করার প্রক্রিয়া নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি অংশ ছাত্র প্রতিনিধি ছাড়া সিনেট অধিবেশনের বিরোধিতা করে আসছেন। ডাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে ছাত্র প্রতিনিধি নির্ধারণ করে সিনেটে উপাচার্য প্যানেল মনোনয়নের দাবিতে শনিবার সিনেট ভবনের সামনে বিক্ষোভ করেন তারা। এসব অভিযোগের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ অনুসারেই সিনেটে উপাচার্য প্যানেল মনোনয়নের অধিবেশন ডাকা হয়।
খণ্ডিত সিনেটের অভিযোগের প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের মতো আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট, কিছু সদস্য চলে গেলেও সিনেট চলমান থাকে। অর্থাৎ সিনেটের কোনো ক্যাটাগরি অসম্পূর্ণ থাকলেও পুরো সিনেট অকার্যর হবে, এমন নয়। সিনেট সব সময় কার্যকর থাকবে।
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে হাতাহাতি শিক্ষকদের
ছাত্র প্রতিনিধিদের বাদ রেখে সভা ডাকায় সিনেট ভবনের সামনে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকদের হাতাহাতি হয়েছে। ডাকসু নির্বাচন দিয়ে শিক্ষার্থী প্রতিনিধি নির্ধারণ করে সিনেটে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের দাবিতে বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর বিক্ষোভের কর্মসূচি ছিল। তারা বিকাল ৩টার দিকে অপরাজেয় বাংলা থেকে মিছিল শুরু করে মল চত্বর ঘুরে সিনেট ভবনের ফটকের সামনে অবস্থান নেয়। তাদের হাতে ছিল ‘ডাকসু ছাড়া ভিসি নির্বাচন মানি না, মানবো না’, ‘সিনেটে ছাত্র প্রতিনিধি চাই’, ‘অবৈধ ভিসি প্যানেল মানি না’সহ বিভিন্ন দাবি সম্বলিত প্ল্যাকার্ড। সিনেট সভার কারণে বন্ধ করে রাখা ফটক খুলে মিছিলকারীরা সভাস্থলের দিকে এগোলে শিক্ষকরা বাধা দেন। তখন দুই পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি বেঁধে যায় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান।
এসময় মিছিলকারী একজন শিক্ষকদের ধাক্কায় পড়ে যান, আহত হন কয়েকজন। অন্য দিকে দুই শিক্ষক আহত হন। তারা হলেন ফার্মেসি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আব্দুল মুহিত এবং এমআইএস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রাকিবুল হক। তারা দুজনই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন। আহত ছাত্ররা হলেন- ছাত্র ফেডারেশনের সাদিক রেজা, নাসির আব্দুল্লাহ, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সালমান ফার্সি, সাদিকুল ইসলাম, মর্ম তমা এবং আবু রায়হান। শিক্ষকদের ‘হামলায়’ ছয়জন আহত হন বলে দাবি করেছেন ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি বেনজির আহমেদ। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক আমজাদ আলী বলেন, ছাত্রদের শুরুতে বলেছি গেইটের বাইরে তাদের কর্মসূচি পালন করতে, কিন্তু তারা গেইট ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করতে গেলে শিক্ষকরা সামনে দাঁড়ায়। তারা শিক্ষকদের ধাক্কা দিলে শিক্ষক তাদের ধাক্কা দেয়। ঘটনার জন্য শিক্ষার্থীদের দায়ী করে বলেন, ছাত্ররা যে শিক্ষকদের লাথি-ঘুষি মারছে, সেটি আমরা বলতে চাই না। তাদের আচরণ অসৌজন্যমূলক ছিল। তাদেরকে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করার সুযোগ দিলেও তারা শিক্ষকদের উপর হামলা চালিয়েছে।