মন্তব্য প্রতিবেদনঃ খাম্বা গ্রুপ এবং পীর হাবিব
সুজাত মনসুর-
গত কয়েকদিন আগে পীর হাবিবের একটা লেখা দেখেছিলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনে, খাম্বা বিষয়ক। পীর হাবিব নিয়মিত কলামিস্ট এবং একজন পেশাদার সিনিয়র সাংবাদিক। বাংলাদেশে সাংবাদিকতায় উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে এক সময়ের ফকিরের পেশা সাংবাদিকতায় খুব কমই যুক্ত হতেন এবং এখনো কমই আছেন বলে আমার ধারণা। এমনকি এখন অধিংকাংশ পত্রিকার সম্পাদকই পেশায় ব্যবসায়ী। কি আর করা, যুগের হাওয়া। সিলেটে আমার জানামতে আরেকজন সাংবাদিক ছিলেন যিনি সাংবাদিকতায় মাস্টার্স করেছিলেন, তিনি প্রয়াত মহিউদ্দিন শীরু, যার হাত ধরে আমার সাংবাদিকতার শুরু। পীর হাবিবকে আমি চিনি-জানি ৭৯ সাল থেকে যখন পঁচাত্তর পরবর্তী বৈরি সময়ে আমরা সুনামগঞ্জ অঞ্চলে ছাত্রলীগকে পুনর্গঠিত করি। সে সময় আমাদের নেতা ছিলেন তার বড় ভাই মতউর রহমান পীর। দিরাই থেকে সাংগঠনিক কাজে সুনামগঞ্জ গেলে তাদের বাড়িতেই থাকা-খাওয়া। বলতে গেলে ওদের পরিবারের সদস্যই হয়ে গিয়েছিলাম। পীর হাবিব তখন সম্ভবতঃ নবম শ্রেনীর ছাত্র এবং ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী।
সম্ভবতঃ সে আমাদের পরে সুনামগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হয়েছিল। আমার ধারণা ছিলো পীর হাবিব ছাত্ররাজনীতি শেষে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত হবে এবং রাজনীতিকে জীবনের পথেয় বলে বেছে নেবে, কিন্তু সে তা হয়নি। তবে রাজনৈতিক কলামিস্ট হয়েছে। তার লেখায় প্রচন্ড ধার আছে। শুধু কলামিস্ট হিসেবে নয়, সাম্প্রতিককালের জনপ্রিয় টিভি শো, টকশোতেও সমান পারদর্শী, প্রতিপক্ষের সাথে লড়ে যেতে পারেন পাল্লা দিয়ে। তার সব লেখা কিংবা সব কথাই যে আমার ভালো লাগে তা কিন্তু নয়। মাঝেমাঝেই মনে হয় প্রতিবাদ করি, একবার করেছিও কিন্তু অশালীন ছিলাম না। তাতে করে আমাদের বড়ভাই-ছোটভাই সম্পর্কের মধ্যে কোন ধরনের ছিড় ধরেনি।
খাম্বাকে নিয়ে লেখাও আমার কাছে প্রয়োজনীয় নয় বলেই মনে হয়েছে। অনেক সময় অনেকেই আমাকে বলেছেন খাম্বাকে নিয়ে লেখার জন্য কিন্তু আমি আগ্রহবোধ করিনি। কেননা, আমার বিবেচনায় নাকখত দিয়ে পালিয়ে আসা, খুন-দুর্নীতিসহ সকলপ্রকার অপকর্মের বিশ্ব স্বীকৃত গড ফাদার খাম্বা বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক কোন প্রেক্ষাপটেই গুরুত্ববহন করে না। এমনকি তার মা ঘসেটি বেগমও এখন আর বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য কোন ফ্যাক্টর নয়। ওরা শুধু জানে ষড়যন্ত্র করতে। এছাড়া খাম্বার দেশে ফেরার কোন সম্ভাবনাই নেই, এবং সে সাহসও নেই। বিলাতে রোহিঙ্গা হয়েই সারাজীবন কাটাতে হবে। সাহস নেই কেননা, আকন্ঠ দুর্নীতি-অপকর্মে নিয়োজিত থাকলে কোন ধরনের সাহস অবশিষ্ট থাকে না। ওরা মা-বেটা যে কি পরিমান দুর্নীতিবাজ আজ বিশ্বের বিভিন্ন বিভিন্ন মিডিয়া ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করছে। তারা এমনই দুর্নীতিবাজ যে, পবিত্র মক্কা নগরীর পবিত্র ক্বাবাঘরের সন্নিকটের সবচেয়ে বড় মার্ককেটের একটি পুরো ফ্লোরসহ আরো অনেক অনেক স্থাপনায় নাকি শতশত কোটি বিনিয়োগ করেছে। যা সাম্প্রতিক সময়ে সৌদিতে জনৈক প্রিন্স দুর্নীতির তদন্ত করতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে এবং তা বিশ্ব প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রোনিক মিডিয়ায় প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে, হচ্ছে। এবং খাম্বার মা ও তাদের পরিবারকে বিশ্বের তিন নম্বর দুর্নীতিবাজ পরিবার বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।
পবিত্র মক্কা নগরীতে খাম্বা ও তার পরিবার যে দুর্নীতিবাজ বলে সাধারণ মানুষের নিকটও পরিচিত তা আমি জানতে পারি প্রথম, তিন বছর আগে উমরা হজ্বে গিয়ে। তখন পবিত্র রমজান মাস। আমি পবিত্র মক্কা থেকে পবিত্র মদিনা যাচ্ছি ট্যাক্স করে আরো কয়েকজনের সাথে শেয়ারে। ড্রাইভারের পাশে বসেছি, সে ভালো ইংরেজি জানে। আমাকে জিজ্ঞেস করলো, কোন দেশ থেকে এসেছি। উত্তরে বললাম, আমি বিলেত থেকে এসেছি তবে, বাংলাদেশি। আবার প্রশ্ন করলো, হাসিনা, না খালেদা? উত্তর দিলাম, হাসিনা। হেসে বললো, গুড। নো আলিবাবা। আমার বুঝতে কষ্ট হলো না, খাম্বার কথা বলছে। আরেকদিনের ঘটনা, ক্বাবা শরীফের সন্নিকটের মার্কেটের হোটেলে আমরা উঠেছিলাম। ঐ সময় বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা শুরু হয়েছে। তাই ছেলের জন্য ব্রাজিলের একটা জার্সি কেনার ইচ্ছে হলো, কিন্তু পেলাম না। তাই আমাদের যিনি গাইড ছিলেন, উনাকে জিজ্ঞেস করলাম, কি করা যায়?
কেননা, ছেলে কিনবেই। তিনি বললেন, উনার পরিচিত সিলেটের একজন আছে যে, টেইলারিং-এ কাজ করে। তাকে বললে সে বানিয়ে দেবে। সে মোতাবেক তাকে বলা হলো এবং যথারীতি সে জার্সি তৈরি করে আমাদের সাথে হোটেলে দেখা করতে এলো। তখন কথা প্রসঙ্গে বললো, হোটেলটি যে মার্কেটে অবস্থিত, সে মার্কেটের একটি ফ্লোর নাকি খাম্বার। ছেলেটি এও জানালো, সে বিএনপি সমর্থক। তার কথা শতভাগ বিশ্বাস হলেও এতদিন লিখিনি কেননা, কোন প্রমাণ আমার হাতে ছিলো না। যদি লিখতাম তাহলে, খাম্বা গ্রুপের সদস্যরা আমাকেও পীর হাবিবের মতো অশালীনভাবে গালিগালাজ করতো। কোন যুক্তি-প্রমানের ধার ধারতো না। কেননা, তাদের জন্মই হয়েছে পেশিশক্তি ও আর খুনের মাধ্যমে, যারা যুক্তি মানে না। প্রমাণ দিলেও বলে তা ঠিক নয়। তাদের কাছে বিশ্বের তাবৎ সবাই মিথ্যেবাদি খাম্বা আর খাম্বার মাসহ খাম্বা গ্রুপের সবাই সত্যবাদি।
তারপরও সত্যের খাতিরে, বিবেকেরে তাড়নায় লিখতে হয়, লিখতে হবে। পীর হাবিব সে কাজটি করেছেন, তাই খাম্বা গ্রুপ বেসামাল আচরণ করছে। তার মেয়ে সমতুল্য একজন ভক্তকে নিয়ে, এমনকি তার বারো বছরের মেয়েটিকে নিয়ে অশালীন মন্তব্য করেছে। যে অনলাইনে এই্ এসব মন্তব্য করা হয়েছে, সে সাইটে গিয়ে দেখলাম সব আজগুবি আর মিথ্যা সংবাদে ভরপুর। একটি সংবাদের শিরোনাম হচ্ছে, ‘নিরাপত্তা হেফাজতে শেখ হাসিনা, সরকার পরিবর্তন আসন্ন।’ ‘ভয়ানক রূপ ধারণ করছে আরাকানের স্বাধীনতাযুদ্ধ, দলে দলে মারা পড়ছে বার্মার কাফের বাহিনী।’ অনলাইন পোর্টালটির নাম হচ্ছে, rarenews24.com। পুরো পোর্টালটিই আজগুবি আর বানোয়াট সংবাদে ভরপুর। এদের নিকট থেকে এরচেয়ে আর কি আশা করা যেতে পারে? কেননা এরা তো খাম্বারই শিষ্য, যে কিনা নিজেকে মহাপন্ডিত মনে করে আর তার বাপ-মা যা বলতে সাহস পায়নি, তাই বলছে বিলেতের মাটিতে নিরাপদে থেকে।
পীর হাবিবের মুল লেখাটি দেরিতে হলেও আমি পড়েছি। ওরা তো ঠিকই তার উপর নাখোশ হয়েছে। তিনি কি করে সজীব ওয়াজেদ জয়ের সাথে খাম্বার তুলনা করলেন? দুজন মানুষ কি এক হলো? পারিবারিক ঐতিহ্য, শিক্ষা-দীক্ষা, সততা, ভদ্রতা, বড়দের প্রতি সম্মান সবকিছু মিলিয়ে খাম্বা কি করে সজীব ওয়াজেদের সাথে তুল্য হয়? খাম্বার বাবা খুনি, মা বিশ্ব দুর্নীতিবাজ, খাম্বা নিজে একটা বদ্ধ পাগল, আকন্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত, বিলেতে আছে রোহিঙ্গা হয়ে। এখানেও শুনেছি বেনিফিট জালিয়াতিতে নাকি ধরা পড়েছে। বিলেতে বসে বসে দেশ ও জনগনের বিরুদ্ধে অবিরত ষড়যন্ত্র করেই চলেছে। মুখে যা আসে তাই বলছে।
অন্যদিকে সজীব ওয়াজেদ জয় বঙ্গবন্ধু পরিবারের সন্তান। শিক্ষিত-সজ্জন-ভদ্র-সৎ। আমেরিকায় আছে বৈধ নাগরিক হয়ে স্বসম্মানে। খাম্বার মা ও তার পরিবার যখন বিশ্বের তৃতীয় শ্রেষ্ঠ দুর্নীতিবাজ বলে বিশ্ব মিডিয়ার খবর হয়, তখন সজীব ওয়াজেদ জয়ের মা মাদার অব হিউমিনিটি জননেত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের সৎ রাষ্টপ্রধানদের মধ্যে তৃতীয় হয়ে আমাদের জন্য গৌরভ বয়ে আনেন। খাম্বার ভাই দুর্নীতির মামলার সাজা মাথায় নিয়ে বিদেশের মাটিতে মারা যায়, যে মামলার তদন্ত করেছে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই। অন্যদিকে জয়ের বোন সায়মা ওয়াজেদ পুতুল প্রতিবন্ধিদের নিয়ে কাজ করার জন্য বিশ্বে নন্দিত হন। এছাড়া খাম্বা যখন রোহিঙ্গা হয়ে বিলেতে বাস করছে, তখন বঙ্গবন্ধু পরিবারের আরেক সন্তান টিউলিপ সিদ্দিক বিপুল ভোটে দ্বিতীয়বারের বৃটিশ পার্লামেন্টে এমপি নির্বাচিত হয়ে বাঙালি জাতিকে সম্মানিত করেছেন। সুতরাং আগরতলা আর চকির তলায় তুলনা করলে তো চকির তলার বাসিন্দারা গোস্সা করবেই। আশ্চর্য্য কিংবা বিচলিত হবার কারণ আছে কি?
আরেকটি বিষয়ে আলোকপাত করে লেখাটি শেষ করতে চাই। কথায় আছে, পাগলে কিনা বলে আর ছাগলে কিনা খায়। খাম্বা একটা বদ্ধ পাগল। তার কথায় বঙ্গবন্ধু যেমন ইতিহাসে গণ্য গৌন হয়ে যাবেন না। তার কথায় ইতিহাসও নতুন করে লেখা হবে না। হলেও তা ঠিকবে না জাতি মানবে না। অতীতে খাম্বার বাবা-চাচা-মা অনেক চেষ্টা করেছে, পারেনি। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণসহ বঙ্গবন্ধুই নিষিদ্ধ ছিলেন বাংলাদেশে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার পর্যন্ত আইন করে বন্ধ ছিলো বাংলাদেশে। বাঙালি জাতি কি তা মেনে নিয়েছে? না নেয়নি, বরং যারা ইতিহাস পাল্টে দিতে চেয়েছে, বঙ্গবন্ধুকে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছে তারাই আজ গৌন হয়ে গিয়েছে। ইতিহাসের আস্তাখুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। আজ বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ ইউনেস্কো কর্তৃক ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বাংলাদেশ এখন সম্ভাবনাময় দেশ, মধ্যম আয়ের দেশ।
আমরা পীর হাবিবের কষ্টের জায়গা অনুভব করতে পারি। তাকে যাচ্ছে তাই বলুক তাতে হয়তো কিছু যায় আসে না। কেননা, সাংবাদিকতা, রাজনীতি করতে গেলে, বিশেষ করে সত্য ও যৌক্তিক কথা বললে গায়ে কাদা লাগবেই, মানুষজন সমালোচনা করবেই। কিন্তু নিজের সন্তানতুল কিংবা বারো বছরের কন্যা সন্তানকে নিয়ে যখন কেউ অশালীন কথা বলে শুধুমাত্র নিজের একটি লেখার জন্য, তখন খুবই কষ্ট হয়। বিষয়টি অমানবিক। তবে কুকুর সমতুল্য এদের কাছে মানবিক আচরণ প্রত্যাশা করা অর্থহীন। এর জবাব একটাই, নিরন্তর কলমযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সকল প্রকার অসততা, ভন্ডতা, অমানবিকতার বিরুদ্ধে। প্রত্যাশা থাকবে পীর হাবিব থেমে থাকবেন না। নিরন্তর কলমযুদ্ধ চালিয়ে যাবেন একটি সোনালী ভোরের প্রত্যাশায় নির্মোহভাবে। মানবতা ও সত্যের জয় হউক।
লেখক: লন্ডন প্রবাসী সাংবাদিক