১৯৪৪-২০১৭ সাল প্রায় সাড়ে সাত দশক। দীর্ঘ ৭৪ বছরের সংগ্রাম মুখর পথ চলা। একটি জীবন একটি ইতিহাস। সেই ইতিহাসের স্তম্ভ এবিএম মহিউদ্দিন। বন্দর নগরী চট্টগ্রামের সাবেক নগর পিতা ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের এ প্রবীণ রাজনৈতিক নেতার জীবন ছিল নানা প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতায় ভরপুর। সব বাধাকে জয় করে যিনি হয়েছিলেন জন মানুষের নন্দিত নেতা। পেয়েছেন চট্টল বীরের খেতাব। ১৯৪৪ এর ১ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার গহিরা গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরির জন্ম। পিতার নাম মরহুম হোসেন আহমদ চৌধুরি আর মাতা মরহুম বেদৌরা বেগম। আট ভাইবোনের মাঝে মহিউদ্দিন মেজ। পিতা চাকরি করতেন আসাম বেঙ্গল রেলওয়েতে। পিতার চাকরির সুবাদে মহিউদ্দিন পড়াশোনা করেছেন মাইজদি জেলা স্কুল, কাজেম আলি ইংলিশ হাই, আর প্রবর্তক সংঘে। স্কুল জীবনে ছাত্রলীগের সাথে জড়িয়ে পড়েন। স্কুল শেষে শেষে বাবার আদেশে ভর্তি হয়ে ছিলেন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং এর কোর্সে। সেখানের পাঠ না চুকিয়ে ভর্তি হন চট্টগ্রামের অন্যতম বিদ্যাপীঠ চট্টগ্রাম কলেজে। বছর না ঘুরতেই কমার্স কলেজে পাড়ি, শেষ পর্যন্ত সিটি কলেজে পড়াশুনা।

সিটি কলেজেই তার বিপ্লবী রাজনৈতীক জীবনের হাতেখড়ি। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। রাজনৈতিক জীবনের শুরতেই সান্নিধ্যে আসেন জননেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর। বঙ্গবন্ধুর ডাকে আন্দোলন সংগ্রামে অংশ নিতে গিয়ে পাক বাহিনির কাছে গ্রেফতার হন অসংখ্যবার। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে গিয়ে আইএস আইয়ের চট্টগ্রাম নেভাল একাডেমি সদর দপ্তরের কাছে গ্রেফতার হয়ে অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হন দীর্ঘ চার মাস। শহীদ হয়ে গেছেন ভেবে ছেলের নামে বাবা ফাতেহা পড়িয়েছিলেন। এরই মাঝে একদিন মানসিক রোগীর অভিনয় করে চট্টগ্রাম কারাগার থেকে পালিয়ে যান মহিউদ্দিন। পাড়ি জমান ভারতে। সেখানে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ শেষে সক্রিয়ভাবে সম্মুখসমরে অংশ নেন। ছিলেন ভারত-বাংলা যৌথবাহিনীর মাউন্টেন ডিভিশনের অধীনে।

বঙ্গবন্ধুর খুবই কাছের আর আদরের ছাত্রনেতা ছিলেন মহিউদ্দীন। কিন্তু তৎকালীন সময়ে প্রবল ক্ষমতাশালী হয়েও ক্ষমতার মোহ স্পর্শ করেনি তাকে। কিছুদিন না যেতেই ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে শহীদ হন বঙ্গবন্ধু। অল্পের জন্য মহিউদ্দিন ধরা পরা থেকে বেঁচে যান, মৃত্যু বরণ করেন সাথি মৌলভি সৈয়দ। পালিয়ে গিয়ে ভারতে প্রতিবিপ্লবীদের সাথে যোগ দেন। লক্ষ্য সামরিক জান্তা, খুনি মোশতাককে সামরিক ভাবেই পরাস্ত করা। কিছুদিন পরেই দলের নির্দেশে পন্থা পরিবর্তন করে আবার সক্রিয় হন প্রকাশ্য রাজনীতিতে। দেশে এসেই নির্যাতন ও একের পর এক কারাভোগের শিকার হন এ নেতা। মাঝে আওয়ামী লীগের ভেতরেই ষড়যন্ত্রকারীরা তৎপর হয়ে উঠলো। বঙ্গবন্ধু কন্যা আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভুমিকাকে নগণ্য করতে তাকে ঠেকাতে শত্রুরা উঠেপরে বসলো। অদম্য সাহসী মহিউদ্দীন চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে দলবল নিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যার জন্য ঝাপিয়ে পরলেন। সব বাধা অতিক্রম করে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে দলের কাণ্ডারির দায়িত্ব নিতে সহয়তা করলেন। স্বৈরাচার এরশাদের শাসনামলে চট্টগ্রামে স্বয়ং জান্তা প্রধানকে অবাঞ্চিত ঘোষণা করে চক্ষুশূল হন সরকারের। ফলে আবারও রাজনৈতিক বন্দি। ততদিনে চট্টগ্রামের আপামর জনতার নয়নমনি হয়ে উঠেন মহিউদ্দীন চৌধুরী।

একানব্বইয়ের ঘুর্ণিঝড়ে দুস্হ জনতার পাশে দাঁড়িয়ে, অসহযোগ আন্দোলনে খালেদার সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে, গরিব-দুঃখি-শ্রমিকের অধিকারের কথা বলে মহিরুহে পরিনত হন আজকের মহিউদ্দীন। ওয়ান ইলেভেনের শাসনামলে জেলে যান। ষাটোর্ধ বয়সে কারান্তরীণ ছিলেন দীর্ঘ দুই বছর। এরমধ্যেই মারা যায় আদরের মেয়ে ফওজিয়া সুলতানা টুম্পা। টুম্পার মৃত্যু অবধারিত জেনেও দেখতে দেয়নি অনির্বাচিত সরকার। শতচেষ্টা আর মানসিক নির্যাতন করেও টলাতে পারে নি সরকার মহিউদ্দীনকে একটুও। তিনি ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথমবারের মতো চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন। ২০০৫ সালের মেয়র নির্বাচনে তিনি ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের একজন মন্ত্রীকে পরাজিত করে তৃতীয়বারের মতো চট্টগ্রামের মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হন। পাশাপাশি প্রতিপক্ষের তুলনায় ভোটের ব্যবধানও উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn