মাদকে বাধা দেয়ায় নির্মমতা
রুদ্র মিজান-
ওয়াকিলের অপরাধ মাদকের বিরুদ্ধে লড়াই করা। আর এ অপরাধেই মাদক কারবারির হাতে হারাতে হয়েছে চোখের আলো। শুধু তাই নয়, মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে আসা ওয়াকিল বেঁচে থেকেও এখন অর্ধমৃত। ওয়াকিলের মাদকবিরোধী অবস্থানের কারণে ক্ষুব্ধ মাদক ব্যবসায়ীরা রাজপথ থেকে ধরে নিয়ে যায় তাকে। এর নেতৃত্ব দেয় কাল্লু বাহিনীর প্রধান একাধিক হত্যা, মাদক মামলার আসামি কাল্লু। তার নেতৃত্বেই রাতভর আটকে রেখে করা হয় নির্মম নির্যাতন। রড দিয়ে বেদম প্রহার। শেষ পর্যন্ত আঙুল ও রড ঢুকানো হয় ওয়াকিলের দু’চোখে। রক্তে ভেসে যায় ওয়াকিলের পুরো শরীর। তারপর আর কিছু মনে নেই। অজ্ঞান অবস্থায় রাজপথ থেকে পরদিন তাকে উদ্ধার করেন স্বজনরা। নির্যাতনকারীরা প্রভাবশালী। তাই ঘটনার ছয় দিন পেরিয়ে গেলেও মামলা করার সাহস পাচ্ছেন না ওয়াকিলের স্বজনরা। ঘটনার দিন বারবার থানায় গিয়ে সহযোগিতা চাইলে পুলিশ গুরুত্ব দেয়নি। গতকাল জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে কথা হয় গুরুতর আহত ওয়াকিলের সঙ্গে। ৩রা জুন। রাত সাড়ে ১১টা। বাসা সংলগ্ন মিরপুর-১১ এর বড় মসিজদের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন ওয়াকিল। তখনই ঘটে ঘটনা। ফিল্মি কায়দায় কাল্লুর নেতৃত্বে পাঁচ-ছয় জন ঘেরাও করে তাকে। কিছু বুঝে উঠার আগেই অস্ত্র দেখিয়ে জিম্মি করা হয়। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় মিরপুর-১১ এর চার নম্বর বিল্ডিংয়ের কনসার্ন ক্যাম্পের বি ব্লকের একটি বাসায়। ওয়াকিল জানান, এটা কাল্লু বাহিনীর টর্চার সেল। ঘরের ভেতরে ঢুকিয়ে কাপড় দিয়ে মুখ বাঁধা হয় ওয়াকিলের। তারপর রড দিয়ে বেদম প্রহার। পুরো শরীরে এলোপাতাড়ি পেটাতে তাকে কয়েক জন। বুকটা তার ফেটে যাচ্ছিল। দফায় দফায় পেটানো হচ্ছিল ওয়াকিলকে। ততক্ষণে রক্তে ভিজে গেছে পুরো শরীর। ওয়াকিল বলেন, টর্চার শুরুর পর মনে হয়েছে আমি আর বাঁচতে পারব না। ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। তিনি জানান, চোখে দেখছিলেন না। কিন্তু শব্দ শুনে বুঝতে পারতেন ইয়াবা সেবন করছিল তারা। ওই সময়ে তাকে মারধর করেনি। কিছুক্ষণ পরেই ফজরের আজান শুনতে পান। ওই সময়ে তার চোখ খুলে দেয়া হয়। কাল্লু তখন বলছিল, ‘তোকে সারাজীবনের মত অন্ধ বানায়া দিমু।’ বলেই একহাতে ছোট একটি রড নিয়ে ওয়াকিলের সামনে দাঁড়ায়। প্রথমে দুই আঙুল তার এক চোখে ঢুকানোর চেষ্টা করে। ওয়াকিল বলেন, মনে হচ্ছিল আজরাঈল আমার জানটা কেড়ে নিচ্ছে। চোখে যখন আঙুল ঢুকাচ্ছিল ওই সময়ে আমি সংজ্ঞ হারাই। তারপর আর কিছু মনে নেই ওয়াকিলের। পরদিন ভোরে হাত-পা বাঁধা, অজ্ঞান অবস্থায় ওয়াকিলকে নয় নম্বর লেনের একটি বাসার সামনে থেকে উদ্ধার করেন স্বজনরা। প্রথমে তাকে ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। পরে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে। সেখানে অধ্যাপক ডা. শেখ মোহাম্মদ হোসেনের অধীনে চিকিৎসা হচ্ছে তার। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ওয়াকিলের চোখের অবস্থা আশঙ্কাজনক। ভর্তির পরপরই দু’চোখে অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। ডান চোখে ১৫ ও বাম চোখে ২২টি সেলাই দেয়া হয়েছে।
এ ঘটনার পর আতঙ্কে ওয়াকিলের পুরো পরিবার। মামলা করতে সাহস পাচ্ছেন না তারা। ঘটনার রাতে বারবার পুলিশের সহযোগিতা চাইলেও পাননি। এ বিষয়ে ওয়াকিলের স্ত্রী গুরিয়া বেগম জানান, রাত ১২টার দিকে জানতে পারেন তার স্বামী ওয়াকিলকে তোলে নিয়ে গেছে কাল্লু ও তার লোকজন। ওয়াকিলের মা-বাবা, স্ত্রী স্বজনরা দ্রুত বাসা থেকে বের হয়ে খুঁজতে থাকেন। কিন্তু কোথাও ওয়াকিলকে খুঁজে পাওয়া যায় না। কাল্লুর স্পট বলে পরিচিত নয় নম্বর লাইনে গেলে কাল্লুর সঙ্গে কথা হয় ওয়াকিলের বোন রুজির। এ সময় কাল্লুর কাছে ভাই কোথায় জানতে চাইলে সে জানায়, ও আমার কাছে আছে। কাল ভোরে বাসায় পাঠিয়ে দেব। কিছুতেই ওয়াকিলের সন্ধান দেয় না। এর কিছু সময় পরই কাল্লুর কাছে যান ওয়াকিলের স্ত্রী গুরিয়া। কাল্লু তাকে জানায় থানায় সোপর্দ করেছে ওয়াকিলকে। ওয়াকিলকে উদ্ধারের জন্য বারবার পল্লবী থানায় যান ওয়াকিলের মা-বাবা, স্ত্রী, স্বজনরা। গুরিয়া বলেন, আমরা বারবার পল্লবী থানায় গিয়েছি। অনুরোধ করে পুলিশকে বলেছি, কাল্লু আমার স্বামীকে ধরে নিয়ে গেছে। আমার স্বামীকে উদ্ধার করুণ। ওরা মেরে ফেলবে। ওরা কোনো কথাই শুনতে চায় না। উল্টো ডিউটি অফিসার বলেছে, মাদক প্রতিরোধ পুলিশের কাজ। তোর জামাই মাদক প্রতিরোধ করতে যায় কেন। যা, সকালে দেখা যাবে। এখন থানায় অফিসাররা নেই। গাড়িও নেই। এভাবেই তাদের বারবার থানা থেকে বের করে দেয়া হয় বলে অভিযোগ করেন তিনি। এ ছাড়াও ওয়াকিলের সন্ধানের জন্য পল্লবী, মিরপুর, রূপনগর থানায় খোঁজ নিয়েছেন তারা। এসব বিষয়ে পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দাদন ফকির বলেন, ওই রাতে আমি থানায় ছিলাম না। পরে খবর পেয়ে আমরা ঘটনাস্থলে গিয়েছি। ওয়াকিলকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেছে পুলিশ। তবে ওয়াকিলের স্বজনদের সহযোগিতা না করে থানা থেকে বের করে দেয়ার বিষয়টি তার জানা নেই বলে জানান ওসি।
নির্যাতনের শিকার ওয়াকিল একজন ইলেকট্রিক মিস্ত্রি। ওয়াকিলের মাদক বিরোধিতা সম্পর্কে জানা গেছে, তার ছোট ভাই জলিল তিন বছর যাবৎ মাদকাসক্ত। ছোট ভাইয়ের কারণে নানা যন্ত্রণা পোহাতে হয় পরিবারের সদস্যদের। এসব থেকে শিক্ষা নিয়েই মাদকের বিরুদ্ধে দাঁড়ান ওয়াকিল। এলাকায় মাদক বিক্রিতে বাধা দেন তিনি। স্বজনদের নিয়ে প্রতিহত করেন খুচরা বিক্রেতাদের। এতেই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে মিরপুরের মাদকসম্রাট কাল্লু। প্রায় এক মাস আগে কাল্লুর মা মাদকসম্রাজ্ঞী আজেদা বেগমের মাদক ব্যবসা প্রতিরোধের আহ্বান জানিয়ে এলাকায় পোস্টার সাঁটানো হয়। এতে ওয়াকিল জড়িত রয়েছে ধারণা করেই তার ওপর হামলা করে কাল্লুর ভাই জাহিদ। তখন দুই পক্ষের মধ্যে মারধরের ঘটনা ঘটে। ওয়াকিল জানান, ঘটনাটি ঘটে বড় মসজিদের সামনে। এ ঘটনায় বাসায় হামলা ও লুটপাটের অভিযোগ এনে ওয়াকিলকে আসামি করে মামলা করা হয়। ওই মামলায় জামিনে রয়েছেন ওয়াকিল।