এবার আর রেহাই পেলেন না খালেদা জিয়ার সাবেক উপদেষ্টা জাহিদ সরদার সাদী ওরফে সর্দার ফারুক (৪২)। ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের ওরল্যান্ডোতে অবস্থিত মিডল ডিস্ট্রিক্ট ফেডারেল কোর্ট সাদীকে ৪ মাসের কারাদন্ড প্রদান করেছে।২৭ জুন মঙ্গলবার বিচারপতি গ্রেগরী এ প্রেসনেল এ রায় প্রদান করেছেন। একইসাথে সাদীকে এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের অনুমতিও প্রদান করা হয়েছে। ফেডারেল কোর্ট সূত্রে জানা গেছে, এটি ছিল সাদীর ২৮তম গ্রেফতার। চেক জালিয়াতি, ব্যাংকের সাথে প্রতারণা, বিভিন্ন জনের সাথে ঠকবাজি ইত্যাদি মামলায় এর আগে ২০০৯ সালের ৫ মার্চ একই আদালতে সাদীর ৪০ মাসের কারাদন্ড হয়। এই দন্ডভোগের পর তাকে ৫ বছরের সুপারভাইজড রিলিজের (কর্তৃপক্ষের নজরদারি) তথা প্রবেশনে থাকার অনুমোদন দেন মাননীয় আদালত।সর্বশেষ মামলায় প্রবেশনের বিধি চরমভাবে লংঘনের জন্যে সাদীকে গত ১৭ মে গ্রেফতার করা হয়। ওয়াশিংটন ডিসিতে ক্যাপিটল হিলে বিএনপির পক্ষে দেন-দরবার করতে যাবার সময় এফবিআই তাকে গ্রেফতার করে। প্রসঙ্গত: উল্লেখ্য যে, ২০১৫ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের ৬ কংগ্রেসম্যানের স্বাক্ষর জাল করে বিএনপির পক্ষে ভূয়া বিবৃতি তৈরীর ঘটনা ফাঁস হওয়ায় বিব্রত বিএনপি নেতাদের চাপে সাদীসহ দু’জনকে চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা এবং বিদেশ বিষয়ক বিশেষ দূতের পদ থেকে অপসারণ করা হয়। এতদসত্বেও লন্ডন থেকে তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠজনেরা নিউইয়র্কে এলেই এই সাদীর সাথে দহরম-মহরম করেন বলে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির বিভিন্ন নেতারা অভিযোগ করেছেন। শুধু তাই নয়, ‘খালেদা জিয়ার নির্দেশে বিদেশ বিষয়ক উপদেষ্টার পদ থেকে অপসারণের পরও মার্কিন প্রশাসনে দেন-দরবারের সময় এই সাদী নিজেকে ‘বাংলাদেশের ৩ বারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ফরেন এডভাইজার এ্যান্ড স্পেশাল এনভয়’ হিসেবে পরিচয় দেন। প্রতারণামূলকভাবে স্টেট ডিপার্টমেন্ট, ক্যাপিটল হিল, জাতিসংঘে এসব পরিচয় উপস্থাপনের কিছু ডক্যুমেন্টও মাননীয় আদালতে নথিভুক্ত রয়েছে। কয়েক মাস আগে নিউইয়র্কের বাংলাদেশীদের পরিচালনাধীন একটি অন-লাইন টিভির স্টুডিয়ো ভাড়া করে ‘টক শো’র আয়োজন করেছিলেন এই সাদীসহ কয়েকজন। সেখানে বহুল আলোচিত ইসরাইলি নাগরিক মেন্দি সাফাদিকে দিয়ে বলার চেষ্টা করানো হয় যে, তার (সাফাদি) সাথে সজীব ওয়াজেদ জয়ের বৈঠক হয়েছে। যদিও পরবর্তীতে তা মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়েছে জয়ের বিবৃতিতে। ‘সেটি করা হয় প্রধানমন্ত্রীর পুত্র এবং আইটি বিষয়ক উপদেষ্টা ও ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকার জয়ের ইমেজ বিনষ্টের অভিপ্রায়ে’-এমন অভিযোগ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী পরিবার থেকে।আদালতের তথ্য অনুযায়ী, সাদীর বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল হিস্টরী পয়েন্ট হচ্ছে ৯। এটির ক্যাটাগরি ফোর। এ ব্যাপারে সাদীও আদালতের সাথে একমত পোষণ করেন। মামলার বিবরণে আরো জানা গেছে, ২০০৯ সালের মার্চে প্রদত্ত ৪০ মাসের দন্ডসহ সাদীকে ২ লাখ ৩৪ হাজার ২২৯ ডলার ৭৫ সেন্ট জরিমানা করা হয়েছে। বিভিন্ন ব্যাংকের সাথে প্রতারণার মাধ্যমে এই অর্থ সাদী আত্মসাত করেন বলে আদালতে স্বীকার করেন সাদী। সেই অর্থ সরকারী কোষাগারে ফেরৎ দেয়ার নির্দেশ রয়েছে। কিন্তু গত ৬ বছরের মধ্যে সাড়ে ৩ বছরের মত তিনি জেলে ছিলেন। এরপর প্রবেশন ভঙ্গ করে নিউইয়র্কে বিএনপির মিটিং-মিছিলে সময় অতিবাহিত করায় ওয়ার্কপারমিট নবায়নে সক্ষম হননি। তাই কোন কাজও করতে পারেননি বলে আদালতের অবজার্ভেশন রয়েছে। তাই সেই অর্থ সাদী কীভাবে পরিশোদ করবেন সেটি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে বলে সর্বশেষ মন্তব্যে মাননীয় আদালত উল্লেখ করেছেন।আদালতের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন সর্দার জাহিদ ফারুক ওরফে সাদী। যুক্তরাষ্ট্রে এসেছেন ১৯৯৬ সালে। সরকারের ইস্যুকৃত ভিসায় তিনি নিউইয়র্ক হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছেন। এরপরই ফ্লোরিডার ওরল্যান্ডোতে বসতি গড়েন। সেখানেই তিনি মার্সিয়া পবেলকে বিয়ে করেছেন। তাদের একটি কন্যা রয়েছে। তার নাম সারাহ পবেল ফারুক। উল্লেখ্য, ২০০১ সাল থেকেই মার্সিয়ার সাথে বনিবনা হচ্ছিল না সাদীর। এর চরম পরিণতি ঘটে ২০০৮ সালে তালাকের মধ্য দিয়ে। সে সময় থেকেই সাদীকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কারের প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয়। কারণ, তার বৈধ স্ট্যাটাস নেই। সে অনুযায়ী, ২০০৯ সালের মার্চে প্রদত্ত দন্ডভোগের পর ইমিগ্রেশন এ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইস)এজেন্টরা তাকে বহিষ্কারের বিষয়টি হাতে নিলেও সে সময় ‘জাতিসংঘ কনভেনশন এগেইনস্ট টর্চার’র আওতায় ইমিগ্রেশন কোর্ট তার এসাইলাম মঞ্জুর করে। তবে ২০১২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারিতে সাদী ঐ দন্ডভোগের পর মুক্তি পাবার সাথে সাথে তাকে আইসের তত্ত্বাবধানে প্রবেশনে দেয়া হয়। সে সময় সাদী থাকতেন ফ্লোরিডার ফোর্ট মায়ার্সে। এরপর ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে সাদী কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি এড়িয়ে নিউইয়র্কের জ্যামাইকায় বসতি গড়েন বলেও আদালতের নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে। এ জন্যেই তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয়েছিল। এটি কার্যকর করা হয় গত ১৭ মে। সেই থেকে সাদীকে কারাগারে রাখা হয়েছে।
কোর্ট সূত্রে জানা গেছে, জাহিদ এফ সর্দার সাদি যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে দেউলিয়া এবং ক্ষতিগ্রস্থ করতে বিভিন্ন ধরনের চক্রান্ত ও চুরির আশ্রয় নিয়েছেন। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে, বাংকো পপুলার পর্টোরিকো, ব্যাংক অব আমেরিকা, ফিফথ থার্ড ব্যাংক, ওয়াকোবিয়া ব্যাংক, ওয়াশিংটন মিউচুয়্যাল ব্যাংক, সান ট্রাস্ট ব্যাংক, ফার্স্ট প্রায়রিটি ব্যাংক এবং আরবিসি ব্যাংক। এসব ব্যাংকের মাধ্যমে ডিপোজিটকৃত চেক ও অর্থ ফেডারেল ডিপোজিট ইন্সুরেন্স কর্পোরেশন, ম্যাককোয় ফেডারেল ক্রেডিট ইউনিয়ন এবং সেন্ট্রাল ফ্লোরিডা এডুকেটর ক্রেডিট ইউনিয়ন শেয়ার ইন্সুরেন্স ফান্ড কর্তৃক ইন্স্যুর করা ছিল। এর প্রেক্ষিতে যেকোন চেক জমা দিলেই তার বিপরীতে তাৎক্ষনিক নগদ অর্থ উত্তোলন সম্ভব হতো।
প্রসঙ্গত: উল্লেখ্য যে, বরিশালের সন্তান বাংলাদেশের অবসরপ্রাপ্ত একজন পদস্থ কর্মকর্তা (যিনি সিনিয়র সহকারি সচিব হিসেবে অবসর নেয়ার পর ইন্তেকাল করেছেন)’র পুত্র সাদী ইতিপূর্বে নানা ধরনের প্রতারণা, জালিয়াতির মামলায় ২৭ বার গ্রেফতার হন। প্রতিবারই ছোটখাটো শাস্তি হয় তার। সর্বশেষ ২০১৫ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ৬ মার্কিন কংগ্রেসম্যানের (ফরেন এফেয়ার্স কমিটির চেয়ারম্যান কংগ্রেসম্যান (ক্যালিফোর্নিয়া-রিপাবলিকান) এডোয়ার্ড রয়েস এবং কমিটির প্রভাবশালী মেম্বার কংগ্রেসম্যান (নিউইয়র্ক-ডেমক্র্যাট) এলিয়ট এঙ্গেল, কংগ্রেসম্যান স্টিভ শ্যাবট(রিপাবলিকান-ওহাইয়ো), কংগ্রেসম্যান যোসেফ ক্রাউলী(ডেমক্র্যাট-নিউইয়র্ক), কংগ্রেসম্যান জর্জ হোল্ডিং (রিপাবলিকান-নর্থ ক্যারলিনা) এবং কংগ্রেসওম্যান গ্রেস মেং (ডেমক্র্যাট-নিউইয়র্ক) এর স্বাক্ষর জাল করে তারেক রহমানের পক্ষে ও শেখ হাসিনা সরকারের বিপক্ষে একটি বিবৃতি প্রচার করেছিলেন। এরপর তাকে বিএনপি চেয়ারপার্সনের বিদেশ বিষয়ক উপদেষ্টা থেকে অপসারণ করা হলেও তার সাথে লন্ডনে বসবাসরত তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠজনেরা নিউইয়র্কে এসে দেন-দরবার করতেন। ৪ বছরের অধিক সময় যাবত যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির কমিটি নেই, এ অবস্থায় তারেক রহমানের উপদেষ্টাদের সাথে সম্পর্কের কথা জানিয়ে ৫ খন্ডে বিভক্ত নেতাদের কাছে বিশেষ সুবিধা আদায়ই ছিল তার অন্যতম অবলম্বন।