মালয়েশিয়ায় সেকেন্ডহোমঃ ১০৫০ জনের তালিকা ধরে মাঠে নেমেছে দুদক
এই ২০ জন ছাড়াও ‘আবাসিক’ ভিসা নিয়ে বছরের পর বছর মালয়েশিয়ায় আছেন এমন ১০৫০ জন পাসপোর্টধারীর বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য পেতে নানাভাবে কাজ শুরু করেছে দুদক। এরই অংশ হিসেবে দুদক থেকে সম্প্রতি পাসপোর্ট অধিদফতরের মহাপরিচালকের কাছে চিঠি দেয়া হয়েছে। এতে ১০৫০ জনের স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা, পাসপোর্টের ধরন এবং সাংকেতিক বর্ণমালার ব্যাখ্যাসহ প্রয়োজনীয় তথ্য চাওয়া হয়। দুদকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার স্বাক্ষরে দেয়া চিঠিতে ‘সেকেন্ডহোম’ গড়ার নামে বিদেশে টাকা পাচারের অভিযোগ উল্লেখ করে সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে রেকর্ডপত্র ও তথ্যাদি পর্যালোচনা বিশেষভাবে প্রয়োজন বলে উল্লেখ করা হয়। চিঠির সঙ্গে ১০৫০ জনের নাম ও তাদের পাসপোর্ট নম্বর উল্লেখ করে আলাদা একটি তালিকা পাসপোর্ট অধিদফতরে পাঠানো হয়। এছাড়া কিছু তথ্য চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছেও চিঠি দিয়েছে দুদক। চিঠি পাওয়ার পর পাসপোর্ট অধিদফতর থেকে শতাধিক ব্যক্তি সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করা হয়েছে। তবে দুদক কর্মকর্তারা এ ব্যাপারে মুখ খুলতে নারাজ। তারা বলছেন, অনুসন্ধান চলছে। এর বেশি কিছু এখন বলা সম্ভব নয়।
মালয়েশিয়ায় সেকেন্ডহোমধারীদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের পরিচালক (বিশেষ তদন্ত-১) একেএম জায়েদ হোসেন খান বলেন, আমাদের একটা টিম এ নিয়ে অনেকদিন ধরে কাজ করছে। মালয়েশিয়ায় আবাসিক ভিসা নিয়ে আসা-যাওয়া করছেন এমন বেশ কিছু লোকের পুরো ঠিকানাসহ প্রয়োজনীয় তথ্য চেয়ে পাসপোর্ট অধিদফতরের মহাপরিচালকের কাছে চিঠি দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। অনুসন্ধান টিমের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মালয়েশিয়ায় আবাসিক ভিসা নিয়ে আসা-যাওয়া করছেন এমন ব্যক্তিদের একটা তালিকা দুদকের হাতে এসেছে। পাসপোর্ট অধিদফতরের দেয়া তথ্য পর্যালোচনার পর নিশ্চিত হওয়া যাবে তাদের কতজন কিভাবে মালয়েশিয়ায় আবাসিক ভিসা পেয়েছেন। কতজন সেকেন্ডহোম গড়েছেন। পাসপোর্ট অধিদফতরের কাছ থেকে পুরো তথ্য পাওয়ার পর তাদের সেকেন্ডহোমের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। বিশেষ করে যারা দীর্ঘ সময় ধরে মালয়েশিয়ায় আছেন তাদের কাছ থেকে সেকেন্ডহোমের তথ্য পাওয়া যাবে। ওই তালিকার প্রত্যেকের পাসপোর্ট নম্বরের সঙ্গে সাংকেতিক বর্ণ রয়েছে। দুদকের চিঠিতে সে বিষয়েও ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, যাদের নাম ও পাসপোর্ট নম্বর দিয়ে তল্লাশি করা হচ্ছে তাদের বেশির ভাগই কমপক্ষে এক বছর থেকে ১০ বছর পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় আছেন। কেউ কেউ আরও বেশি সময় ধরে আছেন। এদের ভিসায় লেখা আছে ‘আবাসিক’। যারা আবাসিক ভিসা পেয়েছেন তাদের সে দেশে সম্পত্তি আছে বলে আমরা মনে করি।
মালয়েশিয়ায় ‘মেয়াদি নাগরিকত্ব’ গ্রহণে আগ্রহীদের বয়স ৫০ বছরের কম হলে সে দেশের ব্যাংকে তিন লাখ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫৭ লাখ টাকা) ডিপোজিট থাকতে হবে। আবেদন মঞ্জুরের এক বছর পর আবেদনকারী চাইলে ফিক্সড ডিপোজিট থেকে দেড় লাখ রিঙ্গিত তুলে নিতে পারবেন। তবে তুলে নেয়া অর্থ অবশ্যই মালয়েশিয়ায় জীবনযাপনের পেছনে ব্যয় করতে হবে। তবে বয়স ৫০ বছরের বেশি হলে মালয়েশিয়ার ব্যাংকে দেড় লাখ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত ফিক্সড ডিপোজিট থাকতে হবে। এছাড়া নিশ্চিত করতে হবে ১০ বছরের জন্য যারা আবাসিক ভিসা নিয়ে থাকতে চান তারা নিজ খরচে চলতে পারবেন। মালয়েশিয়ান সরকারের এমন সুবিধা সামনে থাকায় বাংলাদেশের কিছু লোক ওই দেশে অর্থ সরিয়ে সেকেন্ডহোম সুবিধা নিচ্ছেন। সূত্র জানায়, গত এক যুগে অন্তত ৩ হাজার ৩৪৫ জন বাংলাদেশি মালয়েশিয়ায় সেকেন্ডহোম সুবিধা নিয়েছেন। এতে পাচার হয়েছে ১ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা। এই ৩ হাজার ৩৪৫ জনের মধ্যে এক হাজার ৫০ জনের তালিকা নিয়ে কাজ চলছে। মালয়েশিয়া সরকার ২০০২ সালে বিশেষ কর্মসূচির আওতায় ‘সেকেন্ডহোম’ প্রকল্প শুরু করে। ওই বছর কোনো বাংলাদেশি এ সুবিধা না নিলেও ২০০৩ থেকে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩ হাজার ৬৯১ জন সেকেন্ডহোম সুবিধা নিয়েছেন। তালিকাভুক্ত বাংলাদেশিরা দেশ থেকে টাকা সরিয়ে সেকেন্ডহোমে বিনিয়োগ করেছেন; যা সরাসরি মানি লন্ডারিং আইনে অপরাধের শামিল। ১৯৪৭ সালের ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন অ্যাক্টের ৫(১) ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া কেউই দেশ থেকে টাকা বিদেশে পাঠাতে পারেন না। দুদক বলছে, দেশের বাইরে অর্থ পাচার ঠেকাতে তারা মডেল কেস হিসেবে মালয়েশিয়ায় অর্থ পাচারের বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে।
মালয়েশিয়ায় সেকেন্ডহোম গড়ার নামে অর্থ পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য গঠিত টিমে দুদকের উপপরিচালক মো. জুলফিকার আলী ছাড়াও সহকারী পরিচালক মো. সালাহউদ্দিন ও উপ-সহকারী পরিচালক সরদার মঞ্জুর আহমদ রয়েছে বলে জানা গেছে। টিমের একজন সদস্য জানান, পাসপোর্ট অধিদফতর থেকে পুরো তথ্য পাওয়ার পর আমরা পরের ধাপে তাদের কাছ থেকে সে দেশে আবাসিক ভিসা পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইব। প্রয়োজনীয় জিজ্ঞাসাবাদের পর কমিশনের নির্দেশনামতো পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেব।