মা ও দুই মেয়ের ‘হত্যাকাণ্ড’ টের পায়নি পরিবারের সদস্যরা
সোমবার (৩০ এপ্রিল) রাত সাড়ে ৮টার দিকে দারুস সালাম থানা এলাকার মিরপুর সরকারি বাংলা কলেজ সংলগ্ন সরকারি কোয়ার্টার থেকে মা ও দুই মেয়ের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ‘সি’ টাইপ সরকারি কোয়ার্টারের ১৩৪ নম্বর ছয়তলা ভবনের চারতলার বাম পাশের একটি ফ্ল্যাট থেকে জেসমিন আক্তার (৩৫), তার মেয়ে হাসিবা তাহসিন হিমি (৯) এবং আদিলা তাহসিন হানির (৫) মরদেহ উদ্ধার করা হয়।জেসমিন আক্তারের স্বামী হাসিবুল হাসান জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সহকারী লেজিসলেটিভ ড্রাফটসম্যান হিসেবে কর্মরত আছেন। জেসমিন আক্তার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কোষাদক্ষ পদে কর্মরত ছিলেন। ২০০৮ সালে পারিবারিকভাবে তাদের বিয়ে হয়। হাসিবুলের গ্রামের বাড়ি পঞ্চগড়ের ভজনপুর গ্রামে এবং জেসমিনের বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ে। তাদের বড় মেয়ে হিমি পাইকপাড়া এলাকার মডেল একাডেমির স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়তো।২০০৭ সালে হাসিবুল হাসান সরকারি এই বাসভবনটি বরাদ্দ পান। বিয়ের পর থেকে তিনি স্ত্রী জেসমিনকে নিয়ে এখানেই থাকেন।
সোমবার রাতে সরেজমিনে দেখা গেছে, ভবনটির সিঁড়ি দিয়ে উঠে চারতলার ডান পাশের দরজা দিয়ে ঢুকলেই বাম পাশে ড্রইং রুম। এই রুমে একটি সেমি ডাবল খাট, একসেট সোফা, খাটের পাশেই একটি ২১ ইঞ্চি টিভি। কক্ষে দুটি জানালা। একটি বাইরের দিকে, আরেকটি ভেতরে। দুটি জানালাই পর্দা দেওয়া অবস্থায় ভেতর থেকে সিটকিনি দিয়ে আটকানো। খাটের উপরের বিছানার চাদর, বালিশ সব এলোমেলো হয়ে আছে। খাটের ওপরে দুই মেয়ের লাশ এবং মেঝেতে পড়ে ছিল জেসমিন আক্তারের নিথর দেহ। এই রুম থেকে বের হয়ে হয়ে বামেই ডাইনিং রুম। ডাইনিং রুমের সঙ্গেই পাশাপাশি দুটি বেড রুম। ভেতরের মাস্টার বেডরুমে দুই মেয়েকে নিয়ে থাকতেন জেসমিন আক্তার ও হাসিবুল হাসান। তবে দিনের বেলায় জেসমিন মেয়েদের নিয়ে সামনের ড্রইং রুমে বিশ্রাম করতেন। জেসমিন ও হাসিবুলের পরিবার সদস্যরা এসব তথ্য জানিয়েছেন। জেসমিন আক্তার ও হাসিবুল হাসান প্রতিদিনের মতো সোমবার সকালেও অফিসে চলে যান। এসময় তাদের দুই মেয়ে হাসিবুলের বড় বোনের ছেলে রওশন জামিল, তার স্ত্রী রোমানা পারভীন ও নিহত জেসমিনের খালাতো বোন রেহানার সঙ্গে বাসায় ছিল। দুপুর আড়াইটার দিকে জেসমনি অফিস থেকে বাসায় চলে আসেন। তিনি দুই মেয়েকে দুপুরের খাবার খাইয়ে দেন। এরপর ড্রইং রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে মেয়েদের নিয়ে জেসমিন টিভি ছেড়ে শুয়ে পড়েন বলে জানিয়েছেন রেহেনা। এসময় রেহেনা, রওশন জামিল ও তার স্ত্রী রোমানা পাশের বেড রুমে ছিলেন। বিকাল ৫টার দিকে হাসিবুল অফিস শেষ করে বাসায় ফেরেন। তিনি গিয়ে ড্রইং রুমের দরজা বন্ধ পান। এরপর তিনি বেড রুমে বসে রেস্ট করেন। জেসমিনের মাইগ্রেন সমস্যা থাকায় তিনি ঘুমালে কেউ তাকে ডাকতেন না। তাই স্ত্রীকে তিনি না ডেকে কিছুক্ষণ পর হাসিবুল মসজিদে নামাজ পড়তে চলে যান। নামাজ পড়ে ফিরে এসেও তিনি দরজা বন্ধ পান। এরপর তিনি দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে রক্ত দেখতে পান। এরপর তিনি চিৎকার দেন। তখন বাসার অন্যরা ছুটে আসেন। জেসমিনের ভাই শাহিনুর ইসলাম এসময় বাসায় চলে আসেন। তিনিও ওই বাসায় থাকেন। এরপর শাহিনুর ও হাসিবুল দুজনে মিলে দরজা ভাঙেন। তারা দেখতে পান দুই মেয়ে খাটে এবং জেসমিন রক্তাক্ত অবস্থায় মেঝেতে পড়ে আছেন। জেসমিনের ভাই শাহিনুর এই তথ্য জানান।
তবে ড্রইং রুমের পাশের বেড রুমে থেকেও জামিল, পারভীন ও রেহেনা ঘটনার কিছুই টের পাননি বলে ঘটনার পর পুলিশ ও সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন। রেহেনা বলেন, ‘আমরা কোনোকিছু টের পাইনি। কোনও শব্দ পাইনি। ’পুলিশ জানায়, ঘটনার সময় তাদের স্বজনদের তিনজন ওই ফ্ল্যাটেই উপস্থিত ছিলেন। এদের মধ্যে নিহতের স্বামীর ভাগিনা রওশন জামিল এবং তার স্ত্রী রোমানা পারভীন ও নিহত জেসমিনের খালাতো বোন রেহানা বাসায় ছিলেন। রওশান জামিল ও তার স্ত্রী বাসাটিতে সাবলেট থাকেন। তারা পাশের রুমে শুয়ে ছিলেন। কিন্তু তারা কেউই কোনও ধরনের চিৎকারের শব্দ শোনেননি বলে প্রাথমিকভাবে পুলিশকে জানান।
নিহত জেসমিনের ছোট ভাই শাহিনুর ইসলাম ওই বাসাতেই থাকেন। ঘটনার সময় তিনি খালাতো বোন রেহেনার জন্য বাসের টিকিট কিনতে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমার বোন যে এতকিছু করতে পারে, এটা আমার ধারণায় ছিল না। দুই ঘণ্টায় একটা রুমের ভেতরে দরজা বন্ধ করে দুটি বাচ্চাকে ছুরি দিয়ে হত্যা করলো, অথচ কেউ কিছু জানতে পারলো না!’ তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন।
বাসার ভেতরে থেকেও কোনও শব্দ পায়নি কেউ। নিহত কারো হাত, পা, মুখও বাঁধা ছিল না। এমন নৃশংসভাবে তিনজন মানুষের মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কীভাবে তাদের মৃত্যু হলো? জেসমিন আক্তারের শরীরে বিভিন্ন জায়গায় যে জখম তা নিজে নিজে করা সম্ভব কিনা? তা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মনে। এদিকে মঙ্গলবার (১ মে) সকালে নিহত তিনজনের ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে। লাশ হাসিবুলের গ্রামের বাড়ি পঞ্চগড়ে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ময়নাতদন্ত শেষে সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সেলিম রেজা বলেন, ‘নিহত তিনজনের শরীরেই ধারালো অস্ত্রের জখম পাওয়া গেছে। ধারালো ছুরিকাঘাতে তাদের মৃত্যু হয়েছে বলেই ধারণা করা যাচ্ছে। তবে হত্যা না আত্মহত্যা সেটি ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পাওয়ার পর জানা যাবে।’তিনি বলেন, ‘মৃত্যুর আগে তাদের কোনও কিছু খাওয়ানো হয়েছিল কিনা, তা নিশ্চিত করতে তিনটি মরদেহের ভিসেরার নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। সেগুলো পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে।’ডিএমপির মিরপুর বিভাগের দারুস সালাম জোনের সিনিয়র সহকারী কমিশনার (এসি) জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘ঘটনাস্থলে পারিপার্শ্বিক সব বিষয়ে বিবেচনা করে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা যাচ্ছে— দুই শিশুকে হত্যার পর তাদের মা নিজে আত্মহত্যা করেছেন। তবে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন হাতে পেলে বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে বলা যাবে।’এছাড়া কী কী কারণে হত্যার ঘটনা ঘটতে পারে, এসব বিষয় বিবেচনায় রেখেই ঘটনাটি তদন্ত করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।