মুখ খুললেন জেনারেল মইন ও ব্রিগেডিয়ার বারী
বহুল আলোচিত ২০০৭ সালের ‘এক/এগারো’র আবির্ভাব সংঘটনের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে মুখ খুলেছেন তদানীন্তন সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদ ও ডিজিএফআইর ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফজলুল বারী। দীর্ঘ নীরবতা অবলম্বনের পর ঘটনা সম্পর্কে তারা যা বলেছেন, তাতে জানা যায়, জেনারেল মইন উ আহমেদ কোনো অবস্থাতেই দেশে সামরিক শাসন জারির পক্ষে ছিলেন না। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বারী বলেছেন, দেশের প্রতি প্রবল মমত্ববোধ থেকেই তিনি জরুরি অবস্থা জারির উদ্যোগ নিয়েছিলেন। প্রথম আলোর ঈদ সংখ্যায় তাদের দুজনের সাক্ষাৎকার থেকে এসব তথ্য জানা যায়। ইমারজেন্সি নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মইন উ আহমেদ বলেন, ‘আমরা না। প্রেসিডেন্ট এটা করলেন। উই আর নো অথরিটি। প্রেসিডেন্টকে বলেছি দিস ইজ দ্য সিচুয়েশন, দিস আর দ্য ওয়েস। ফর ফেয়ার অ্যান্ড ক্রেডিবল ইলেকশন, হ্যাভ আ ফ্রেশ কেয়ারটেকার গভর্নমেন্ট, আপনি ইমারজেন্সি দেন। ট্রুপস তো অলরেডি ডেপ্লয়েড আছেই।’ মইন বলেন, ‘যেদিন প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হ্যান্ডওভার করা হয়, সেদিনই ট্রাবল শুরু হয়ে গিয়েছিল। এমনকি এর আগে থেকেই। নিশ্চয়ই স্মরণ আছে, বায়তুল মোকাররমের ওখানে মানুষকে কীভাবে পাড়িয়ে মেরেছিল? আমার কাছে এত খারাপ লেগেছে? ইট ওয়াজ সো ব্যাড। সন্ধ্যার সময় গিয়ে, আই হ্যাভ সিন দ্যাট সিন। পশু পশুকে যেভাবে মারে, মানুষ মানুষকে সেভাবে পাড়িয়ে মারছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, হোল ওয়ার্ল্ড এই সিন দেখেছে। দেশ একটা বিপজ্জনক পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। ২২ জানুয়ারি যে ইলেকশনটা হওয়ার কথা ছিল, ওটা হলে তো সর্বনাশ হয়ে যেত। ওরা (আওয়ামী লীগ) তো বলেছিল পুরো দেশ বন্ধ করে দেবে। বাট লেট মি টেল ইউ, আই হ্যাভ নো ইনটেনশন টু ইন্টারভিন। বিলিভ মি। এটা আস্তে আস্তে গ্রো করা শুরু করল। ওয়ান অব মাই সিনিয়র অফিসার্স কেইম টু মি। বলল, এসব ঘটেছে, উই কান্ট সিট আইডল। আমি তাকে বললাম, ইউ হ্যাড নো রাইট টু স্পিক লাইক দ্যাট। তুমি এটা বলেছ এবং দ্যাটস দ্য অ্যান্ড অব ইট। ডোন্ট এভার ট্রাই অ্যাগেইন। বলেছি এ কথা। সে চলে গেছে। বেশ কিছুদিন পর আবার আসছে। বলে, স্যার অল অফিসার্স আর…। আমি অন্যদের সঙ্গে কথা বলেছি, সিনিয়র অফিসার যারা ছিল। থার্ড টাইম হি টোল্ড…। তারপর তো সব দেখেশুনে…। তারপর, এরা ইলেকশন করবে না, প্রেসিডেন্টও বলল, আমি কী করব। এসব দেখে শুনে আস্তে আস্তে ইট স্টার্টেড বিল্ডিং আপ ইন মাই মাইন্ড।’
তিনি বলেন, ‘দুই পার্টি, দে ওয়ার নট কামিং টু অ্যানি শর্ট অব আন্ডারস্টান্ডিং। ইলেকশন হবেই। ইলেকশন হলেই তো বোঝেন, ওয়ানসাইডেড ইলেকশন হতো। অন গ্রাউন্ড আওয়ামী লীগ ওয়াজ ভেরি পাওয়ারফুল। অর্গানাইজেশন-ওয়াইজ গ্রাসরুট লেভেল থেকে স্ট্রং। ইউএন থেকে কিন্তু আরেকটা সাইড ছিল। ওরা বলল, তোমরা দেশের অবস্থা ঠিক কর। তোমাদের দেশে পিপল আর ইন ইন ট্রাবল। তোমরা কি পিসকিপিং করবা? সো উই উইল হ্যাভ টু টেক সাম অ্যাকশন অ্যাবাউট দ্য পিসকিপার্স হু আর নাউ ওয়ার্কিং অ্যাব্রড। দেখলাম, যদি এটা হয়, ট্রুপস উইল টেক ইট ভেরি নেগেটিভলি। একজন সৈনিক রিটায়ার্ড করলে যে টাকা পায়, তার চেয়ে বেশি টাকা পায় পিসকিপিংয়ে গেলে এক বছরে। এটা একটা লাইফটাইম সুযোগ। এসব দেখে ভাবলাম… লেটস হ্যাভ আ ফেয়ার অ্যান্ড ক্রেডিবল ইলেকশন অ্যান্ড গেট আউট।’ তিনি বলেন, ‘২২ জানুয়ারি যে ইলেকশনটা হওয়ার কথা ছিল, ওটা হলে তো সর্বনাশ হয়ে যেত। ওটা হলে আফটার এফেক্টটা দেখেন কী হতো? ওরা (আওয়ামী লীগ) তো বলেছিল পুরো দেশ বন্ধ করে দেবে। বঙ্গভবনে গেলাম। সেখানে প্রেসিডেন্ট নিজেই বলেছেন, হু উইল বি দ্য চিফ অ্যাডভাইজার? সে সময় ডিসকাশনে ড. ইউনূসের নাম আসে। কিন্তু তিনি স্বল্পমেয়াদি সময়ের জন্য রাজি হলেন না। যদিও উনাকে বলা হয়েছিল দুই বছরের। এর পরও না। দ্বিতীয় নাম এলো ড. ফখরুদ্দীনের। প্রেসিডেন্ট বলেছেন, উনি ভালো। নামটি উনিই দিয়েছেন। আমি তো কাউকে চিনি না। আই ওয়াজ নেভার ইন্টারেস্টেড ইন দি আউটসাইড ওয়ার্ল্ড। রাত সাড়ে ১২টায় তাকে ফোন করা হলো। তিনি শুনে সময় নিলেন। বললেন, তার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে নেবেন। বললাম, আচ্ছা স্যার, উই আর অল ওয়েটিং হিয়ার। বললেন, আধা ঘণ্টা। ওকে, বললাম। আধা ঘণ্টা পর উনি ফোন করলেন, অ্যাকসেপ্ট করলেন।’ মইন উ আহমেদ বলেন, ‘১২ তারিখ ১০টায় উনি এসে আমাদের সঙ্গে মিটিং করলেন, ইন চিফ অ্যাডভাইজার্স অফিস। ওখানে এলাম, কথাবার্তা হলো। আই ক্লিয়ারলি সেইড, ইউ আর এভরিথিং। উই উইল নট বদার ইউ। এবং আমাদের ফার্স্ট কথা হলো, কেয়ারটেকার গভর্নমেন্ট উইল হ্যান্ডওভার পাওয়ার টু দি ইলেকটেড গভর্নমেন্ট, উইল টেক কেয়ার অব দ্য করাপশন ইন দ্য শর্টটাইম। পাঁচটা পয়েন্ট বলেছিলাম, নোবডি ইন ইয়োর ক্যাবিনেট উইল ইনডালজ ইন অ্যানি শর্ট অব করাপশন। ইফ হি ডাজ, হি উইল বি টেকেন টু টাস্ক ইমিডিয়েটলি। পাঁচটা পয়েন্ট আমার এখন স্মরণ নাই। হি মোর অর লেস অ্যাগ্রিড। বললাম, ভালো এবং এফিশিয়েন্ট এ রকম লোক আমাদের চাই, ১০ জন। তো খোঁজা শুরু হলো। এর মধ্যে শুরু হলো মানুষের টেলিফোন। এভরিবডি ওয়াজ সেয়িং, হি হ্যাজ কোয়ালিটি টু বিকাম অ্যাডভাইজার। যা হোক, অ্যাডভাইজাররা তো হ্যান্ডপিকড। যাদের সিলেক্ট করা হয়েছে, দে আর গুড পিপল। দোজ হু কুড নট শো দেয়ার এফিশয়েন্সি, আফটার ওয়ান ইয়ার উই ড্রপড দেম। যেমন একজন অ্যাগ্রিকালচার অ্যাডভাইজার ছিলেন। এ রকম ভালো লোক আমাদের দেশে আছে? বেশ বয়স হয়েছে। পায়ে একটা প্রবলেম ছিল। উনি ভোররাতে ডিস্ট্রিবিউশন পয়েন্টে চলে যেতেন। গিয়ে ওই পয়েন্টে দাঁড়াইয়া থাকতেন। ইন ফ্রন্ট অব হিম, চুরিটুরি বন্ধ। হি ওয়াজ হার্ডওয়ার্কিং। মাই হ্যাটস অব টু হিম।’
এক/এগারোর সময় ক্ষমতার পালাবদলে ডিজিএফআইর ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফজলুল বারীর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সেদিন বঙ্গভবনে গিয়েছিলেন সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদের সঙ্গে। দীর্ঘদিন পর সেদিনের প্রেক্ষাপট নিয়ে তিনিও বলেছেন অজানা অনেক কথা। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বারী বলেছেন, তিনি নিজেই বিভিন্নভাবে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদকে ইমারজেন্সি দেওয়ার ব্যাপারে প্ররোচিত করেছেন। তবে এ ব্যাপারে সেনাপ্রধানেরও লুকানো ইচ্ছা ছিল। তিনিও সময়-সুযোগ খুঁজছিলেন। শুরুর দিকে তৎকালীন নাইন ডিভের জিওসি মেজর জেনারেল মাসুদ উদ্দীন আহমেদকে দিয়ে ইমারজেন্সির ব্যাপারে ইঙ্গিত দেওয়ানো হলেও তিনি ভালোভাবে সায় দেননি। মেজর জেনারেল মাসুদ বেগম খালেদা জিয়ার আত্মীয় হওয়ার কারণেই হয়তো সেনাপ্রধান শুরুতে তাকে ভরসা করতে পারেননি। যদিও পরে জেনারেল মাসুদকেই ভরসা করেছেন তিনি। ব্রিগেডিয়ার বারী বলেছেন, ততদিনে সিটুয়েশন ভোলাটাইল হয়ে গেছে। ইমারজেন্সি দেওয়ার জন্য আমি জেনারেল মাসুদকে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনিও সায় দিলেন। বললেন, কিছু একটা করা দরকার। কয়েকদিন পরপরই আমি উনাকে বলি স্যার, চিফের কাছে যান। আলাপ-টালাপ করেন। এভাবে দেশ চলতে পারে না। কয়েকদিন পর তিনি বলেন, হ্যাঁ, চিফের কাছে গেছিলাম, ‘হালকা উঠাইছি, উনি তো এদিকে যায় না। মানে ডরায়, কথা বলতে চায় না।’
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বারী বলেন, ‘কিছুদিন পর আমার ডিজি গেলেন ইউকে (ব্রিটেন)। সিচুয়েশন একদম পিকে। আমি অ্যাকটিং ডিজি। আমি গিয়ে উনাকে সিচুয়েশন ন্যারেট করলাম। তারপর উনি নিজে থেকেই বললেন যে, দেশের কী অবস্থা? বললাম স্যার দেশের অবস্থা এখন তো আর লুকানো নাই। মিডিয়া তো সবকিছু পাবলিশ করে। কোনো কিছু গোপন থাকে না। দেখছেন তো আপনি প্রতিদিন কী হচ্ছে না হচ্ছে। তোমার কী অভিমত— সেনাপ্রধানের এমন প্রশ্নের উত্তরে আমি বলছিলাম, এটা থেকে নরমালসি আনতে হলে প্রেসিডেন্টকে ইমারজেন্সির জন্য বলতে হবে। সেনাপ্রধান জানতে চাইলেন, অন্যরা কী বলে? আর্মির অ্যাটিচুড কী? আমি বললাম, সেনাপ্রধান যা করবে, তারা তো আর বাইরে থাকবে না। সেনাপ্রধানের চিন্তাটা তো আসবে সেখান থেকেই, দেশের সাধারণ মানুষের অবস্থা থেকে। তুমি আর্মির কাছে গিয়ে খোঁজ নাও। আই টকড টু অল কমান্ডারস, জিওসিস। দু-এক জন ছাড়া, যাদের সঙ্গে আমার ভালো ইয়ে নাই। সবাই ওপিনিয়ন দিয়েছিলেন, কিছু একটা করা দরকার। বাট নো মার্শাল ল। কেয়ারটেকার গভর্নমেন্টের চিফ হওয়ার জন্য আমরা ড. ইউনূসকে বললাম। তিনি সায় দেননি। ইমারজেন্সি প্রক্লেমেশনের জন্য বঙ্গবন্ধু আমলের এবং এরশাদ সাহেবের আমলের গেজেট একসঙ্গে করে মডারেট ভার্সন তৈরি করেছিলাম।’
ইমারজেন্সির আগের রাতে আর্মি চিফের ফোনের প্রসঙ্গ টেনে ব্রিগেডিয়ার বারী বলেছেন, ‘১০ তারিখ রাতে চিফের সঙ্গে আমার কথা হয়, অ্যাজ ইউজুয়াল, ডিজিএফআইর অ্যাকটিং চিফ হিসেবে। তিনি বললেন, বারী একটা জিনিস তো পাওয়া গেছে। ইমারজেন্সি ডিক্লেয়ার করার পক্ষে শক্ত একটা ডকুমেন্ট— ইউএন মিশনে বাংলাদেশ থেকে সৈনিকদের আর নেবে না। এটা তো একটা বড় প্লি আমাদের জন্য। এইমটা তো ইমারজেন্সি না, এইম হলো পিস রি-এস্টাবলিশ করা। এর পরই আমি জেনারেল মাসুদকে চিফের ফোনের বিষয়টি অবগত করলাম। বললাম স্যার আপনি তাড়াতাড়ি আসেন। রাতেই তিনি আমার অফিসে এলেন। বললেন আমিনকে ডাকো (ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ টি এম আমিন)।’ বারী বলেন, ‘আমিন-মইন— সাধারণ মানুষের সঙ্গে এদের কোনো সম্পর্ক ছিল না। এরা পড়াশোনা করেছে আইসোলেটেড স্কুলে। আমিনের ফাদার সম্ভবত ফরেন মিনিস্ট্রিতে ছিল, বিদেশে ঘুইরা বেড়াইছে। সাধারণ ছেলেদের সঙ্গে বসে যে ক্লাস করা, পালস বোঝা, গ্রামে কাদার মধ্যে লুঙ্গি উঠাইয়া আসা এ রকম তো দেখে নাই। যার ফলে তারা ফুটপাথে বাড়ি দিয়া উঠায়া দাও, মার্শাল ল কইরা ফেলো, ভাইঙ্গা ফেলো এই টাইপের অ্যাটিচুড। টকশো বন্ধ করে দাও। আমি সেনাপ্রধানকে বললাম, স্যার এগুলো বন্ধ করবেন না। মানুষকে কথা বলতে দিতে হবে। ভালো করলে বলবে, খারাপ করলেও বলবে। আমাদের বক্তব্য আমরা দেব। মানুষ তো খারাপ বলে নাই প্রথম দিকে।’ এক/এগারোর দিন বঙ্গভবনের বিষয়টির অবতারণা করে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বারী বলেন, ‘ওইদিন বঙ্গভবনে আইনশৃঙ্খলা কমিটির মিটিংয়ের পর সেনাপ্রধানসহ বাহিনীর প্রধানরা এলেন। সেনাপ্রধানের বক্তব্যের পর রাষ্ট্রপতি বললেন, কী করা? উনি বললেন, ইমারজেন্সি দেওয়া। আমাকে পদত্যাগ করতে হবে নাকি? রাষ্ট্রপতির এমন প্রশ্নে সেনাপ্রধান বললেন, না আপনাকে প্রেসিডেন্টশিপ থেকে পদত্যাগ করতে হবে না। বাট অ্যাজ কেয়ারটেকার চিফ ইউ হ্যাভ টু রিজাইন।’ ড. ইউনূসের প্রসঙ্গে বারী বলেছেন, ‘কেয়ারটেকার গভর্নমেন্টের চিফের প্রস্তাব দিয়ে মেজর জেনারেল মাসুদ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমিনকে নিয়ে ড. ইউনূসের কাছে গিয়েছিলেন। উনার প্রথম কথা ছিল টাইমফ্রেম কতদিনের জন্য? উনি বললেন, কম সময় যদি হয় তাহলে কোনো পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে না। এরপর এলো ফখরুদ্দীনের নাম। আমি নিজেই উনাকে ফোন করেছিলাম।’