‘মূর্খ দেখলে নয়, ধূর্ত দেখলে আতঙ্কগ্রস্ত হই’
স্মৃতিকথায় লিখেছিলাম আমার অভিজ্ঞতা নিয়ে। এক টুকরো স্মৃতি তুলে ধরছি।
‘একবার ফরহাদ মজহার আমন্ত্রণ জানালেন তার এনজিও উবিনিগে, উবিনিগের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের টাকা সাহায্য জোটে মজহারের অথচ নিজে তিনি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী বলে দাবি করেন। টিএসসিতে তার গান শুনেছিলাম অনেক আগে, নিজে গান লিখতেন, সুর দিতেন, গাইতেনও। নিজে হারমোনিয়াম বাজিয়ে ঘর ভরা দর্শককে যতগুলো গান শুনিয়েছিলেন তার মধ্যে ‘সাততাড়াতাড়ি যাচ্ছি বাড়ি’ গানটি বেশ লেগেছিল। বামপন্থী গায়কটি গান টান ছেড়ে দিয়ে নিজের কবিতার বই বের করলেন। চমৎকার সব কবিতা লিখেছেন। পড়ে মুগ্ধতার শেষ নেই আমার। যাই হোক, তার আমন্ত্রণ পেয়ে সাততাড়াতাড়ি তার আফিসে গিয়ে দেখা করি। একটি মহিলা, নাম ফরিদা আখতা্র ওঠে এলেন ফরহাদ মজহারের ঘর থেকে, মনে হলো যেন শয্যা থেকে ওঠে এলেন। আমাকে বসিয়ে ভেতর-ঘরে ডাকতে গেলেন তাকে। ভেতর থেকে বেরোতে অনেকটা সময় নিলেন তিনি। চা বিস্কুট এলো। কথা চললো। কথা চললো, আসলে তিনি একাই কথা বললেন। তার নিজের কবিতার কথা বললেন, কবিতার কিছু আরবি শব্দ আমি বুঝতে পারিনি বলে তিনি আরবির অর্থ বলে দিলেন। দুর্বোধ্য আরবি শব্দ কবিতায় ব্যবহার করার কী কারণ এই প্রশ্ন করার আগেই তিনি বললেন, এ দেশের বাংলা হচ্ছে ইসলামি বাংলা, আর পশ্চিমবঙ্গের বাংলা হিন্দু বাংলা। আমাদের সংস্কৃতি ইসলামি সংস্কৃতি, আমাদের ভাষায় প্রচুর আরবি উর্দু শব্দ মেশানো উচিত ইত্যাদি ইত্যাদি। ধন্দে পাড়ি শুনে। তিনি কি আমাকে দলে টানতে চাইছেন তার এই উদ্ভট মিশনে! তা না হলে আমাকে এমন তলব করার কারণ কী! আসলেই তিনি আমাকে দলে টানতে চাইছেন। এসব আজগুবি চিন্তা নিয়ে তিনি ‘চিন্তা’ নামে একটি পত্রিকা বের করবেন, ওতে যেন লিখি আমি। ফরহাদ মজহার সম্পূর্ণই বদলে গেছেন।
এই দেশে ইসলামি মৌলবাদ যখন মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে, গুটিকয় মানুষ এর বিরুদ্ধে লড়াই করছে, গুটিকয় মানুষ চাইছে বাঙালি সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে– যে সংস্কৃতি হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান সকলের সংস্কৃতি, –তাকে সবলে অস্বীকার করছেন মজহার। দেশ বিভাগের ভুল সিদ্ধান্ত বাংলাকে বিভক্ত করেছে, কিন্তু পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার ভাষা ও সংস্কৃতিতে মৌলিক কোনও পার্থক্য নেই, সে যে কোনও সুস্থ মানুষই জানে। কিন্তু ফরহাদ মজহারের মতো চিন্তাবিদের এ কী হাল, সমাজতান্ত্রিক বিশ্বাস থেকে ফট করে পুঁজিবাদীদের টাকায় এনজিও খুলেছেন, এখন আবার গাইছেন ধর্মের গান! কোনও এক ফকিরের গানও শোনালেন আহা কি মধুর বলতে বলতে, ‘দীনের নবী মোস্তফা.. হরিণ একটা বান্ধা ছিল গাছেরই তলায়’। আরব দেশের মরুভূমিতে গাছও নেই, হরিণও নেই, অথচ নাকি কী অভাবনীয় কল্পনার মিশ্রণ এই গানটিতে! এই গানকেই তিনি ‘বাংলাদেশের গান’ বলছেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত হিন্দুদের গান, মুসলমানদের গান নয়, বলে দিলেন। ফরহাদ মজহারের এই মতের বিরুদ্ধে পরে আমি একটি কলাম লিখি পত্রিকায়, সঙ্গে শামসুর রাহমানের কবিতায় উর্দূ শব্দ ব্যবহার আর হুমায়ুন আজাদের রবীন্দ্রনাথ বিরোধী বক্তব্যেরও প্রতিবাদ ছিল আমার কলামে। দীর্ঘদিন আমার ওই ভাষা নিয়ে লেখাটির সূত্র ধরে পত্রিকায় লেখালেখি চলল। ফরহাদ মজহার নিজে লিখলেন। তার যুক্তি এবং ইনকিলাব পত্রিকার ছাপা হওয়া কোনও মৌলবাদির যুক্তির মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। তার যুক্তি খণ্ডন করে আরও অনেকে কলাম লিখলেন। পূরবী বসু আমেরিকার পাট চুকিয়ে দিয়ে বাংলাদেশে চলে এসেছেন, তিনি এসেই কলম ধরলেন ফরহাদ মজহারের মতের বিপক্ষে। লোকটির চরিত্র ক্রমশ সন্দেহজনক হয়ে উঠছে, তা স্বীকারও করলেন অনেকে। — শামসুর রাহমান তার লেখায় উর্দু শব্দ ব্যবহার করলেও বাঙালির ভাষার মধ্যে হিন্দু মুসলমানের ভাগ আনেন না। তিনি অসাম্প্রদায়িক মানুষ। ফরহাদ মজহারের মতো ইসলামি বাংলা কায়েম করতে চান না। আমি বিশ্বাস করি, ইসলামি ভাষা বলে কোনও ভাষা নেই। ভাষার কোনও ধর্ম নেই। আরবি ভাষাকেই বা ইসলামি ভাষা বলব কেন! আরবি ভাষার লোক নানা রকম ধর্মে বিশ্বাস করে, তার ওপর ওদের মধ্যে এমন লোকও প্রচুর, যারা কোনও ধর্মেই বিশ্বাস করে না। ভাষা আপন গতিতে চলবে, চলেছে, ভাষাকে কোনও নির্দিষ্ট ধর্মে অন্তর্ভুক্ত করা ঠিক নয়’।
‘ফরহাদ মজহার, যাকে একজন বুদ্ধিজীবী হিসেবে ধরা হয়, তিনিই যখন হিন্দুদের ওপর মুসলমানের অত্যাচারকে অত্যাচার বলতে রাজি নন এবং দাবি করেন, এই বাংলার সংস্কৃতি ইসলাম, এটিকে আমাদের রক্ষা করতে হবে, তখন আমাদের পিলে চমকে ওঠে। মূর্খ দেখলে আমরা ততটা আতঙ্কগ্রস্ত হই না, ধূর্ত দেখলে যত হই’।’
আগেই বলেছি, ফরহাদ মজহারের স্বরূপ আমার দেখা হয়ে গেছে প্রায় তিরিশ বছর আগে। গত তিরিশ বছর তিনি কী করেছেন কিছুরই খবর রাখিনি। একবার শুনেছিলাম তিনি লুঙ্গি গামছা ধরেছেন। ওগুলো পরেই নাকি তিনি বাইরে যান, টেলিভিশনে যান। বাংলাদেশকে ‘ইসলামি বাংলা’ বানানোর জন্য তিনি যে কত মরিয়া হয়ে উঠেছেন, বুঝি। আজ শুনলাম জিহাদিদের সন্ত্রাসী বললে তিনি বলেন মুক্তিযোদ্ধারাও তাহলে সন্ত্রাসী। জিহাদি এবং মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে পার্থক্য বোঝেন না তিনি! ধ্বংস আর নির্মাণের মধ্যে পার্থক্য বোঝেন না তিনি! দুঃস্বপ্ন আর স্বপ্নের মধ্যেও পার্থক্য বোঝেন না। কমিউনিস্টরা পচলে দুর্গন্ধ ছড়ায়। ফরহাদ মজহারের ‘চিন্তা’ থেকেও অনেকদিন দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।
তবে ফরহাদ মজহার যাই করুন, যাই ভাবুন, যা কিছুই তিনি বিশ্বাস করুন, যত উদ্ভটই হোক না তার বিশ্বাস — কেউ যদি তাকে সত্যিই অপহরণ করে থাকে, তাকে হেনস্থা করে থাকে- আমি তার তীব্র প্রতিবাদ করছি। বাংলা ভাষা আর বাংলা সংস্কৃতির শত্রু হলেও তাকে অপহরণ করার অধিকার বাংলার কারোর নেই। আমার সেক্যুলার বাংলা তার চরম শত্রুকেও নিরাপদ আশ্রয় দেয়, দেবে। বাংলায় বাক স্বাধীনতা থাকুক, ভিন্ন মত প্রকাশ করার অধিকার থাকুক। তা না হলে এই বাংলাকে নিয়ে আমরা গর্ব করবো কী করে!
লেখক: কলামিস্ট