যেভাবে গানে এসেছিলেন বারী সিদ্দিকী
হুমায়ূন স্যার প্রতিভা তৈরি করতেন। তিনি যেমন নিজে ছিলেন অসম্ভব প্রতিভাবান, তেমনি প্রতিভা গড়ার কারিগরও ছিলেন। তাই তার শিল্পানুসন্ধিৎসু মন দিয়ে অনেক আড়ালের প্রতিভাকেও খুঁজে বের করে শীর্ষে নিয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৯৭ সনে এভাবেই বারী সিদ্দিকীকে খুঁজে বের করেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ স্যার। বিটিভির জন্য স্যারের নির্মিত ‘জলসাঘর’ অনুষ্ঠানে রেকর্ডিঙে বারীভাইকে বাঁশি বাজানোর জন্য নিয়ে আসা হয়েছিল। শান্তিনগরের ‘সাসটেইন’ নামের সেই স্টুডিওতে ওই অনুষ্ঠানের জন্য গান রেকর্ড করছিলেন স্যার। দিলরুবা খান, বেবী নাজনীন, আমি, বন্ধু সেলিম চৌধুরী সহ আরো বিখ্যাত কয়েকজন শিল্পী ছিলাম ওই অনুষ্ঠানের তালিকাভূক্ত শিল্পী। যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে স্টুডিওর ভেতরেই বারীভাই তার উদাসী কণ্ঠে খালি গলায় দরদী কণ্ঠে প্রথম গান শুনিয়েছিলেন। স্টুডিওতে যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে আমরা বাইরে এসে হাঁটাহাঁটি করছি। এমন সময় বারী ভাই তার বিখ্যাত ‘আমার গায়ে যত দুঃখ’ গানটি গুনগুনিয়ে গেয়ে শোনান। আমরা তাকে আরো গান গাওয়ার জন্য অনুরোধ জানালে তিনি কিঞ্চিৎ লজ্জা পান। তিনি উকিল মুন্সীর আরো একটি গান করেন খোলা গলায়। স্টুডির ত্রুটি সারার পর আবার আমরা স্টুডিওতে চলে যাই। বারীভাইয়ের গানের প্রসঙ্গ আমরাই স্যারকে প্রথম অবগত করেছিলাম অনুষ্ঠানের কিছুদিন পরে। বিটিভির জলসাঘরে শাহ আবদুল করিমের গান যখন আমাদের কণ্ঠে রেকর্ডিং হয়েছিল তখন বারী সিদ্দিকী ওই অনুষ্ঠানে বাঁশি বাজিয়েছিলেন। এর আগ পর্যন্ত তাকে গান গাইতে দেখা যায়নি। মরমী বাউলগানের সঙ্গে তার কী মোহন যাদুর বাঁশি! বাঁশি বজিয়ে তিনি বেশ সুনামও কুড়ান।
রেকর্ডিঙের এক ফাঁকে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিলে আমরা রেকর্ডিং-স্টুডিওতেই আড্ডা দিচ্ছিলাম। এ-সময় বারী সিদ্দিকী আমাদের গান শোনান। তাঁর ভরাট কণ্ঠে ফোকগান শুনে আমরা মুগ্ধ হয়ে যাই। কী দরদ! কিছুদিন পরে আমি আর বন্ধু সেলিম চৌধুরী হুমায়ূন স্যারকে বারীভাইয়ের মধুর কণ্ঠের গান পরিবেশনের বিষয়টি অবগত করি। বলি, স্যার বারীভাই তো খুব সুন্দর মরমী গান করেন। সেদিনের ঘটনা খুলে বলি স্যারকে। শুনে তিনি বলেছিলেন, তাই নাকি? তাহলে একদিন হয়ে যাক! স্যার হঠাৎ একদিন বারীভাইয়ের গান শোনার জন্য প্রস্তুতি নিলেন। প্রথমে ঘরোয়া আড্ডায় গান শোনান বারীভাই। আড্ডায় গান শোনার পর তিনি একদিন তার দখিনা হাওয়ার বাসার ছাদে বারীভাইয়ের একক সংগীতসন্ধ্যার আয়োজন করেন। অনুষ্ঠানে হুমায়ূন স্যার তার পরিচিত বন্ধুবান্ধব ও বিশিষ্টজনদের আমন্ত্রণও জানান। আমি আর সেলিমও সেই আমন্ত্রণ পাই। আমাদের ভালো লাগার কারণটাও ছিল আনন্দের। কারণ বিটিভির জলসাঘরের যান্ত্রিক ত্রুটিতে পড়ে বারীভাইয়ের গান শুনেই প্রসঙ্গটি স্যারকে অবগত করেছিলাম। পরে স্যারও বারীভাইয়ের কণ্ঠের প্রেমে পড়েন। ওইদিন কলজে-ছেঁড়া অনেক বিচ্ছেদী গান ও বাউল মহাজনদের গান শুনিয়েছিলেন বারীভাই। বোদ্ধা শ্রোতাদের তন্ময় করেছিলেন। এই অনুষ্ঠানেই তিনি, হুমায়ূন আহমেদ, বারীভাইকে নিয়ে নাটক-সিনেমায় গান করার কথা জানিয়েছিলেন। যার ফলে স্যারের সাড়াজাগানো ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ ছবিতে তাঁকে সুযোগ দেন। তিনি এ-ছবিতে গান গেয়ে ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা পান। আজ বারীভাই নেই। কিন্তু সেদিনের স্মৃতি এখনো আমার চোখে ভাসছে। তার আত্মার শান্তি কামনা করি।