বার্তা ডেক্সঃঃঢাবি শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ মামলায় একমাত্র আসামি মজনুকে যাবজ্জীবন সাজা দিয়েছেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল। রায় ঘোষণার আগে এদিন মজনুকে আদালতে হাজির করা হলে শুরু থেকেই তিনি ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেছেন। আদালত প্রাঙ্গণে তিনি সাংবাদিকদের দেখে দাবি করতে থাকেন, তিনি নির্দোষ। রায় ঘোষণার পর আদালত থেকে বের করার সময়ও তিনি একই রকম আচরণ করেন। একপর্যায়ে তিনি বিচারক, আইনজীবী, পুলিশসহ সবাইকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকেন। এসময় পুলিশকে কামড়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করেন তিনি। বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্যকেও তাকে সামলাতে বেগ পেতে হয়।
বৃহস্পতিবার (১৯ নভেম্বর) বিকেল ৩টার কিছু পরে ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ এর বিচারক বেগম মোসা. কামরুন্নাহার আসামি মজনুর উপস্থিততে রায় ঘোষণা করেন। রায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পাশাপাশি ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদণ্ডের সাজা দেন আদালত। রায় ঘোষণার আগে দুপুর আড়াইটার দিকে আদালতে ওঠানো হয় মজনুকে। আদালত কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হলে চিৎকার-চেঁচামেচি করতে থাকেন তিনি। কাঠগড়ায় পুলিশকে মারধর করেন বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কাঠগড়ায় তোলার পর পরই মজনু সেখানে দায়িত্বরত উপপরিদর্শক (এসআই) নৃপেনের ওপর হামলা চালায়। মজনু এসআইয়ের গলা চেপে ধরে কিল-ঘুষি মারেন। তখন অন্য পুলিশ সদস্যরা এসে এসআই নৃপেনকে সরিয়ে নেন। এ ছাড়া মজনু সেখানে দায়িত্বরত অন্য পুলিশ সদস্যদের গালাগালি করেন। তখন আদালত কক্ষের মধ্যে একটি বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি হয়। এসময় মজনু বলেন, আমারে ছাইড়া দেন। আমি মা’র কাছে যাব। আমাকে মারলে আল্লাহ বিচার করবে। আমাকে মিথ্যা মামলা দিয়ে ফাঁসাই দিয়েছে। আমার শরীল খুব দুর্বল। আমাকে এক বছর ধরে অত্যাচার করছে। মজনু বলেন, আমি মারামারি করি না, নেশা-পানি করি না। আমারে ছাইড়া দেন। আমি রিশকা চালিয়ে খাব। আমার মা খুব অসুস্থ, আমার মায়ের কাছে কেউ নাই। আমারে ছেড়ে দেন। আমারে ওরা অনেক অত্যাচার করছে, মশার কামুর খাওয়াইছে।
আত্মহত্যার হুমকি দিয়ে মজনু বলেন, কারাগারে মানুষ বেচাকেনা করা হয়। আমার পক্ষে কেউ নাই। আমি এতিম। আমারে ছাইড়া দেন। আমি বিল্ডিং থেকে লাফ দিয়া মইরা যামু। আমারে ছাইড়া দেন। এসময় মজনু সাংবাদিকের সামনে চার জনের নাম উল্লেখ করে তারা এই ধর্ষণে জড়িত বলে দাবি করেন। একইসঙ্গে বিভিন্ন ধরনের অসংলগ্ন কথাবার্তাও বলতে থাকেন। বিকেল ৩টা ২ মিনিটে বিচারক এজলাসে ওঠেন। তিনি রায় পড়তে শুরু করেন। ওই সময়ও আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়ানো মজনু চিৎকার করেই যাচ্ছিলেন। এর মধ্যেই আদালত রায় ঘোষণা করলে মজনু কান্নায় ভেঙে পড়েন। কান্না সামলে আবার চিৎকার করতে থাকেন। রায় ঘোষণা শেষ হলে মজনুকে আদালত থেকে বের করার সময় তিনি ছোটাছুটি করার চেষ্টা করছিলেন। চার-পাঁচ জন পুলিশ সদস্যের পক্ষেও তাকে আটকে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছিল। একপর্যায়ে তিনি পুলিশের হাত কামড়ে দিয়ে পালিয়ে যাওয়ারও চেষ্টা করেন। শেষ পর্যন্তে টেনে-হিঁচড়ে তাকে প্রিজন ভ্যানে তোলা হয়।
আদালত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মামলাটি মোট ১৩ কার্যদিবস পরিচালিত হয়ে রায়ের পর্যায়ে উপনীত হয়। মামলার বিভিন্ন পর্যায়ের শুনানিতে এর আগেও হাজির করা হয়েছিল মজনুকে। তিনি বরাবরই আদালতে হাজির হলে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেছেন, গালিগালাজ করেছেন। মামলার কার্যক্রম যতই এগিয়েছে, মজনু তত বেশি অসংলগ্ন ও মরিয়া হয়ে উঠেছেন। বিকেল ৩টার পর রায়ে আদালত বলেন, ‘আসামি মজনু শেওড়া বটতলা এলাকায় ভাসমান খিলক্ষেত, ঢাকার বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত-২০০৩)-এর ৯ (১) ধারা মতে, রাষ্ট্রপক্ষের আনীত অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় তাঁকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের এ ধারায় দোষী সাব্যস্ত পূর্বক যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অনাদায়ে আরো ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হলো।’ ‘এ ছাড়া আসামি মজনুর বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩৯৪ ও ৪১১ ধারার ছিনতাই ও চুরির অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় উক্ত ধারার অভিযোগ হতে তাঁকে বেকসুর খালাস দেওয়া হলো। রায়ে আদালত বলেন, ডকে উপস্থিত হাজতি আসামির বিরুদ্ধে সাজা পরোয়ানা ইস্যু করা হোক।’
আলোচিত এই মামলায় ২৪ সাক্ষীর মধ্যে ২০ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছেন আদালত। মাত্র ১৩ কার্যদিবসে মামলাটির বিচার কার্যক্রম শেষ হয়েছে। এর আগে গত ১৬ মার্চ মজনুকে একমাত্র আসামি করে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের পরিদর্শক আবু সিদ্দিক। সে অভিযোগপত্রে তদন্ত কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, গত ৪ জানুয়ারি ওই ছাত্রী বান্ধবীর দাওয়াতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষণিকা বাসে করে তার বান্ধবীর বাসা শেওড়ার উদ্দেশে রওনা হন। সেদিন সন্ধ্যা ৭টায় ছাত্রী শেওড়া বাসস্ট্যান্ডে না নেমে কুর্মিটোলা বাসস্ট্যান্ডে নেমে যান। সে সময় ছাত্রী বুঝতে পারেন, তিনি ভুল করে নেমে পড়েছেন। ভুল বুঝতে পেরে তিনি ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে থাকেন। অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, মজনু ভবঘুরে প্রকৃতির লোক। ঢাকা শহরে তার কোনো স্থায়ী বাসা নেই। ঘটনার দিন মজনু বিকেল ৫টায় কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে যান। ওষুধ নিয়ে সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় কুর্মিটোলা বাসস্ট্যান্ড থেকে একটু পূর্বদিকে যাওয়ার রাস্তার ফুটপাতের পাশে ইটের তৈরি বেঞ্চে বসে থাকেন। সন্ধ্যা ৭টায় ছাত্রী ওই ফুটপাত দিয়ে যাচ্ছিলেন। মজনু পেছন দিক থেকে হঠাৎ তাকে পাশের ঝোপের ভেতরে ফেলে দেন। তখন ছাত্রী চিৎকার করতে থাকলে মজনু গলা চেপে ধরেন এবং মুখে, বুকে ও পেটে কিল ঘুষি মারেন।
অভিযোগপত্রে আরো বলা হয়েছে, আসামি মজনু ছাত্রীর গলা চেপে ধরায় তিনি নিস্তেজ হয়ে যান। একপর্যায়ে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তখন মজনু তাকে ধর্ষণ করেন। ধর্ষণের পরে মজনু ছাত্রীর ব্যাগ থেকে একটি প্যান্ট বের করে তাকে পরিয়ে দেন। ছাত্রী জ্ঞান ফেরার পরে দেখেন তার পরনে যে প্যান্ট ছিল সেটা আর নেই। ছাত্রী তখন চলে যাওয়ার চেষ্টা করলে মজনু টাকা, মোবাইল ফোন ও ব্যাগ ছিনতাইয়ের জন্য গলা চেপে ধরেন এবং কিল-ঘুষি মারেন। একপর্যায়ে মজনু ছাত্রীর কাছ থেকে দুই হাজার টাকা, মোবাইল ফোন ও ব্যাগ ছিনিয়ে নেন। এরপর ছাত্রী দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে একটি রিকশায় ওঠেন এবং তার বান্ধবীর বাসায় যান। বান্ধবীকে বিষয়টি জানালে ছাত্রীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে ভর্তি করা হয়।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, এরপর ধর্ষণের শিকার ছাত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ২২ ধারায় আদালতে জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়। ঘটনাস্থলে পাওয়া আলামত, ছাত্রীর পরা প্যান্ট, ছাত্রী ও আসামির নমুনা সংগ্রহ করে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) চিফ ডিএনএ অ্যানালিস্টের কাছে পাঠানো হয়। পর্যালোচনায় দেখা যায়, মজনু ও ছাত্রীর ডিএনএ উপস্থিত আছে। যাতে প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয় যে, আসামি মজনু ছাত্রীকে ধর্ষণ করেছেন।
সংবাদ টি পড়া হয়েছে :
৫৩ বার