শতাধিক মামলার জালে খালেদা পরিবার
জিয়া অরফানেজ ও চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়ার ‘সাজার’ আশঙ্কা করছেন দলের আইনজীবীসহ নেতাকর্মীরা। জিয়া পরিবারের বড় ছেলে ও বিএনপি’র সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান দীর্ঘদিন থেকেই অবস্থান করছেন লন্ডনে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট, ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা, কর ফাঁকি, রাষ্ট্রদ্রোহ ও মানহানির অভিযোগে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় তার বিরুদ্ধে রয়েছে একশ’র বেশি মামলা। এর মধ্যে ওয়ান-ইলেভেনের জরুরি সরকারের আমলেই দায়ের করা হয় ১২টি মামলা।
বাকি মামলাগুলো দায়ের হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে কটূক্তির অভিযোগে দেশের অনেক জেলায় মামলা দায়ের হওয়ায় সে সংখ্যা বেড়ে একশ’ পেরোয়। বেশির ভাগ মামলায় চার্জশিট দিয়েছে পুলিশ। ইতিমধ্যে অর্থ পাচারের একটি মামলায় তার বিরুদ্ধে সাজাও হয়েছে। গ্রেনেড হামলার ঘটনায় দু’টি মামলার সম্পূরক অভিযোগপত্রে তারেক রহমানকে আসামি করা হয়। মামলা দুইটির বিচারকাজ এখন শেষ পর্যায়ে। তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমানের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়-বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকের মামলা চলছে।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে তিনি জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনে তার স্বামী তারেক রহমানকে সহযোগিতা করেছেন। উচ্চ আদালত তাকে সময়সীমা বেঁধে দিয়ে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিলেও তিনি যুক্তরাজ্যে অবস্থান করায় আত্মসমর্পণ করেননি। জিয়া পরিবারের ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো ২০০৮ সালের ১৭ই জুলাই থেকেই অবস্থান করছিলেন থাইল্যান্ডে। পরে ২০১১ সালে সেখান থেকে সপরিবারে মালয়েশিয়া চলে যান। ৭ মামলা ও মুদ্রা পাচারের মামলায় ৬ বছরের সাজা মাথায় নিয়ে ২০১৫ সালে মালয়েশিয়াতেই মৃত্যুবরণ করেন কোকো।
এছাড়া তারেক রহমানের শাশুড়ি ইকবাল আর্জুমান্দ বানু, খালেদা জিয়ার ভাগ্নে সাইফুল ইসলাম ডিউক, খালেদা জিয়ার ভাইয়ের বউ নাসরিন আহমেদ, ভাতিজা-ভাতিজি শামস এস্কান্দার, সাফিন এস্কান্দার, সুমাইয়া এস্কান্দার নানা মামলার আসামি। বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তর, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের আইনজীবীরা এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
আইনজীবী সূত্র জানায়, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলাগুলোর মধ্যে রয়েছে- বিশেষ মামলা-১৬/০৮ (তেজগাঁও), বিশেষ মামলা-৪/১০ (তেজগাঁও), বিশেষ মামলা নং-৩০/১২ (তেজগাঁও) বিশেষ মামলা নং-৩/১০ (রমনা), বিশেষ মামলা নং-১০/০৮ (শাহবাগ), মামলা নং-৫৮(১)১৫ (যাত্রাবাড়ী), মামলা নং-৫৮(১)১৫ (যাত্রাবাড়ী), বিশেষ ক্ষমতা আইন মামলা নং-৫৯(১)১৫ (যাত্রাবাড়ী), মামলা নং-২৫ (গুলশান), মামলা নং-৩(২)১৫ (ফুলতলা), মামলা নং-৪(২)১৫ (চৌদ্দগ্রাম), মামলা নং-৫(২)১৫ (চৌদ্দগ্রাম), অর্থঋণ মামলা নং-২৩৭/১২, জিয়া চ্যারিটাবল ট্রাস্ট মামলা নং-৫/১৩, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা নং-৩/০৯, সি আর মামলা নং-২৩/১৬ এবং সি আর মামলা নং-১০/১৫।
আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর পর খেলাপি ঋণ দেওয়ানি কর্মবিধি আইনে সোনালী ব্যাংকে ড্যান্ডি ডাইংয়ের ৪৫ কোটি টাকা ঋণখেলাপি মামলায় খালেদা জিয়া, কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান ও দুই মেয়ে জাফিয়া রহমান ও জাহিয়া রহমানকে আসামি করেছেন আদালত। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলাগুলোর মধ্যে রয়েছে- মামলা নং-২(৪)৭ (ধানমন্ডি), মামলা নং-৫৬(৪)৭ (ধানমন্ডি), মামলা নং-১২/০৭ (ধানমন্ডি), মামলা নং-১০৩/০৭ (গুলশান), মামলা নং-১৩(৫)৭ (গুলশান), মামলা নং-৩৮(৫)৭ গুলশান মামলা নং-১০২/০৭ (গুলশান), মামলা নং-১০১(৫)৭ (গুলশান), মামলা নং-৬৮/০৮ (কাফরুল), বিশেষ মামলা নং-১৭/৯, সি আর মামলা নং-৩৮০/১৪, সি আর মামলা নং-৬১৭/১৪, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে সিআর মামলা নং-১৯৬/১৫ এবং সিআর মামলা নং-৭২০/১৪।
বিএনপি’র আইনবিষয়ক সম্পাদক ও জিয়া পরিবারের আইনজীবী এডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, বর্তমানে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ৩৫টি, সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে শতাধিক, ডা. জোবাইদা রহমানের বিরুদ্ধে দুইটিসহ জিয়া পরিবারের প্রতিটি সদস্য এবং তাদের আত্মীয়-স্বজনদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে বেশির ভাগ মামলায় চার্জশিট দিয়েছে পুলিশ। আইনজীবীরা জানান, অর্থ পাচার মামলায় সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাত বছর সাজা হওয়ায় আগামী নির্বাচনে অংশ নেয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে তার। দেশে এসে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার পর রায় স্থগিত হলেই কেবল নির্বাচন করার যোগ্য হবেন তিনি। সিনিয়র নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা ও দ্রুত বিচার আইনে মামলা নিয়ে দুশ্চিন্তায় বিএনপি’র হাইকমান্ড।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এসব মামলার রায়ে নেতারা চূড়ান্তভাবে দোষী সাব্যস্ত হলে দল হুমকির মুখে পড়বে। নিম্ন আদালতের সাজা আপিলে বহাল হলে সংশ্লিষ্টরা অংশগ্রহণ করতে পারবেন না নির্বাচনে। দ্রুত বিচার আইনে সাজা বাড়ানোর সরকারি সিদ্ধান্তের পর এটাকে বিরোধী দলকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বিএনপি নেতাদের অভিযোগ খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ দলের সিনিয়র নেতাদের নামে দায়ের করা মামলার কার্যক্রম সরকার দ্রুতগতিতে শেষ করতে চাচ্ছে। সিনিয়র অনেক নেতার নামে চার্জশিট দেয়া হয়েছে। কোন কোন মামলার সাক্ষ্য গ্রহণও শুরু হয়েছে।
রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এসব মামলার দ্রুত বিচার নিয়ে নেতাকর্মীদের মাঝে শংকা তৈরি হয়েছে। সরকার বিএনপিকে মামলার জালে জড়িয়ে আগামী নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে চায়। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমাদের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও জিয়া পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত সবগুলো মামলাই ভিত্তিহীন। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে নাইকো বা গ্যাটকোর যে মামলাগুলো সচল করা হয়েছে একই মামলা ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেও। তারা ক্ষমতায় এসে নিজেদের মামলাগুলো তুলে নিয়ে বিএনপি নেতাদের মামলাগুলো সচল করেছে। সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে নিম্নআদালতে খালাস দেয়ার পর হাইকোর্টের মাধ্যমে সে মামলা সচল করা হয়েছে। এগুলো সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত। জনগণ বুঝে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে না পেরে এ সরকার মামলাকে বিরোধীদল দমনের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এটা নতুন নজির। আগামী নির্বাচনে মামলার কারণে বিএনপি নেতারা বিপাকে পড়বেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে মির্জা আলমগীর বলেন, পরিবেশ এবং পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে।
সূত্র: মানবজমিন