শান্তিতে নোবেল ও আমাদের প্রধানমন্ত্রী উপাখ্যান
- হাসান হামিদ-
কয়েক দিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার নিয়ে অনেক পোস্ট লক্ষ করছিলাম, বিশেষ করে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে জড়িয়ে। অবশেষে সব ধারণা-জল্পনার অবসান ঘটিয়ে চলতি বছর বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানজনক ও মূল্যবান নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছে পরমাণু অস্ত্রমুক্তির আন্তর্জাতিক প্রচারণা জোট ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্যাম্পেইন টু অ্যাবলিশ নিউক্লিয়ার উইপনস’ (ইকান)। ৬ অক্টোবর বাংলাদেশ সময় বিকেল ৩টায় নরওয়ের রাজধানী অসলোতে শান্তিতে পুরস্কার মনোনয়ন কর্তৃপক্ষ নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটির সংবাদ সম্মেলনে বিজয়ী হিসেবে এ জোটের নাম ঘোষণা করা হয়। শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রদান নোবেল পুরস্কারের একটি বিভাগ। ১৯০১ সাল থেকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হচ্ছে। এ বছর নোবেল কমিটির বিবেচনায় ‘যেকোনো পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় তৈরি করতে পারে বলে বিশ্ববাসীর মনোযোগ আকর্ষণে কাজ করায় এবং এ ধরনের অস্ত্রের ওপর চুক্তির মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা আরোপের লক্ষ্য অর্জনে যুগান্তকারী প্রচেষ্টার জন্য’ ইকান এই পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে।
বাংলাদেশ যখন একদিকে প্রবল বন্যা আক্রান্ত, লাখ লাখ বানভাসি মানুষের দুর্গতি লাঘবে সরকার সর্বশক্তি প্রয়োগ করছেন, ঠিক এই সময় প্রতিবেশী মিয়ানমারে শুরু হয়েছে গণহত্যার পুনরাবৃত্তি। লাখ লাখ মানুষ বন্যার পানির মতো বাংলাদেশে ঢুকছে। নানা অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সত্ত্বেও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিয়ানমারের মুসলিম রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছেন। ইউএনএইচসিআর- এর শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি বলেছেন, শরণার্থীদের প্রতি বাংলাদেশের মানুষ যে মমত্ববোধ দেখিয়েছে, তা তিনি তার কর্মজীবনে কখনো দেখেননি।
মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে ৮ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয়ায় বাংলাদেশের প্রশংসা করেছেন বিশ্বনেতারা। শেখ হাসিনার ভাষণের পরেই এশিয়ার দেশ পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, কাজাখাস্তান, পূর্ব ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়ার মাঝামাঝি অবস্থানে থাকা তুরস্ক, মধ্যপ্রাচ্যের বাহরাইন, আরব আমিরাত, কুয়েত, সৌদি আরব, তিউনিসিয়া। আর ইউরোপের আয়ারল্যান্ড ও জার্মানি মিয়ানমার সংকট নিরসনের প্রশ্নে সরব হয়। ফলশ্রুতিতে, জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক কমিশনার শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করে বলেছেন রাখাইনে সন্ত্রাস বন্ধ করতে হবে এবং শরণার্থীদের ফেরৎ নিতে হবে। যুক্তরাজ্য মিয়ানমার সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণের সুযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটেও মিয়ানমারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে কথা শুরু হয়েছে।
রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপর একটা ভয়ানক চাপ। মানবতার অবতার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, “আমরা ১৬ কোটি মানুষের দেশ। সবার জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পেরেছি। সেখানে আরও ৭ লাখ মানুষকেও খেতে দিতে পারবো।” উল্লেখ্য, চল্লিশের দশকে বিশ্বশাসক ব্রিটিশ সরকারও অবিভক্ত বাংলাদেশে পঞ্চাশ লাখ লোককে অনাহারে মরতে দিয়েছে। নোবেলজয়ী উইন্সটন চার্চিলের মনে ভারতের দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের জন্য কোন মমত্ববোধ ছিলো না। কিন্তু শেখ হাসিনার মাঝে আর্তমানবতার জন্য সংবেদনশীল মানবিকতা আছে। একইভাবে বিশ্বশান্তির অগ্রদূত হিসেবে আঞ্চলিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় ১৯৯৯ সালে শেখ হাসিনা পার্বত্য শান্তি চুক্তি সম্পাদন করেন। যার সাদৃশ্য রয়েছে কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট হুয়ান ম্যানুয়েল সান্তোসকে কলম্বিয়ার গৃহযুদ্ধ অবসানে কমিউনিস্ট ফার্ক (রেভ্যুলুশনারি আর্মড ফোর্সেস অব কলম্বিয়া) বিদ্রোহীদের সঙ্গে ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তি সম্পাদনের জন্য তাকে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে। এছাড়াও, সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে শেখ হাসিনা বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশের মধ্যে ছিটমহল বিনিময় চুক্তি ছিল মানবাধিকার সুরক্ষার আরও একটি যুগান্তকারী ঘটনা। ৬৮ বছর দেশহীন থাকা অর্ধ লক্ষ মানুষ দেশের পরিচয় পেয়েছেন শেখ হাসিনার দক্ষ কূটনৈতিক সফলতার মাধ্যমে।
বিশ্ব বিখ্যাত ফোর্বস ম্যাগাজিন জরিপে বিশ্বের ৪৭তম ক্ষমতাধর নারী শেখ হাসিনা। যুক্তরাষ্ট্রের সাময়িকী ফরচুনে প্রকাশিত তালিকা মতে, বিশ্ব সেরা ৫০ নেতার মধ্যে শেখ হাসিনা দশম স্থানে। ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক নিউইয়র্ক টাইমস সাময়িকীর জরিপে বিশ্বের সেরা প্রভাবশালী ও ক্ষমতাধর নারী নেতৃত্বের মধ্যে তিনি ৭ম স্থানে ছিলেন। ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি বলেছেন, শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন ঘটেছে। কানাডার আর্ন্তজাতিক উন্নয়ন মন্ত্রী মেরী ক্লদ বিবেউ বলেছেন, শেখ হাসিনা নারীর ক্ষমতায়নে দক্ষিণ এশিয়ার স্তম্ভ। যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন এ্যাফেয়ার্স সাময়িকীতে মানবজাতির উন্নয়ন ও কল্যাণের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মৌলিক চিন্তা, গবেষণা, উদ্ভাবন, সৃষ্টি এবং আকর্ষণমূলক কাজের জন্য বিশ্বের যে ১০০ শীর্ষ ব্যক্তির তালিকা করা হয় সেখানে শেখ হাসিনার অবস্থান ১৩তম।
প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘে মিয়ানমারের সমস্যা স্থায়ীভাবে সমাধানের জন্য পাঁচটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব তুলে ধরেন। সেগুলো হলো: প্রথমত, অনতিবিলম্বে এবং চিরতরে মিয়ানমারে সহিংসতা ও ‘জাতিগত নিধন’ নিঃশর্তে বন্ধ করা; দ্বিতীয়ত, অনতিবিলম্বে মিয়ানমারে জাতিসংঘের মহাসচিবের নিজস্ব একটি অনুসন্ধানী দল প্রেরণ করা; তৃতীয়ত, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সব সাধারণ নাগরিকের নিরাপত্তা বিধান এবং এ লক্ষ্যে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সুরক্ষা বলয় গড়ে তোলা; চতুর্থত, রাখাইন রাজ্য হতে জোরপূর্বক বিতাড়িত সকল রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে তাদের নিজ ঘরবাড়িতে প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করা; পঞ্চমত, কফি আনান কমিশনের সুপারিশমালার নিঃশর্ত, পূর্ণ এবং দ্রুত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা। সোজা কথায় অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তার হুমকি সত্ত্বেও শেখ হাসিনা বড় ধরনের ঝুঁকি নিয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিশাল ও সম্পদশালী রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ ধ্বনি তুলে মেক্সিকো বর্ডারে কাঁটাতার বসানোসহ অভিবাসনবিরোধী নীতি অনুসরণ করে চলেছেন কিংবা ইউরোপের বিভিন্ন দেশ যেখানে মধ্যপ্রাচ্য ও অন্যত্র থেকে উচ্ছেদ হওয়া আশ্রয়প্রার্থী মানুষের ব্যাপারে প্রায় ‘দরজা বন্ধ নীতি’ অনুসরণ করছে, তখন রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দান প্রশ্নে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভূমিকা সত্যিই প্রশংসনীয় ও সাহসী। তিনি ২০১৬ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন ও তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নে বিশেষ অবদানের জন্য জাতিসংঘ ‘ডেভেলপমেন্ট অ্যাওয়ার্ড ফর আইসিটি’ পুরস্কার এবং ২০১৫ সালে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ’ লাভ করেছেন। এ বছরই শেখ হাসিনা রাজনীতিতে নারী পুরুষের বৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালনের জন্য ডব্লিউআইপি (ওম্যান ইন পার্লামেন্ট) গ্লোবাল অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। ২০১৪ সালে নারী ও শিশু শিক্ষা উন্নয়নে বিশেষ অবদানের জন্য ইউনেস্কো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘শান্তিবৃক্ষ পদক’ পুরস্কারে ভূষিত করে। ২০১৩ সালে খাদ্য নিরাপত্তা এবং ক্ষুধা ও দারিদ্র্য বিমোচনে বিশেষ অবদানের জন্য জাতিসংঘের ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর সাউথ-সাউথ কো-অপারেশন, ‘ডিপ্লোমা এওয়ার্ড’ পদকে ভূষিত করে শেখ হাসিনাকে। ২০১২ সালে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য রক্ষা এবং সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে বিশেষ অবদানের জন্য কালচারাল ডাইভারসিটি পদকে ভূষিত করে। ২০১১সালে ইংল্যান্ডের হাউস অব কমন্সের স্পিকার জন ব্রেক্রো প্রধানমন্ত্রীকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে দূরদর্শী নেতৃত্ব, সুশাসন, মানবাধিকার রক্ষা, আঞ্চলিক শান্তি ও জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সচেতনতা বৃদ্ধিতে অনবদ্য অবদানের জন্য গ্লোবাল ডাইভারসিটি অ্যাওয়ার্ড প্রদান করেন। একই বছর স্বাস্থ্য খাতে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে নারী ও শিশু মৃত্যুর হার কমানোর ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন (আইটিইউ) সাউথ সাউথ নিউজ এবং জাতিসংঘের আফ্রিকা সংক্রান্ত অর্থনৈতিক কমিশন যৌথভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সাউথ সাউথ অ্যাওয়ার্ড-২০১১: ডিজিটাল ডেভেলপমেন্ট হেলথ এই পুরস্কারে ভূষিত করে। শিশুমৃত্যু হ্রাস সংক্রান্ত এমডিজি-৪ অর্জনের স্বীকৃতিস্বরূপ জাতিসংঘ ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল অ্যাওয়ার্ড প্রদান করে। ২০১০ সালেই বিশ্বখ্যাত ‘ইন্দিরা গান্ধী শান্তি পদক-২০০৯’ এ ভূষিত হন প্রধানমন্ত্রী। ১৯৯৮ সালে নিখিল ভারত শান্তি পরিষদ শান্তি ও সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠায় অবদানের জন্য শেখ হাসিনাকে ‘মাদার তেরেসা পদক’ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অনন্য অবদান রাখার জন্য ইউনেস্কো শেখ হাসিনাকে ‘ফেলিঙ্ হুফে বইনি’’ শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করে। এই পার্বত্য শান্তি চুক্তির জন্য ১৯৯৯ সালে শেখ হাসিনার নাম নোবেল শান্তি পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকায় এসেছিল। এরপর ২০১২ সালে শেখ হাসিনা বিশ্ব শান্তির দর্শন ‘জনগণের ক্ষমতায়ন’ জাতিসংঘে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হলে, নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য তার নাম বিবেচনায় আসে। এ কারণেই এমন প্রত্যাশা ছিল অনেকের। এর জন্য হয়তো আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে।