পি সি দাশ, শাল্লা
মুজিববর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর উপহার গৃহহীনদের গৃহ নির্মাণে নজিরবিহীন দুর্নীতি অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলায়। ভূমি নেই-ঘর নেই এমন নিঃস্ব মানুষকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্নের ‘আশ্রয়ণ প্রকল্পের’ মাধ্যমে জমির সঙ্গে স্থায়ী সেমিপাকা ঘরের মালিকানা দেয়ার কর্মসূচিতে সারা দেশের ন্যায় শাল্লার ৪ ইউনিয়নে ১৪৩৫টি ঘর নির্মাণ হয়েছে। ঘর নির্মাণ কাজে শুরু থেকেই নানাবিধ অনিয়মের কারণে এ কাজের সাথে সম্পৃক্ত মৎস্য অফিসার মামুনুর রহমানকে বান্দরবান বদলি করা হয়। এবিষয়ে শাল্লা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আল মুক্তাদির হোসেনকে ৭ই জুন কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছেন সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক। তাছাড়া দরিদ্র গৃহহীনদের পরিবহন খরচ বাবদ ৫৭ লাখ ৪০ হাজার টাকাও উপকাভোগীদের ফেরত দিয়েছেন ইউএনও । স্থানীয় প্রশাসন ঘরের সার্বিক কাজ শেষ হওয়ার দাবি করলেও ৩০ জুন পর্যন্ত ঘরের কাজ সমাপ্তই হয়নি। সরকারের নিয়মনীতি উপেক্ষা করে প্রায় ২৫৭টি ঘর দেয়া হয়েছে রেকর্ডিয় জায়গায়। আবার বহু ভূমিহীন রিক্ত অসহায় পরিবার বঞ্চিত হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর উপহার থেকে।
এদিকে আবার ঘরের কাজ শেষ হতে না হতেই বেশ কিছু ঘরে দেখা দিয়েছে বড় বড় ফাটল। ব্যবহারের আগেই কোনো কোনো ঘরের রান্নাঘর ও বাথরুমের অংশ ধসে পড়েছে। খসে পড়ছে দরজা জানালাও। সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে এমন দৃশ্যই দেখা গেছে উপজেলার ভেড়াডহর, সেননগর, আটগাঁও, মুজিবনগর সহ বেশ কয়েকটি গ্রামে । অন্যদিকে বেশকিছু ঘরের কাজ অসম্পূর্ণ থাকায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন সুবিধাভোগীরা। অনেকই আবার বাড়তি সিমেন্ট, কাঠও, ফ্লোর করতে ইটের সঙ্কটের কথাও বলেছেন। বাহাড়া ইউপির ভেড়াডহর গ্রামের প্রধানমন্ত্রীর উপহারের সুবিধাভোগী বেনু বৈষ্ণব বলেন, ঘরের কাজ এখনো শেষ হয়নি। সড়কে থাকছি এতদিন। এখন অন্যের বাড়িতে গেছি। আমরারে যে কষ্টের মাঝে ফালাইছে ভাষায় প্রকাশ করার মত না।
নগেন্দ্র বৈষ্ণব বলেন আমি গরিব মানুষ। টুকরি দোকানদারি কইরা খাই। এই কয়টা মাস আমার ৩টা ছোট বাচ্চা লইয়া সীমাহীন কষ্ট করছি। ২৬ জুন আমার ঘরে টিন লাগাইতাছে। আমার মূল ঘরের সামনের অংশ ফাইট্টা গেছে। এখন জোড়াতালি দিতাছে। আমি মানতাম না। এই ঘর যদি ভাইঙ্গা পড়ে? আমার ঘর আবার নতুন কইরা বানাইয়া দেউক। নির্মল বৈষ্ণবের স্ত্রী বলেন, ৪টা মাস পরের ঘরে থাকতাছি। আমার স্বামী অসুস্থ। আরো সিমেন্ট লাগে। কই পাইমু টাকা? ভাত খাইতেই কষ্ট অইতাছে। ওই গ্রামের অলি বৈষ্ণব বলেন, আমার ঘরেও ফাটল দেখা দিছে। তিনি বলেন, শুধু আমার ঘরে নয় পূর্বহাটি ও টুকের হাটিতেই এমন ১০টা ঘরে ফাটল দিছে। এগুলো কোনোরকমে জোড়াতালি দিয়ে প্লাস্টার করতাছে। ব্যবহারের আগেই এই অবস্থা! আর ব্যবহার করলে একটা ঘরও ঠিকত না। তিনি আরো বলেন, মৃত যোগেশ বৈষ্ণবের স্ত্রী সীতা রাণী বৈষ্ণবের ঘরটা ৪আঙ্গুল ফাটল। এই মহিলার ঘরটা যদি ধসে পড়ে-তাহলে জীবনে আর ঘর বানাইত পারত না। দুইটা সন্তান নিয়া অসহায় অবস্থায় আছে ওই বিধবা মহিলা। আবার প্রায় ঘরের দরজা জানালা খসে খসে পড়তাছে।
শাল্লা সদরের অদূরে শান্তিপুর গ্রামের মানিক মিয়া বলেন, শান্তিপুর গ্রামের খায়রুল মিয়া ও রুবেল মিয়ার ঘরে বড় ফাটল দেখা দিছে। অন্যদিকে সেননগরের কেনু মিয়া বলেন, দরজা জানালা ছুইট্টা গেছে। দরজাটা ঠিক করছি। জানালাটা পারছি না। জাহির আহমদ বলেন, আমার জানালাও খুইল্যা পড়ছে। আমার বারান্দায় এখনো টিন লাগানোর বাকি আছে। কাঠ আমি কিন্না আনছি। মুজিবনগরের তোয়াহিদ মিয়া বলেন বৃষ্টি হলে ঘর ভিজে যায়। মোশারফ মিয়া বলেন, বৃষ্টি অইলে ঘরে পানি জমে। ইউনুস আলীর স্ত্রী বলেন, দোয়ারে দিয়া পানি ঢুকে। রান্নাঘরের চালের উপর দিয়াও পানি পড়ে। এসময় হাত দিয়ে তিনি দেখান হাটু পানি হয়ে যায় তার ঘরে। তিনি আরো বলেন, আমার ঘরেও ফাটল। নূর উদ্দিনের স্ত্রী বলেন বৃষ্টি অইলেই ঘর বাইস্যা লাইগা যায়। আমার ঘরও ফাইট্টা গেছে। অঞ্জু বিবি বলেন, বৃষ্টি আইলে ঘরে রান্না করতে পারি না। আমার ঘরের পালা ফাটছে। আলী নওয়াজ বলেন, আমার ঘরে ফাটল আছে। বুলবুল মিয়ার শিশু কন্যাও বলেন ঘরে পানি পড়ে। নূরুজ্জামান, জয়নাল মিয়ার ঘরেও ফাটল। মুজিবনগরের উত্তর পূর্বে অংশেরও অনেক ঘরে একাধিক ফাটল দেখা গেছে। এমনও দেখা গেছে কোনো কোনো ঘরের রান্নাঘর ও বাথরুমের অংশ সম্পূর্ণ ধসে পড়েছে। অনেক ঘরের দরজা জানালাও খসে পড়তে দেখা যায়। আবার ফাটল জায়গায় জোড়াতালি দিয়ে প্লাস্টার করে রং করতেও দেখা গেছে। এসমস্ত ঘরে বসবাস না করায় কার কোন ঘর অনেকই বলতে পারেন না। প্রায় ঘরেই তালা ঝুলতে দেখা যায়।
এসময় সাগর নামের এক যুবক বলেন, আমরা ২৫-২৬টি পরিবার মুজিবনগরে এসেছি। অনেকই জানান বাকিরা ঢাকা সিলেটে আছেন বিভিন্ন কজে। মুজিবনগর নামে নতুন নির্মিত গ্রামে ১০৫টি ঘর সম্পূর্ণ নতুন মাটির উপরে নির্মাণ করা হচ্ছে । ফলে বহু ঘরেই দেখা দিয়েছে ফাটল। আবার বৃষ্টি হলেই পানিতে ভেসে যায় ঘরের ফ্লোর! এমনই অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। আবার অনেক উপকারভোগীরা নির্মিত ঘরে বসবাস শুরু করেছেন। এসব ঘর নির্মাণ কাজের শুরুতেই অনিয়ম ও দূর্নীতি হচ্ছে এমন নানান অভিযোগ রয়েছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও উপকারভোগী পরিবারের লোকজনের। একাধিক ঘরে ফাটলের কারণে উপকারভোগিদের স্বপ্নের ঘরে অনেকই বসবাস করতে কষ্ট হচ্ছে ।
সরজমিনে দেখা যায়, নির্মাণে নিম্ন মানের কাঠ ও দরজা জানালায় ষ্টীলের পরিবর্তে হালকা পাতলা প্লেন শিট ব্যবহার করা হয়েছে। অধিকাংশ ঘরের মেঝেতে সলিং দেয়া হয়নি। বাথরুমের কমোড পাইপ, রিং কোন কিছুই বসানো হয়নি। অথচ প্রতিটি বাথরুম ও মূলঘরের ফ্লোর সলিং এর জন্য ২০ হাজার টাকা বরাদ্ধ রয়েছে। ঘর নির্মানে সলিং বাথরুমের টাকা সংশ্লিষ্টদের পকেটে যাচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
ফলে অধিকাংশ ঘরের দেয়ালে ফাটল দেখা দিয়েছে। ফাটলের কারণে একাধিক উপকারভোগি প্রাণভয়ে স্বপ্নের বাড়িতে বসবাস না করে তালাবদ্ধ করে রেখেছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সকল ঘর নির্মাণ ও ক্রয় সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এককভাবে পরিচালনা করছেন। নির্মাণের মালামাল পরিবহনের টাকা গৃহহীনদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল, পরে জেলা প্রশাসকের নির্দেশে প্রত্যেক পরিবারকে ৪ হাজার টাকা ফেরত দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী দেয়া উপহার স্বপ্নের ঠিকানা পেয়ে আশ্রয়হীন এসব মানুষেরা যে পরিমাণে আনন্দিত হওয়ার কথা তাদের মাঝে সেই আনন্দের ঝিলিক নাই বলেই চলে।
এসব দুর্নীতি অনিয়মের বিষয়ে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক সঙ্গীয় একাধিক কর্মকর্তা নিয়ে শাল্লার একাধিক এলাকা পরিদর্শনে করে ঘর নির্মাণে ভয়াবহ দুর্নীতির চিত্র ফুটে ওঠে। গত চার ফেব্রুয়ারি জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন ৩ জন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ও ২০ জন ম্যাজিস্ট্রেট সঙ্গে নিয়ে শাল্লায় তদন্তে যান। একাধিক দলে ভাগ হয়ে নির্মাণাধীন গৃহহীনদের ঘরে ঘরে সরেজমিন যান তাঁরা। ২০ ফেব্রুয়ারি সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার, সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকগণসহ ২৮ জন ম্যাজিস্ট্রেট ওখানকার নির্মাণাধীন প্রত্যেক ঘরে ঘরে যান। এরপর আরও দুই দফায় জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকসহ ২৪ জন ম্যাজিস্ট্রেট ওখানে দিনব্যাপি গিয়ে তদন্ত করেন।
এবিষয়ে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ফজলুল করিম সর্দার বলেন, আমি তো ছিলাম না। আমি ট্রেনিংয়ে ছিলাম। আপনি একটু ইউএনও স্যারকে জানান। শাল্লা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আল মুক্তাদির হোসেন বলেন, গৃহহীনদের ঘর নির্মাণে অন্যান্য উপজেলা এবং শাল্লার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। অন্য উপজেলায় ঠিকাদাররা গৃহনির্মাণ করেছে। এই উপজেলা প্রত্যন্ত হওয়ায় এখানে বেশিরভাগ উপকারভোগীরা মালামাল পরিবহন করেছে। পরিবহনের বরাদ্দ শুরুতে আসে নাই, এজন্য দিতে পারি নাই, এখন এসেছে, ১৪৩৫ ঘরের প্রত্যেককেই চার হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে ৫৭ লাখ ৪০ হাজার টাকাই গেল ৬ জুন গৃহহীনদের দিয়েছি ।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন গণমাধ্যমকে জানান, মুজিববর্ষে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া দরিদ্র মানুষজনের উপহারে একটি টাকার অনিয়মও সহ্য করা হবে না। শাল্লায় প্রথমেই ৪ ফেব্রুয়ারি ৩ জন এডিসি, ১১ ইউএনওসহ ২০ জন ম্যাজিস্ট্রেট নিয়ে ওখানে যাই, বিভিন্ন ভাগে ভাগ হয়ে দিনভর বাড়ি বাড়ি গিয়ে অনিয়মের বিষয়ে সরেজমিন তদন্ত করেছি। এরপর বিভাগীয় কমিশনার স্যারসহ ২৮ জন ম্যাজিস্ট্রেট, পর্যায়ক্রমে ২৪ জন এবং সর্বশেষ ১৮ জন ম্যাজিস্ট্রেট সরেজমিনে বাড়ি বাড়ি গিয়ে অনিয়ম যাচাই করেছেন। আমাদের চোখে নানাবিধ ত্রুটি বিচ্যুতি ধরা পড়ে, আমরা সেগুলো সংশোধন করিয়েছি, এখনো সংশোধনের কাজ চলছে। শাল্লা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে ৫৭ লাখ ৪০ হাজার টাকা প্রদানে বাধ্য করা হয়েছে। তাকে ৭ জুন শোকজ করা হয়েছে। শোকজের জবাব পেলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
উল্লেখ যে, মুজিবশতবর্ষের উপহার হিসেবে উপজেলা পর্যায়ে দেশের সর্বোচ্চ ১৬শ’ ঘর প্রধানমন্ত্রী শাল্লায় দিয়েছিলেন ভূমিহীনদের। কিন্তু সুষম বণ্টনের অভাবে বহু হত দরিদ্র পরিবার প্রধানমন্ত্রীর উপহার থেকে বঞ্চিত হন। পরে মাত্র ১৪৩৫টি ঘরে নির্মাণ কাজ শুরু হয়। এখনো বহু ঘরের কাজ অসম্পূর্ণ রয়েছে। এরমধ্যে ৩টি গ্রামেই ২৫টি ঘরে ফাটল দেখা দিয়েছে।
সংবাদ টি পড়া হয়েছে :
১৬৬ বার