মানুষের জীবনে শিক্ষা নেওয়ার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো মাধ্যমিক স্তর । একটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার এই স্তরে অব্যবস্থাপনা ও খাম খেয়ালিপনা থাকলে দেশের শিক্ষা কাঠামো দুর্বল ও ভঙ্গুর হওয়া স্বাভাবিক । অথচ আমাদের দেশে বারবার শিক্ষানীতির অযথা পরিবর্তন হচ্ছে । নতুন শিক্ষানীতিতে মাধ্যমিক শিক্ষাকে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত চিহ্নিত করা হয়েছে। উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ভর্তি সঙ্কট স্থায়ী রুপ নিয়েছে। আসন সঙ্কট কাটাতে সরকার কিছু নামি স্কুলে একাদশ–দ্বাদশ শ্রেণি চালু এবং কিছু কলেজে নবম–দশম শ্রেণি চালু করেছে। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানে অবকাঠামোগত সংস্কার ও নতুন চালু করা শ্রেণির জন্য যথেষ্ট শিক্ষক নিয়োগ দেয়া নিয়ে জটিলতা কমেনি। এ ছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে গ্রাম শহর বৈষম্য যেমন রয়েছে তেমনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভালো খারাপ চিহ্নিত করে ভালোগুলোতে মেধাবীদের ভর্তি হওয়া নিয়ে চলে যুদ্ধ। অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীদের সন্নিবেশ ঘটে প্রান্তস্থিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এভাবে বিভাজিত করে গ্রাম থেকে শহরমুখী প্রবণতা তৈরী করা হচ্ছে।

বিজ্ঞান শিক্ষায় আগ্রহ হারাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। ‘বাংলাদেশে মাধ্যমিক পর্যায়ে বিজ্ঞান শিক্ষা‘ নামক গবেষণামূলক একটি বইয়ে উল্লেখিত এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত আট বছরে বিজ্ঞান শিক্ষার্থী কমার হার ৩১.৩৩ শতাংশ। শতকরা ৬৫ জন মনে করে বিজ্ঞানে বিষয়ভিত্তিক প্রয়োজনীয় শিক্ষক নেই, ৬৯ জন মনে করে বিজ্ঞানে পড়লে প্রাইভেট পড়তে হয় এবং ৫৭ জন প্রাইভেট পড়ে, ৬৫ জন মনে করে বিজ্ঞানের জন্য আলাদা গবেষণাগার নেই, ৫৮ জন মনে করে ব্যবহারিক ক্লাসে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নেই, ৯৪ জন বলেছে কোনো বিজ্ঞান মেলা হয় না।

আমাদের দেশে প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতিটি শিক্ষার্থীদের প্রকৃত মেধা মূল্যায়ন করতে পারছে না। কোনো পরীক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমেই শিক্ষার্থীর শতভাগ সঠিকভাবে মেধা মূল্যায়ন সম্ভব না হলেও বিজ্ঞানভিত্তিক পরীক্ষা পদ্ধতি অনেকটা সঠিকভাবে এই কাজ করতে সক্ষম। আমাদের পরীক্ষা পদ্ধতির কারণে মুখস্থ করতে যারা পারদর্শী তারাই বেশিরভাগ সময় ভালো ফলাফল করে। অনেক প্রকৃত মেধাবীর শিক্ষা জীবন সঠিক মূল্যায়নের অভাবে খারাপ ফলাফল করে পর্যদুস্ত হচ্ছে। প্রচলিত এই পরীক্ষা পদ্ধতির কারণে ছাত্র–ছাত্রীরা অধিক হারে নোট বই ও কোচিং নির্ভর হচ্ছে। আর কিছু অসাধু কোচিং ব্যবসায়ী এর সুযোগ নিচ্ছে। পাঠ্যবইগুলো পড়লেই বুঝা যায় কোন সরকার ক্ষমতায়। সরকার বদলের সাথে সাথে সরকারি দলের অনুকূলে বইয়ে ভেজাল মিশ্রণ, তথ্যের বিকৃতি সাধন করা হয় অত্যন্ত নগ্নভাবে।

এসএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র যে স্কুলগুলো সেগুলোতে মাত্র ৭০ থেকে ৮০ দিন শিক্ষা কার্যক্রম চলে। আর যে সব উচ্চ বিদ্যালয়ে এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়না সেগুলো বছরের মাত্র ১০০ থেকে ১১০ দিন শিক্ষা কার্যক্রম চলে। মন্ত্রণালয় ঘোষিত ছুটি প্রায় ৮৮ দিন, সাময়িক পরীক্ষাগুলোর জন্য সর্বনিম্ন ১২ দিন করে মোট ৪৮ দিন, সাপ্তাহিক ছুটি ৫২ দিন, নভেম্বরে বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলে পুরো ডিসেম্বর মাসই বন্ধ থাকে। ফল প্রকাশের পর সব শিক্ষার্থীর হাতে বই এসে পৌঁছাতে লাগে আরো দেড় থেকে দুই মাসের মতো। এছাড়া এসএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র যেসব স্কুল সেগুলোতে আরো অন্তত ১ মাস ক্লাস বন্ধ থাকে। নানা উপলক্ষে অনেক সময় বিদ্যালয় খোলা থাকলেও ক্লাস চলে না। কলেজগুলোতেও প্রায় একই অবস্থা। যেসব কলেজ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত সেগুলোর অবস্থা আরো করুন। পরীক্ষার জন্য স্বতন্ত্র হল না থাকায় ক্লাস বন্ধ রেখে কলেজের ২টি বর্ষের পরীক্ষা, এইচএসসি পরীক্ষা, অনার্স ৪টি বর্ষের ফাইনাল, ডিগ্রী ৩টি বর্ষের ফাইনাল, মাস্টার্স ২টি বর্ষের ফাইনালসহ ভর্তি কার্যক্রমের দরুন এসব কলেজে ক্লাস হয় না বললেই চলে।

দেশে মাদ্রাসা শিক্ষার প্রধান দুটো ধারা হলো – আলিয়া ও কওমী। আরো রয়েছে নূরানী মাদ্রাসা, ফোরকানিয়া মাদ্রাসা ও হাফিজিয়া মাদ্রাসা ইত্যাদি।
বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় দেখা গেছে দেশের মাধ্যমিক স্তরে পড়ুয়া শিক্ষার্থীর অন্তত ২.২ শতাংশ কওমী মাদ্রাসায় পড়ালেখা করে। এসকল মাদ্রাসাগুলোর পাঠ্যক্রমে একটির সাথে আরেকটির বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। ক্ষেত্র বিশেষে কোনো কোনোটিতে বাংলা, বিজ্ঞান, অংক, ইংরেজি পড়ানো হয় না। সম্প্রতি কওমী মাদ্রাসার সনদকে সমমান বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে।

আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে মাদ্রাসা শিক্ষার বেলায় যে কথাটি সবাই মানেন সেটি হচ্ছে এ ধারার শিক্ষা পদ্ধতিটি অত্যন্ত পশ্চাৎপদ। সচেতন অভিভাবকেরা পারতপক্ষে এ ধারায় তাঁর সন্তানকে পড়াতে চান না। মূলত খরচ কম হওয়ায় বিশেষত গ্রামাঞ্চলের অস্বচ্ছল পরিবারের সন্তানরা ও এতিম ছেলে মেয়েরা এই মাধ্যমে পড়তে বাধ্য হয়। আবার পরকালে মুক্তির আশায় কোনো কোনো অভিভাবক তাঁর অন্তত একটি সন্তানকে মাদ্রাসায় পড়ান।

১৯৮৬ সালে দাখিল ও আলিম স্তরকে যথাক্রমে এসএসসি ও এইচএসসির সমমান দেয়া হয়। তারপর ২০০৬ সালে ফাজিল ও কামিল স্তরকে যথাক্রমে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সমমান প্রদান করা হয়। এগুলো মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের সাথে একধরনের প্রতারণা এবং এটি ছিলো ভোটের রাজনীতি। কারণ শুধু সমমান দিলেই মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের মত যোগ্যতর হয়ে যায় না। মাদ্রাসা শিক্ষা সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে অনেক পিছিয়ে। মাদ্রাসা শিক্ষায় মূলত পাঠ্যপুস্তক ও সিলেবাসের আধুনিকীকরণ করে ধীরে ধীরে এ মাধ্যমটিকে সাধারণ শিক্ষার সাথে একীভূত করলে এর শিক্ষার্থীরা সকল পেশার জন্য নিজেদের যোগ্যতর হিসেবে তৈরী করার সুযোগ পাবে। ঠিক তখনই সমমান দেয়াটা মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের কাজে আসবে। মাদ্রাসায় আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার মাধ্যমে চিন্তায় চেতনায় সমাজ গড়ার কারিগর তৈরী হবে।
দেশের বেশিরভাগ মাদ্রাসাতেই জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সংগীত গাওয়া হয় না। পাঠ্যসূচিতে জাতীয় ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ সম্পর্কিত পড়া খুবই কম। আমাদের দেশের মাদ্রাসা শিক্ষা এখনও পুরোপুরি ধর্ম শিক্ষা নির্ভর। মাদ্রাসাগুলোর পাঠ্যপুস্তক ও সিলেবাসগুলো আধুনিক জ্ঞান–বিজ্ঞানের অনুকূল না হওয়ায় এখানকার শিক্ষার্থীরা ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কারাচ্ছন্নতা, কূপমণ্ডুকতা থেকে বের হতে পারে না এবং এরাই ধর্ম নির্ভর রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তির শক্তি যোগানদাতা হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

বাংলাদেশে সবচেয়ে উপেক্ষিত শিক্ষা হচ্ছে কারিগরি শিক্ষা। এ শিক্ষায় শিক্ষিতের হার মাত্র ৩ শতাংশ। অথচ উন্নত দেশগুলোতে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিতের হার ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ। দেশের কারিগরি শিক্ষা খুবই নাজুক অবস্থায় গিয়ে পৌঁছেছে। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোতে যে সকল বিষয়ে হাতেকলমে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে তা একেবারেই বাস্তবতাবিবর্জিত। ওই শিক্ষা না দেশে না বিদেশে কোথাও কোনো কাজে আসছে না। ফলে কারিগরি শিক্ষার প্রতি ছাত্রছাত্রীরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। উৎপাদনমুখী ও স্বনির্ভর অর্থনীতির জন্য দরকার দক্ষ জনশক্তি। আমাদের দুর্ভাগ্য আমাদের অর্থনীতি মোটেও উৎপাদনমুখী নয়। উৎপাদনমুখিতা না থাকায় কারিগরি শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য থাকে বিদেশে দক্ষ শ্রমিক পাঠিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা। অথচ বিদেশ গমনেচ্ছু বিশাল একটি অংশই কিন্তু অদক্ষ শ্রমিক। এই অংশকেও সঠিকভাবে কারিগরি শিক্ষার আওতায় আনা যাচ্ছে না।

কারিগরি শিক্ষায় অন্যতম সমস্যা হচ্ছে তীব্র শিক্ষক সঙ্কট এবং নিম্নমানের শিক্ষা ব্যবস্থা। কারিগরি শিক্ষা অধিদফতরের সূত্রমতে, স্থায়ী অস্থায়ী মিলিয়ে বর্তমানে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলোতেই ৪৬ শতাংশ শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে। অন্যদিকে ভোকেশনাল ইনস্টিটিউটগুলোতে শিক্ষকদের শূন্য পদ ৬৪ শতাংশ। লোকবল সংকটও চরম। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর পদেও ৫৬ শতাংশ খালি রয়েছে। বিজ্ঞান শিক্ষার সমান্তরালভাবে কারিগরি শিক্ষার বিস্তার ছাড়া আধুনিক বিশ্বের সাথে প্রতিযোগিতায় আমরা টিকে থাকতে পারবো না। কিন্তু এই শিক্ষা নিয়ে এক ধরনের অবহেলা দৃশ্যমান। মেধাবীদের আকৃষ্ট করার জন্য কোনো পদক্ষেপ নেই। অভিভাবক মহলে বরং এক ধরনের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বিদ্যমান। সবকিছু বিবেচনায় এনে অচিরেই পদক্ষেপ না নিলে এর মাশুল আমাদেরকেই দিতে হবে । আমরা তা চাই না, আমরা সঠিক ও মানসম্মত আধুনিক শিক্ষা চাই ।

(লেখক হাসান হামিদ গবেষক ও কবি)

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn